ড. ইউনুস বেশ কিছুদিন যাবত সামাজিক ব্যবসা নামে একটি নতুন ধারনার কথা দেশে বিদেশে বলছেন এবং এই নিয়ে একটি বইও লিখেছেন। ইউনুস সেন্টার ডট অর্গ নামে তার একটি ওয়েবসাইটে এই নিয়ে বিস্তারিত লিখে তিনি সাড়া ফেলে দিয়েছেন। তিনি অতি সম্প্রতি তার কানাডাতে ভ্রমনকালে তাদের সরকারের কাছে অনুরোধ করেছেন যে তারা যেন বাংলাদেশে দেয়া তাদের দানের অর্থ হতে একটি অংশ সামাজিক ব্যবসা তৈরীতে দিয়ে দেন । শুধু তাই নয়, জানা গেছে তিনি জাপানেও একই কথা বলেছেন।
নিজে একজন বিনিয়োগকারী হিসেবে আমি এই বিষয়টি নিয়ে আমার মতামত, সবার চিন্তার জন্য এখানে লিখছি। এটি একটি মডারেটেড সাইট, তাই মতামত মডারেট করা হবে, তবে মতামত কেবল অশ্রীল অথবা ব্যাক্তিগত আক্রমন জনিত কারনে মডারেটেড হয়, যুক্তির বিপরীতে দেয়া যুক্তিপুর্ন মত মডারেট করা হয় না।
ড. ইউনুস বলেছেন সামাজিক ব্যবসা অন্য আর দশটি ব্যবসার মতোই হবে, তবে পার্থ্ক্য হলো
১. এতে বিনিয়োগকারীরা কোন লাভ নিতে পারবেন না। কেবল তাদের প্রাথমিক বিনিয়োগ ফেরত পাবেন।
২. সামাজিক ব্যবসার সাফল্য বিচার করা হবে সামাজিক উন্নয়নের সূচক দিয়ে। যেমন তারা কতজনকে পুষ্টি সরবরাহ করতে পারলো বা কতজনকে দারিদ্রমুক্ত করতে পারলো অথবা কতজনকে বিশুদ্ধ পানি দিতে পারলো ইত্যাদি।
৩. এই ব্যবসাতে যারা বিনিয়োগ করবেন তারা আত্মতৃপ্তি পাবেন, কোন ভালো কাজ করছেন এটা ভেবে।
৪. যারা এই ব্যবসাতে বিনিয়োগ করলেন তারা এটির মালিক থাকবেন কিন্তু লাভ নিতে পারবেন না। তবে ব্যবসার পরিচালনার সিদ্ধান্ত তারাই নেবেন এবং এতে যারা চাকুরী করবেন তারা বাজার দরে বেতন ভাতা ও সুবিধাদি পাবেন।
৫. সামাজিক ব্যবসা চাইলে মালিকেরা কিছুদিন পরে স্বাভাবিক ব্যবসায় রুপান্তরীত করতে পারবেন। অর্থাৎ তারা লাভ নিতে পারবেন, যদি চান। এটা তাদের মর্জীর উপর নির্ভরশীল।
এই সবই আমি তার ওয়েবসাইট থেকে পেলাম।
আমার প্রশ্ন হলো সকল ব্যবসাই কি কোন না কোন উদ্দেশ্য সামনে নিয়ে তৈরী হয় না? কে লাভ নিল কিংবা নিল না সেটা কি ধর্তব্য? কারন যদি সামাজিক সূচক দিয়েই ব্যবসার ভালোমন্দ নির্ধারিত হয় তবে আমেরিকাতে রেল রাস্তা তৈরী হওয়াতে বিরাট সামাজিক উপকার হয়েছিল। গরীবদের যাতায়াত ও মাল পরিবহন সহজ হয়েছিল। তাই সামাজিক লক্ষ্য বিচারে সেই ব্যবসা তো দারুন এক উপকারী ব্যবসা। লাভ মালিকেরা নিয়ে কোটিপতি হবার পরও সমাজে বিরাট পরিবর্তন এসেছিল। ড. ইউনুসের গ্রামীণ ফোনও একই দাবী করে যে তারা বাংলাদেশের বিরাট ক্ষমতায়ন করেছে। যদি তাই হয় তবে এটা তো সামাজিক ব্যবসা না হয়েও বিরাট সামাজিক লক্ষ্য অর্জন করলো। আবার গ্রামীন