somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ স্যারের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় এক বিকেল (২০১৬)

২৭ শে মে, ২০২০ রাত ৮:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(বলে রাখা ভালো, আলাপচারিতা শব্দটা ব্যাবহার করছি ঠিক আলাপচারিতা অর্থে নয়। তাতে করে একধরণের ধৃষ্টতাই হয়ে যাবে। ২০১৬ সালের মে মাসের যে বিকেলে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সাথে আমার এই কথোপকথন, তখন আমি ভার্সিটির গণ্ডি সদ্য টপকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনায় যুক্ত হয়েছি। কাজেই সাজিদ উল হক আবিরকে চায়ের কাঁপে চুমুক দিতে দিতে খোশগল্পের নেমন্তন্ন জানিয়েছেন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ - এতো হতে পারে না। তবে বিষয়টা কি ছিল?

সম্পর্ক অনেকদিনের পুরনো। সম্পর্ক গ্রহণ করে ঋদ্ধ হবার। আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর এই ভদ্রলোক কাছ থেকে পরোক্ষে নিয়ে চলেছি, নিজেকে সমৃদ্ধ করে চলেছি সে আজ বছর পনের হল। পরোক্ষ যোগাযোগের দেড় দশক পর, ২০১৬'র মে মাসের সে বিকেলে প্রায় আধাঘণ্টার মত সময়ে আলাপ হয়েছিল সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের নিয়ে, জীবন ও জীবনের দর্শন নিয়ে। বরং খানিকটা ধৃষ্টতা করে যদি বলি - দর্শন বিনিময়ই হয়েছে একযুগের প্রতিষ্ঠাতার সাথে নবীন যুগের এক প্রতিনিধির, অর্থাৎ স্যারের সাথে আমার, তাতেও অপরাধ হয় না। বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত আলোর ইশকুল কার্যক্রমে যে পাঠচক্র অন্তর্গত - তা সরাসরি তত্ত্বাবধান করেন এবং ক্লাস নেন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। সীমিত সদস্যের অন্তর্ভুক্তিতে পরিচালিত কার্যক্রমটিতে কারা কারা অংশ নিতে পারবে - তা নিয়ন্ত্রণও করেন তিনি। তার সাথে সরাসরি সাক্ষাৎকারের দ্বারা পাঠচক্রের সদস্যপদ নির্ধারিত হয়। তো - সেই সূত্রেই আজ ডাক পেয়েছিলাম সাক্ষাতকারে সায়ীদ স্যারের মুখোমুখি হওয়ায়। প্রাচীনে এবং অর্বাচীনে কি ভাবের বিনিময় হয়েছিল ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে, বাংলামটরের ময়মনসিংহ রোডে স্থাপিত বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রের পঞ্চম তলায় বসে - সেটাই এ রচনার আলেখ্য।)

গেট খুলে ভেতরে প্রবেশ করে একটু ধাতস্থ হয়ে বসবার আগেই স্যারের প্রশ্ন - কে তুমি? কি করা হয়?

বললাম - ঢাবির ইংরেজি বিভাগ থেকে এমএ ফাইনাল দিলাম মাত্র। পরে খানিকটা আমতা আমতা করে, যেহেতু কি করা হয় প্রশ্নটির জবাব দিতেই হবে, তাই এও যোগ করে দিলাম - এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেবার দুরূহ কাজটিও সম্পন্ন করতে হচ্ছে। আমতা আমতা করার কারন - আমার কেবলই মনে হয় - এখনও ছাত্র আমি। সদ্যই মায়ের স্তন্যপান শেষে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার পর নবজাতক শিশুর যেমন মুখ জুড়ে থাকে মাতৃদুগ্ধের ঘ্রাণ, আমার শরীর জুড়ে তেমনই সদ্য ত্যাগ করে আসা মহীরুহ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্তের ঘ্রাণ। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের মত একজন শিক্ষকের সামনে নিজেকে আর একজন শিক্ষক বলে পরিচয় দিতে অস্বস্তি লাগা খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়।

