দেশের অর্থনীতি
গত কয়েকবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় যে বড় অভিঘাতগুলো এসেছে তার মধ্যে একটি হলো ১/১১ পরবর্তি আতংক। ব্যবসায়ীদের ধরে আনা, অহেতুক নজরদারী এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ এর মতো অদ্ভুত কাজে দেশের ব্যবসায় স্থবিরতা নিয়ে আসে। মূলত এই কারনেই দ্রুত ১/১১ এর সেনা সমর্থিত সরকার জনপ্রিয়তা পায়নি। এরপর আওয়ামী লীগের শাসনে বিরাট ভর্তুকীর চাপ এবং বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনে ভাড়া ভিত্তিক ডিজেল কেন্দ্রগুলিকে সরকারী খরচে ডিজেল সরবরাহের কারনে সরকারকে বিরাট ডিজেল ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। একটি ১০০ মেগাওয়াট কেন্দ্র স্থাপনে যা টাকা লাগে, তারচেয়ে বহুগুন বেশী টাকার ডিজেল লাগে সেটি চালাতে। গত চারমাসে দুবার তেলের দাম বাড়িয়ে এই ভর্তুকী সমন্বয়ের চেষ্টা করেছে সরকার। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়াতে এই ভর্তুকী আবার সমন্বয় করতে হবে সরকারকে। ফলে বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়াতে হবে। বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়ানো মানেই মুদ্রাস্ফীতি আরো বাড়বে। একই সাথে বাড়বে দ্রব্যমূল্য। দাম বাড়লে সাধারন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। ফলে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করার মতো অর্থ সাধারন মানুষের হাতে থাকবে না বরং মানুষ সঞ্চয় ভেঙ্গে খেতে শুরু করবে। এর ফলে ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপর চাপ বাড়বে। ব্যাংকগুলি ঋণ দিতে হিমশিম খাবে। অন্যদিকে ঋণপ্রবাহ কমে গেলে দেশে শিল্প স্থাপন, ব্যবসা বানিজ্য বাধাগ্রস্ত হবে। দেশে প্রায় ১০% বেকার। মনে রাখতে হবে কৃষি শ্রমিকদের কাজ আছে ধরে নিয়ে এই বেকারত্বের হিসাব। একই জমিতে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশী মানুুষ কাজ করে এখন। আসলে এই বেকারত্ব অনেক বেশী। তারপরেও যদি ১০% বেকার ধরে নেই, দেশে দেড় কোটি বেকার। দেড় কোটি কর্ম সংস্থানের জন্য কম পক্ষে পনের হাজার বৃহৎ শিল্প স্থাপন জরুরী। একথা এখন প্রায় স্পষ্ট যে ম্যানিফেস্টোর অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি মহাজোট পূরন করতে পারবে না।
অতি দ্রুত শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগ করা খুবই জরুরী। শিল্প বিনিয়োগে স্থবিরতার কারনে বাংলাদেশের চাকুরীর বাজারে নতুন চাকুরী তৈরী হচ্ছে না বললেই চলে। কেইনসীয় মডেলে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে বেকারত্বকে কমিয়ে আনার কোন বিকল্প নাই। যতো বেশী বেকার, ততো বেশী প্রবৃদ্ধি কমে যাবার সম্ভাবনা এবং ততো বেশী মুদ্রাস্ফীতি। বেকারত্ব নিয়ন্ত্রনে রাখতে চাইলে , জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনে আরো বিনিয়োগ দরকার। একই সাথে যারা এখন তরুন বেকার, তাদের নানা রকম প্রশিক্ষন দিয়ে উৎপাদনশীল কাজে লাগানো প্রয়োজন। দেশের গার্মেন্টস শিল্প এখন সবচেয়ে বড় শ্রমঘণ শিল্প। কৃষি এখনো সবচেয়ে বড় আয়ের ও কর্মসংস্থানের খাত। আওয়ামী লীগ তাদের ম্যানিফেস্টোতে প্রতি ঘরে একটি করে চাকুরীর সংস্থান করবে বলেছিল, ২০২১ সালের মধ্যে জাতীয় আয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ শিল্পখাত থেকে নিয়ে আসার কথা বলেছিল, বলেছিল বিদ্যুত উৎপাদন ৭০০০ মেগাওয়াটে নিয়ে যাবে । এখন ডিজেল এ ভর্তুকী দিতে গিয়েই টাকা ফুরিয়ে আসছে। দেশে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় আছে। অর্থ মন্ত্রণালয় আছে। এই দুটি মন্ত্রনালয় এর বড় দায়িত্ত্ব হল সরকারের সকল প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নে নিজেদের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে আর্থিক ও পরিকল্পনাগত সহায়তা দেয়া । দেশে পাঁচ বছরের যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, সেটির কথা সাধারন মানুষ কতটুকু জানে? উন্নয়ন পরিকল্পনায় সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে, মানুষের সমর্থন দরকার। সেজন্য কোন প্রচারণা আছে? ২০২১ সালে মধ্য আয়ের দেশ হবো, এটা বলার পাশাপাশি , মধ্য আয়ের দেশ হতে হলে আমাদের কাজ কি? এটা কেউ বলছে না কেন?