ব্যাংক ধার দেয়। তাতে দারিদ্র দুর হয়। যদি তাই হয় তবে এটাও তো সামাজিক ব্যবসা। ধার নিয়ে যখন সে আর দরিদ্র থাকে না তখন সে কেনাকাটা করতে পারে। তাহলে আলাদা করে তার জন্য সামাজিক ব্যবসা কেন দরকার? দরকার এইজন্য যে ধার করে তার যে ক্রয়ক্ষমতা অর্জিত হল, সেই অতিরিক্ত টাকাটি আবার পূঁজিপতিদের পকেটে ফেরত নিয়ে যাওয়া। প্রথমে আমরা ধার দিয়ে সুদ নিলাম।তারপর তার কাছে যেটুকু টাকা জমল সেটি তাকে পূষ্টিকর দই কিংবা বিশুদ্ধ পানি বেচে আবার নিজের কাছে নিয়ে এলাম। যার টাকা আবার তার কাছেই ফিরে এল। লাভ সহ।
তিনি বলেছেন যে সামাজিক ব্যবসা লাভ করবে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য তবে তার আসল লক্ষ্য হবে সামাজিক। সেটা দিয়েই বিচার হবে তার সাফল্য ও ব্যর্থতা।
যখন একটি কোম্পানী মুক্তবাজারে কাজ করে তখন তাকে বাজার এর রীতি অনুযায়ী চলতে হয়। যেখানে লাভ আর ক্ষতি তাকে হিসাব করতেই হবে। তাহলে শুধু তার লক্ষ্য অর্জিত হলো কিনা সেটি কেবল সামাজিক সূচকের বিচারে হিসাব করা কি সম্ভব? যথেষ্ট লাভ না করলে কোম্পানিটি টেকসই কবে না এবং বাজার দরে বেতন ভাতা দিতেও পারবে না। তাই তাকে নিশ্চয়ই লাভ করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ তাকে ফেরত দিতে হবে, লাভ না দিলেও। শুধু তাই নয়, কোম্পানীর ভবিষ্যত উন্নয়নের জন্য তাকে সঞ্চয়ও করতে হবে। ফলে লাভ ক্ষতি প্রতিযোগিতা সবই হবে বাজারের আর যেকোন কোম্পানীর মতই। তাকে বিজ্ঞাপন করতে হবে। এমনকি দুষ্ট প্রতিপক্ষ যদি দাম কমিয়ে বা ভর্তুকী দিয়ে তাকে বাজার থেকে হটাতে চায় তখন তাকেও নানা রকম বাজারী কৌশল নিতে হবে। তার মানে লাভ এর চিন্তা তাকে করতে হবে আর সবার মতোই। এবার উদাহরন হিসাবে গ্রামীন ডানোন শক্তি দই এর কথা ভাবি। ধরা যাক আমিও ঠিক একই রকম দই এর কারখানা দিয়ে একই দামে দই বেচলাম এবং একই পরিমান মানুষের বা বেশী পরিমান মানুষের জন্য পুষ্টি চাহিদা মেটালাম। তার মানে আমি একই পরিমান বা বেশী সামাজিক লক্ষ্য অর্জন করলাম। এবার যদি আমি লাভ ঘরে নেই তাহলে কি ক্ষতি? লাভ কে নিল বা নিল না তার চেয়ে বড় কথা হলো সামাজিক লক্ষ্য অর্জন। তাহলে সামাজিক ব্যবসার চেয়ে বেশী সামাজিক লক্ষ্য অর্জন করার পর যদি কেউ লাভ ঘরে নেয় তাতে কি বা আসে যায়? এবার মনে করেন আমি যদি ডানোনের চেয়ে কম দামে দই বেচি এবং সমান সংখ্যক বা বেশী সংখ্যক লোককে দই খাইয়ে টাকা ঘরে নেই? তখন কিন্তু আমি সামাজিক ব্যবসার চাইতে বেশী সামাজিক লক্ষ্য অর্জন করলাম। অর্থাৎ সামাজিক লক্ষ্য অর্জনই যদি আসল কথা হয় তবে লাভ কে নিল, সেটা কি আর কোন প্রভাবক থাকে?