যাই হোক, ইউনিভার্সিটিতে পড়াই শুনে সঙ্গেসঙ্গেই জিজ্ঞেস করলেন কোন ইউনিভার্সিটি। ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিকের নাম করতেই চিনলেন তিনি। এরপর ইংরেজিতে যাকে বলে Beating around the bush সেটা না করে সরাসরি প্রশ্ন করলেন আমার সাহিত্য সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। আমি পুনরায় আমতা আমতা করে বললাম (আমতা আমতা শব্দটি বারবার এই কারণে যুক্ত করছি, যাতে করে নিজের সম্পর্কে যে তথ্যগুলো সায়ীদ স্যারের কাছে আমি দিয়েছি, সেগুলো শুনে স্যারের সামনে বসে স্রেফ নিজের কাজ নিয়ে গুমোর করেছি, এমনটা বোধ না মনে হয়। আমি ব্যক্তিমানুষের স্বাধীনতায় পুরোপুরি বিশ্বাসী (যতক্ষণ না সে স্বাধীনতা অন্যের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়), কিন্তু এখনও আমার সামনে কেউ খুব হামবড়া ভাব দেখালে আমার পিত্তি জ্বলে যায়। পারতপক্ষে আমি কারও সাথেই অহম প্রকাশ করে কথা বলি না) তিনটি বই এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে - সে কথা। দিনের একটা লম্বা সময় পড়া- পড়ানো আর লেখালিখিতে কাটে এও জানালাম।

স্যার সে সূত্র ধরেই জিজ্ঞেস করলেন - দিনের মধ্যে লম্বা সময় কেন পড়া নিয়ে কাটানো হয়।

খানিকভেবে উত্তর দিলাম - বই আমার ইউটোপিয়া। এই অর্থে যে - আমার একটা আকাঙ্ক্ষিত জীবন আছে, নিজের জীবন যেরকমভাবে আমি চাই, কিন্তু সে জীবন তো আমি যাপন করতে পারছি না। বই আমাকে আমার আইডিয়াল কিন্তু কাল্পনিক পৃথিবীতে লুকিয়ে থাকার সুযোগ করে দেয়।

স্যার প্রশ্ন করলেন - আইডিয়াল ওয়ার্ল্ড একটা অ্যাবসট্র্যাকট জিনিস। অ্যাবসট্র্যাক্ট একটা বস্তু নিয়ে এত মাতামাতি কেন? আর এই অ্যাবসট্র্যাক্ট পৃথিবীতে লুকোনোর জন্যেই বা বই পড়া কেন?

প্রশ্নটি শোনার পরপরই আমি উত্তর দিতে প্রস্তুত ছিলাম। বই কেন পড়ি এটা নিয়ে আমার লম্বা লম্বা পার্সোনাল হাইপোথিসিস রেডি করা আছে বহু আগে থেকে। কিন্তু আমার মত অর্বাচীনের সাথে স্যার বাদানুবাদে আগ্রহী কিনা নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। তাই আপাত নীরবতা অবলম্বন করে কথা শুনে যাওয়াই শ্রেয় মনে করলাম।

স্যার তখন বলে চলেছেন - এই তোমাদের হচ্ছে কেবল বই পড়া নিয়ে মাতামাতি। কেবল বই পড়াটাকেই এক বিরাট কর্ম মনে করে নাও। এ পর্যায়ে আমি কাঁচুমাচু করে বললাম - স্যার আমি টুকটাক অ্যাক্টিভিজমের সাথেও জড়িত। স্যার সেখান থেকেই আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন - হ্যাঁ ওটাই! টুকটাক অ্যাক্টিভিজম নয়, বরং অ্যাক্টিভিজমই মূল। বললেন - বই পড়া কারও জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না, বরং এই জীবনটাই উদ্দেশ্য, জীবনকে সাধনই উদ্দেশ্য। উদাহরণ টানতে গিয়ে বললেন - এই যে শেক্সপিয়র এত এত লিখে গেলেন, তার সব লেখা পড়ে যাওয়াই কারও জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে কিনা?