শেষ কথা
যেভাবে ডলারের দাম বাড়ছে, মুদ্রাষ্ফীতি লাগামহীণ হয়ে পড়ছে, রেমিট্যান্স প্রবাহে চাপ পড়ছে, তাতে অতি দ্রুত দাতা দেশের সাহায্য ও প্রতিশ্রুত ঋণপ্রবাহ চালু না হলে, একটি অর্থনৈতিক অভিঘাত এর সম্ভাবনা আছে। তখন আমদানী করা খাবারের দাম বেড়ে যাবে। বাজারে অস্থিতিশীলতা হবে। এমনকি আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতিও হতে পারে। এরকম সময়ে সরকারের নিজস্ব অর্থীনীতিবিদদের একটি দল থাকা খুবই জরুরী। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড, কৌশিক বসু। বিল ক্লিনটনের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন জোসেফ স্টিগলিজ। ওবামার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা প্রথমে ছিলেন অস্টান গুলসবি, পরে তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যালান ক্রুগারকে নিযুক্ত করেন। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময়ে অর্থনীতিবিদদের সরাসারি পরামর্শ নিতেন, যার মধ্যে রেহমান সোবহান, মোশাররফ হোসেন সহ বিভিন্ন অর্থনীতিবিদের কথা জানি আমরা। বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ কি বাংলাদেশে কেউ নেই? তাহলে আমাদের সরকারের অর্থলৈতিক উপদেষ্টা কারা? মধ্য আয়ের দেশ হবার জন্য যে আর্থিক ব্যবস্থাপনা দরকার, সেটি কি আমাদের আছে? এখন সকলে বাংলাদেশের জন্য সভরেন ঋণের কথা বলছেন। স্ট্যান্ডার্ড পুয়োর, মুডি এসব রেটিং করিয়ে আগেই দেশকে তৈরী করেছে বিশ্বব্যাংক। এখন দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতুর টাকা আটকে দিয়ে বিশ হাজার কোটি টাকার প্রবাহ আটকে দিয়েছে তারা। দেশকে ঋণগ্রস্ত করার জন্য এই ফাঁদে পা দেবে কিনা সরকার, এটাই এখন দেখবার বিষয়। আমরা মধ্য আয়ের দেশ হয়তো হবো, কিন্তু আপাদমস্তক ঋণের জালে আটকে থাকবো। সেই ব্যবস্থাই চলছে। এই দেশের রাজনীতিতে তিনটি উপাদান, অর্থনীতি, ধর্ম এবং পারিবারিক আবেগ। দুঃথের বিষয়, আমরা কেবল আবেগটা বুঝি, ধর্মের নামে কুরাজনীতি করি আর অর্থনীতি একদমই বুঝি না।
পূণশ্চ: আমি অর্থনীতিবিদ নই। বিতর্কের সংগে ত্রিশ বছরের সংশ্লিষ্টতার কারনে অর্থনীতি, বিজ্ঞান, সমাজ ও ধর্ম নিয়ে পড়তে ভালবাসি। সেই সাধারন জ্ঞান দিয়ে এই লেখাটি লিখলাম। অনেক সময় বাইরে থেকে দেখলে যা দেখা যায়, সেটি ভেতরে বসে টের পাওয়া যায় না। আমি তাই বাইরে থেকে দেখলাম।