ড. ইউনুস বলেছেন যে তিনি লাভের বিপক্ষে না। লাভ হবে তবে মালিকেরা লাভ নেবেন না কেবল বিনিয়োগ ফেরত নেবেন। এতে করে ব্যবসাতে নতুন মাত্রা সংযুক্ত হবে। এই ব্যবসা বাজারে মনোপলি করবে না বরং প্রতিযোগিতা বাড়াবে। তাতে করে ব্যবসায়ীরা নতুন উৎসাহ পাবেন।
পুরো বিষয়টিতে একটি ফ্যালাসি আছে। লাভ নেন বা না নেন, লাভ তো করতেই হবে। আর যে কোন কোম্পানী চায় প্রবৃদ্ধি। বাজার বাড়াতে চায়। সেটাই তো প্রতিযোগিতা। তাই সব ব্যবসারই ভেতরে ভেতরে একধরনের মনোপলি তৈরীর বাসনা থাকে কিন্তু প্রতিযোগী থাকলে সেটা পুরোপুরি হয় না। যেমন ক্লোজ আপ বাংলাদেশের জেল টুথপেষ্ট এর বাজার ৮০% দখল করে আছে। এখন যদি একটি বাজারে স্থির জনসংখ্যা ও ক্রয়ক্ষমতায় ক্লোজআপের বিক্রি বাড়ে তবে অন্য পেস্টের বিক্রি কমতে বাধ্য। বাস্তবে এটা হয় না কারন মানুষ বাড়ে, তাদের আয় বাড়ে ফলে বাজার বাড়লেও অন্য জন টিকেও থাকতে পারে। তাই কোম্পানীগুলো বিক্রি বাড়ায় এবং প্রবৃদ্ধি করে এবং নতুন নতুন বাজারের সন্ধানও করে। তারা নতুন পণ্য বাজারে আনে, গবেষণা করে ।
এবার যদি পেস্টের বাজারে একটি সোশাল বিজনেস আসে এবং দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে বাজারে আসে তবে কি হবে? তাকে যেহেতু একই বাজারে থাকতে হবে তাই ক্লোজ আপের সাথেই তাকে প্রতিদ্বন্দিতা করতে হবে। আমরা যদি ভাবি ব্যবসায়ীরা তাকে ছাড় দেবে সেটা ভুল হবে।
তাহলে কি হবে? ব্যবসায়ীরা যেহেতু এই সোশাল বিজনেসে বিনিয়োগ করবেন তাই এটা ভাবা ঠিক হবে না যে তারা নিজের আসল ব্যবসা যেটি সেখানে সামাজিক ব্যবসা করবেন। যেমন স্কয়্যার নিশ্চয়ই আরেকটি সামাজিক হাসপাতাল খুলবে না। তাহলে তো তার আসল ব্যবসা ক্ষতির মুখোমুখি হবে। ধরা যাক তারা একটি জুতার ফ্যাকটরি দিল যেখানে সস্তায় স্যান্ডেল, জুতা বানানো হবে। আর বাটা কোম্পানী একটি হাসপাতাল দিল যেখানে সস্তায় চিকিৎসা হবে। এবার বাটার হাসপাতালের কারনে স্কয়্যার এর হাসপাতাল লস করতে থাকল আর স্কয়্যারের জুতার কারনে বাটার লস হতে থাকল। এভাবে তাদের আসল ব্যবসার লাভ নেই হয়ে গেল আবার তারা কিন্তু তাদের সামাজিক ব্যবসা থেকেও লাভ পান না। বিনিয়োগকারী কি তখন লাভ না নিয়ে বসে থাকবে? স্যামসন সাহেব কিংবা বাটা কি তখন একে অন্যের সামাজিক ব্যবসার হাতে নিজেদের আসল ব্যবসার ধ্বংস বসে বসে দেখবেন?