বলাই বাহুল্য, এই সূত্র ধরেই আমার বই পড়া সংক্রান্ত নিজস্ব ফিলসফি শেয়ার করার একটা সুযোগ পেলাম। উত্তরে বললাম - স্যার শেক্সপিয়র পড়াটা হয়তো জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু শেক্সপিয়র পড়ার পর মস্তিষ্কে যে অনুরণন সৃষ্টি হয়, আমার মস্তিস্ক যে ফিডব্যাক দেয় - সেটাই আমার প্রাপ্তি। অর্থাৎ, আমি মানুষের লেখা কোন বইকে বেদবাক্য বলে বিবেচনা করি না। যা পড়ি, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা, অ্যানালাইসিস করি। তারপর লেখকের বক্তব্য কিছু গ্রহণ করি, কিছু অংশ ছেঁকে ফেলে দিই। লেখকের সেই গ্রহণ করা অংশ, আমার নিজের সত্ত্বার একটা অংশ হয়ে যায়।

শুনে স্যার বললেন - তবুও তো একটা বই জ্ঞান অর্জনের একটা সেকেন্ডারি সোর্স, বা প্রতিঘাতই মাত্র।

আমি উত্তরে বললাম - বরং স্যার আমি প্রতিটা বইকেই পৃথিবী দেখার আর একটি লেন্স হিসেবেই বিবেচনা করি।

স্যার কি মনে করে যেন প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন - তোমাদের ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের ক্লাসরুমে শিক্ষকেরা লেকচার দেন কোন ভাষায়? উত্তরে বললাম - অধিকাংশ সময়েই প্রায় সব শিক্ষক ইংরেজিতে লেকচার দেন, তবে কখনো কখনো যে দু'চার লাইন বাংলা বলেন না - এমনটা না। পরের প্রশ্নও এলো ডিপার্টমেন্ট সম্পর্কিত এবং আমি বুঝলাম - এ দেশে যারাই শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিমনা, তারাই ঢাবির ইংরেজি বিভাগের ব্যাপারে উৎসাহী, এ অর্থে যে - অনেক কিংবদন্তীর জন্ম দেয়া প্রায় শতবর্ষী এই বিভাগ এখন আছে কেমন - এ প্রশ্ন বা অনুসন্ধিৎসা সবার মনেই থাকে।

স্যার জিজ্ঞেস করলেন - বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা কি টেক্সট বই সব পড়ে? সাক্ষাৎকারের কক্ষে স্যারের পাশেই তার এক বয়স্ক সহযোগী ছিলেন, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কোন উরধতন কর্মকর্তা হবেন, তিনি আমি উত্তর দেবার আগেই বলে বসলেন - এখন সব গাইড বই পড়ে পাশ করে!

নিঃসন্দেহে কথাটা অফেন্সিভ ছিল। কিন্তু তাতে কান না দিয়ে আমি স্যারকে বললাম - স্যার অন্যদের কথা বলতে পারি না, তবে আমি প্রায় সব টেক্সট পড়েছি।

স্যার জানতে চাইলেন - প্রায় বলতে কি বুঝাচ্ছি।

আমি বললাম যে হাতেগোনা দু' চারটে টেক্সট ছিল যেগুলো একদমই হজম হচ্ছিল না আবার এদের ডিঙ্গিয়ে গিয়েও বেশ ভালো ভাবে পাশ করে বের হওয়া যায়।

স্যার বললেন - যতগুলো টেক্সট পড়েছ ইংরেজি বিভাগে, তার মধ্য থেকে দুটো টেক্সটের নাম বলো - যেগুলো তোমাকে সাংঘাতিকভাবে নাড়া দিয়েছে।

আমি একটু ভেবে দুটো টেক্সটের নাম বললাম - এক, ডঃ ফাউস্টাস, এবং দুই হ্যামলেট।

স্যার বললেন - প্রথমটার উচ্চারণ ফস্টাস হবে না?

আমি বললাম, স্যার অনেক জায়গায়ই আমি ফস্টাস উচ্চারণটা শুনেছি, কিন্তু আমাদের সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার ক্লাসে পড়ানোর সময় এই নামটি উচ্চারণ করতেন ফাউস্টাস, স্যারের অনুকরণে আমিও এভাবেই উচ্চারণ করি।

পুনরায় সায়ীদ স্যারের পাশে বসা ভদ্রলোক বললেন - মনজুর ভাইয়ের ডিগ্রী ক্যানাডার না? এটা বোধহয় তবে ক্যানাডিয়ান উচ্চারণ।

স্যার বললেন - ব্যাখ্যা করো বলো দেখি , এদুটো টেক্সট তোমার পছন্দ কেন?

এমন প্রশ্নের উত্তরে আসলে কি বলা যায়? কালজয়ী এমন দুটো বই, যার ব্যাপারে আমার পছন্দের দিকগুলো বলতে গেলে প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার দু' দুটো বই লিখে ফেলা সম্ভব, সেটাকে সংক্ষেপে কি বলবো? যাক, ভেবে চিনতে বললাম যে সমস্ত কারণে ফাউস্তাস ভালো লেগেছে তার মধ্যে আছে ক্রিস্টোফার মারলো'র অসাধারণ শক্তিশালী ভাষার সৌকর্য, যার কারণে আরেক এলিজাবেথান নাট্যকার বেন জনসন দ্যা মাইটি লাইনস অফ মারলো নামের একটি ফ্রেইজের প্রচলন করেন, বিশেষ করে নাটকটির একদম শেষে ট্র্যাজিক হিরো বা এন্টিহিরো, আরাম আয়েশ, বিত্ত বৈভবের বদলে শয়তানের কাছে নিজের আত্মা বিক্রি করে দেয়া ডঃ ফাউস্তাসের শেষ সলিলোকি বা স্বগতোক্তিতে প্রাণে নাড়া দিয়ে যাওয়ার মত আফসোস, কান্না এবং হাহাকার - তার তুলনা আছে আর কোন ভাষার কোন সাহিত্যে? আর যুবরাজ হ্যামলেটের অস্তিত্ববাদী সংকটের সাথে নিজের মিল খুঁজে পাওয়াই হ্যামলেটের প্রতি আমাকে আকৃষ্ট করেছে, সংক্ষেপে জানালাম।

স্যার এরপর বললেন -ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র, বাংলা সাহিত্য তাহলে সেভাবে পড়া হয় নি তোমার?

আমি সহাস্যে উত্তর দিলাম - ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হতে পারি , তবে আমার ভিত্তি বাংলায়। একারনেই বাংলা সাহিত্যে লেখালিখি।

স্যার জানতে চাইলেন সম্প্রতি কি কি বই পড়েছি।

আমি জানালাম, ইউএপিতে প্রভাষকের চাকরীতে যোগ দেবার পরপরই আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর সদস্য হই এবং প্রায় প্রতিদিন অফিস শেষে লাইব্রেরীতে বসে বই পড়ি এবং নিজের লেখালিখি করি। বাসায় একাজ হয় না কারন মনসংযোগ নষ্ট করার মত জিনিসের আধিক্য। তো এই সূত্রে ব্যাগের ভেতরে তখনই উপস্থিত দুটো বই - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস জননী (হুমায়ুন আহমেদ জননীর মত একটি উপন্যাস লেখার হয়নি বলে সারাজীবন আক্ষেপ করে গেছেন) আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অর্ধেক জীবন, - এ দুটির নাম উল্লেখ করলাম। বললাম, তার আগে পড়েছি সৈয়দ শামসুল হক সাহেবের প্রেমের গল্প সংকলন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারের গল্প সংকলন - সুখদুঃখের গল্প এবং প্রবন্ধ সংকলন - অলস দিনের হাওয়া, সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেবে রচিত হিটলার (নিজের অজান্তে সৈয়দ নামধারী তিন সাহিত্যিক একসঙ্গে!) এবং বুদ্ধদেব বসুর ছেলেবেলার আত্মজৈবনিক - আমার ছেলেবেলা। এগুলো ছিল স্যারের লাইব্রেরী থেকে নিয়ে পড়া গত একমাসে পঠিত বই। স্যারকে জানালাম এ বছরের শুরু ছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সাহেবের খোয়াবনামা দিয়ে, এরপর খুব ব্যাপকভাবে শহিদুল জহির পাঠ শুরু করে একটানা তার সবগুলি প্রকাশিত- অপ্রকাশিত লেখা পাঠ সম্পন্ন করি। ক্রমাগত অদলবদল করে বর্তমানে পড়ে চলেছি পাঁচটি প্রবন্ধের বই একসঙ্গে - ডঃ আহমেদ শরীফ, আহমদ ছফা, ডঃ হুমায়ুন আজাদ এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াস - এ চারজনের পৃথক চারটি প্রবন্ধ সংকলন এবং বাঙ্গালীর জয় পরাজয় নামে ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারের প্রবন্ধ সংকলন। শাহাদুজ্জামান সাহেবের ক্রাচের কর্নেলও উল্লেখ করা দরকার ছিল - সম্প্রতি পড়ছি এমন বাংলা বইয়ের লিস্টিতে, কিন্তু মনে আসে নি সেই সময়।