ব্যবসা দুটি পরিচালনা করছেন যারা তারা কিন্তু ঠিকই বাজার দরে বেতন নিচ্ছেন। ফলে যা যাবে, যাবে বিনিয়োগকারীর, সি ই ও সাহেব যেমন ছিলেন তেমন থাকবেন। মনে করেন ব্যবসা দুটির সামাজিক অংশীদার বা পরিচালনা করছে গ্রামীন ব্যাংক। তাহলে কার লাভ?
বিনিয়োগকারীরা লাভ নেবে না কিন্তু তারা মালিক থাকবে। এখানেই শুভংকরের ফাঁকি। আগে যখন তারা দান করতেন, সি এস আর করতেন তখন সেই টাকাটি তাদের হিসাবে খরচ হিসেবে লিখে রাখা হতো। ফলে ব্যালান্স শিটে সেটি বিয়োগ হয়ে যেত। কোম্পানীর অ্যাসেট কমতো। এখন তারা সোশাল বিজনেসে বিনিয়োগ করবেন এবং সেই ব্যবসার মালিকও থাকবেন। ফলে তাদের টাকা আর বিয়োগ হবে না কারন তারা এই টাকা আবার ফেরত পাবেন।শুধু তাই নয় যে কোম্পানীটি তারা বানালেন সেটির যতো সম্পদ সেটি বাড়ীতে না নিলেও সেটিকে তাদের সম্পদ হিসেবে দেখাতে পারবেন। ফলে দান না করেও দানের মতো বাহবা নিয়ে, পুরষ্কার নিয়ে, বুক ফুলিয়ে চলবে সেই সব বিনিয়োগকারী যারা সোশাল বিজনেস করছেন আবার তাদের সম্পদ কমবে না একটুও বরং বাড়তেই থাকবে। একজন চটপটিওয়ালার লাভ প্রতিদিন ঘরে না নিলে তার সংসার চলে না। কিন্তু যার ১০০০ কোটি টাকা আছে তিনি ১০০ কোটি টাকা দিয়ে যদি সামাজিক ব্যবসা করেন এবং সেই ১০০ কোটি টাকা ফেরত পেয়ে যান, আবার সোশাল কোম্পানীটিরও মালিক থাকেন এবং সেটির সম্পদ যদি ২০০ কোটি টাকা হয় তবে তার মোট সম্পদ ১২০০ কোটি টাকা হলো। তিনি সেই টাকা ঘরে না নিলে কি কিছু আসে যায়? তিনি তো আর চটপটিওয়ালা না যে একটি ব্যবসার টাকা ঘরে না নিলে তার সংসার চলবে না। তারই তো সব টাকা। তার সম্পদ তো বাড়তেই থাকল। বিল গেটস কি সব টাকা বাসায় নিয়ে যান? তার সম্পদ বাড়ে। এটাই তার আয়।
তার মানে দান না করেও দানের ফিলিংস পেলেন আবার টাকা আপনার বাড়তেই থাকল। এটাকেই ড. ইউনুস বলেছেন স্যাটিসফ্যাকশণ। যার জন্য নাকি দলে দলে কোটিপতিরা সোশাল বিজনেস করবে। অবশ্যই করবে। দান করবে না আর, সোশ্যাল করবে।
চলবে....(প্রথম পর্ব সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০১১ রাত ১:০২