স্যার বললেন - আধুনিক বাংলা সাহিত্যে আগ্রহ তোমার। বঙ্কিম বা রবীন্দ্রনাথ কিছু পড়েছ কি?

আমি স্বীকার করলাম যে - আমার বঙ্কিম পাঠ কলেজের বাংলা পাঠ্য বইয়ে মুদ্রিত কমলাকান্তের জবানবন্দীতে এসে ঠেকে গেছে, কিন্তু রবীন্দ্র সাহিত্যসম্ভার থেকে প্রায়ই কিছু না কিছু নেয়া হয়। তার সবগুলো ছোটগল্পের সমাহার - গল্পগুচ্ছ, বা ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষে যখন মাত্র ভর্তি হলাম, ক্লাস শুরু হয় নি - সে বিরতিতে আয়েশ করে উপন্যাস গোরায় নিমজ্জিত থাকা - শানিত যুক্তির তরবারিতে ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং ব্রাহ্মবাদের বাহাসে অপার বিস্ময়াভিভূত হওয়া, সঙ্গে সঙ্গে এও যুক্ত করে দিলাম যে - গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থটি সর্বদা আমার পড়ার টেবিলে থাকে, মনখারাপের মুহূর্তে তা উল্টে একটি বা দুটি কবিতা পড়া হয় প্রায়ই।

স্যারকে এটা জানাতে ভুলি নি যে - আমার রবীন্দ্রপঠনের সঙ্গী ছিল এবং আছে অনেকটা উষ্মা, ক্রোধ এবং বিরক্তির সংমিশ্রণ।

স্যার জিজ্ঞেস করলেন - কেন?

আমি বললাম আমার বাবার কথা। বললাম যে - আমার বাবা তার কর্ম জীবনের শুরুতে একজন সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন। আশির দশকের শুরুতে তার রচিত একাধিক টিভি নাটক বিটিভিতে প্রদর্শিত হয়। কিন্তু হঠাৎ তাকে রবীন্দ্রনাথের ভুত পেয়ে বসে। তিনি লেখালিখি থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে হয়ে যান খাঁটি রবীন্দ্র পূজারী। রবীন্দ্রনাথের গানের ইতিহাস, তার সাহিত্য ও জীবন নিয়ে রচিত যতগুলো সমালোচনা গ্রন্থ আছে, তার অধিকাংশই সংগ্রহ করে তিনি তাতে নিমজ্জিত হন। আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর প্রায়ই আমার কাছে এসে বলতেন রবীন্দ্র গবেষক হতে। আমি বুঝতাম বাবার এ আহ্বান আবেগতাড়িত হলেও রবীন্দ্র গবেষকের তকমাটির বেশ প্রায়োগিক তাৎপর্য আছে, একটু বয়স্ক হলেই বেশ হোমরাচোমরা ব্যাক্তিদের মধ্যে বসে রবীন্দ্র সংশ্লিষ্ট সেমিনারের সভাধিপতির আসন অলঙ্কৃত করা যাবে - কিন্তু লোভে পড়ে কে ই বা সাহিত্যচর্চা করতে আসে। স্যারকে এ ঘটনা জানিয়ে বললাম আমার বাবার সৃষ্টিশীল ক্যারিয়ার ধ্বংসের পেছনে, বা ওনার উনি হয়ে ওঠার পেছনে সবচে বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, তাই আমার অনেকটা ক্রোধের বশবর্তী হয়েই রবীন্দ্রনাথ পূজা করা হয়ে ওঠে নি।

স্যার তার পাশের সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বললেন - বাঙ্গালীর এই এক সমস্যা। রবীন্দ্রনাথকে একদম উপাসনার স্থলে নিয়ে বসিয়েছে। এরপর আমার দিকে ফিরে বললেন - ২৫ বছর বয়সেই আমি রবীন্দ্র উপাসকগোষ্ঠীদের তুমুল সমালোচনা করে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম, বুঝলে। স্যারের এ কথায় আমি বেশ আত্মশ্লাঘা বোধ করলাম, কারন যদিও রবীন্দ্র উপাসকদের সমালোচনা করে আমার এখনও তেমন কোন লেখা কোথাও প্রকাশিত হয় নি, তবুও আমার বয়স এখন পঁচিশ এবং স্যারের বয়সও ঠিক যখন পঁচিশ অর্থাৎ ঠিক একই বয়সে এসে আমরা দুজনেই সাহিত্যপ্রেমী বাঙ্গালী মানসের একটি অভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করতে পেরেছিলাম।

এমন সময় স্যার খানিকটা নীরব হয়ে যান এবং আমি ভয় পেয়ে যাই, পাছে সাক্ষাৎকার এখনই শেষ না হয়ে যায়। কারন কথা সবেমাত্র জমে উঠছিল। ফলে সাহস করে আমি নিজেই একটি প্রসঙ্গের অবতারণ করলাম। জানালাম যে আলোর ইশকুলের চতুর্থ ব্যাচের সাথে ভর্তি হবার আবেদন ফর্ম জমা দিলেও, আমি আলোর ইশকুলের প্রথম ব্যাচেরই ছাত্র ছিলাম ২০১৩ সালে, কিন্তু ডিপার্টমেন্টের পড়ার চাপে তখন তা ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ ডিঙ্গনোর পর এসে মনে হচ্ছে যে আমি আসল জ্ঞান আহরণের জন্যে উপযুক্ত হয়েছি, তাই পুনরায় ভর্তির দরখাস্ত করেছি। আমার এ কথা শুনে স্যার বিশেষ প্রীত হয়েছেন বলে মনে হল না। বারবার আমাকে প্রশ্ন করতে থাকলেন - কেন ছেড়ে গিয়েছিলাম তিন বছর আগে। বললেন - আঠার বছর বয়সে আমার যে গ্রহণ (পারসিভ) করার ক্ষমতা ছিল (যদিও প্রকৃতপক্ষে তখন আমার বয়স প্রায় তেইশ), তার সাথে আমার পঁচিশ বছর বয়সের গ্রহণ করার ক্ষমতার পার্থক্য আকাশ পাতাল। হায় কপাল! ভেবেছিলাম - ভার্সিটি শেষ করে এখন প্রকৃত অর্থে জ্ঞানের অন্বেষণে বেরিয়েছি শুনে স্যার খুশী হবেন, পীঠ চাপড়েও হয়তো দেবেন মন ভালো থাকলে, কিন্তু খালি কথার বাগাড়ম্বরে গলবার মানুষ যে তিনি নন! এরপর কাঁচুমাচু গলায় ব্যাখ্যা দেয়া শুরু করলাম যে আমাদের কলা অনুষদে আর ইয়ারলি সিস্টেম নেই। খোদ বারাক ওবামার দেশ হতে আমদানি করে আনা সেমিস্টার সিস্টেমের জাঁতাকলে সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীদের নাভিশ্বাস ওঠার যোগার। তবুও স্যার আক্ষেপের সুরে বলতে থাকলেন - কি আর অমন হত দৈনিক আধা কিংবা একঘণ্টা সময় ব্যয় করলে?

আমি মুখফসকে বলে ফেললাম - আমার আজীবনের সাধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা। রেজাল্ট ধরে রাখার পাকেচক্রে যে আর একটা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাতে সময় দেব, আমার পক্ষে তা আসলেই সম্ভবপর ছিল না।

স্যার বললেন - পড়াবে পড়িও, কিন্তু ড্যাম খেয়ে যেয়ো না।

বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত স্যার এই উক্তি শোনার পর আমার ঠিক কি বলা উচিৎ তা যখন ঠাহর করে উঠতে পারছি না তখন স্যার আরও বললেন যে তাদের সময়ে কমপক্ষে ১৫ জন শিক্ষক ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদের একনামে দেশ ও দেশের বাইরে সবাই চিনত। সে সময় এত মিডিয়া কাভারেজ ছিল না, সবাই পরিচিত হয়েছিলেন নিজনিজ কর্মগুণে। আর এখন তো যাকে যত বেশী টিভিতে দেখা যায় সে তত বেশী বিখ্যাত।

আমি স্যারকে বললাম যে স্যার ঢাবিতে এখন যে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে-হচ্ছে আমি সে ব্যাপারে পুরোপুরি সচেতন এবং সে বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতা পুরনের আকাঙ্খা আমার মনে সদা জাগরূক।

স্যার বললেন - এই কারনেই তার এই আলোর ইশকুল স্থাপন, যাতে অল্টারনেটিভ স্কুলিং জাতির এ মেধাশুন্যতা পূরণ করতে পারে এমন অনেকগুলি মানুষের জন্ম দেয়।

আমি আলপটকা বলে বসলাম - কিন্তু স্যার এই কার্যক্রম থেকে এরকম মেধাবী কারও উত্থানের জন্যে ইনপুট তথা গৃহীত সদস্যদের মান একটি বড় ফ্যাক্টর নয় কি? স্যার আমার প্রশ্নটি প্রসন্নভাবে গ্রহণ করলেন না। বললেন - শুধুমাত্র ইনপুটের ওপর নির্ভর হবে কেন? এখানে নিজস্ব চিন্তা চেতনা নিয়ে স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠার জন্যে যে লিবারেল পরিবেশ দেয়া হয় সভ্যদের সেটারও একটি অনস্বীকার্য প্রভাব আছে।

আগের সূত্র ধরেই বললাম - স্যার, ২০১৩ সালে আলোর ইশকুলের ছাত্রত্ত না ধরে রাখতে পারার আর একটি কারন হচ্ছে শিল্প সাহিত্যে আমার অনেক ছড়ানো ছিটানো বিস্তৃত ইন্টারেস্টের জায়গা। আমার সঙ্গীত সংশ্লিষ্টতার কথা স্যারকে জানিয়ে সিনেমা বানানো নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করতে যাবো এমন সময় স্যার আমাকে থামিয়ে দিয়ে উর্দু একটি শে'র পড়লেন, যার বাংলা অর্থ এই দাঁড়ায় - বেরিয়েছিলাম পৃথিবীর সমস্ত বাগান ঘুরে দেখতে, কিন্তু হায়, একটি গোলাপের পাশেই সারাটি জীবন অতিবাহিত হয়ে গেল!

একটু থেমে বললেন - ছড়িয়ে পড়ো না, গভীরে যাও। যা কিছু করবে অনেক গভীরে করবে। তাড়াহুড়ো করার কোন প্রয়োজন নেই। একটা মাধ্যমকে ধরে ক্রমাগত খোঁদাই করতে থাকো, যখন একদম গভীরে পৌঁছে যাবে তখন সেটাকে কেন্দ্র করে যা কিছু করা যায় - করবে। বললেন - এই আমাকে দেখো। আমি হচ্ছি কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার শেষ এক প্রতিভূ। ছড়িয়ে পড়া আমাদের স্বভাবে নেই। লিখতে লিখতে জীবন শুরু করেছিলাম, পরে টিভিতে উপস্থাপক হিসেবে নাম কুড়লাম। কিন্তু যেদিন বুঝলাম, মানুষ গড়ার কাজ করতে হবে, সেদিন থেকে শিক্ষকতা, টেলিভিশনে শস্তা খ্যাতির মোহ ছেড়ে লেগে গেলাম এই বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্র নিয়ে। উদ্দেশ্য একটাই। বাংলার মানুষকে বই পড়াতে হবে। নিজে থেকে বই পড়তে চায় না, আমি বাসায় গিয়ে বই পৌঁছে দিয়ে আসা শুরু করলাম ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরীর মাধ্যমে।

একটু থেমে স্যার বললেন - একই সাথে সাহিত্যে ডিগ্রী নেবে আবার ইঞ্জিনিয়ারিং ও পড়বে - সে কি করে সম্ভব? আমি বেফাঁস বলে বসলাম - কিন্তু স্যার সাহিত্য আর ইঞ্জিনিয়ারিং তো ইন্টার রিলেটেড না! স্যার বললেন - আহা! আছে রিলেশন! এরপর স্যার নিজের জীবন থেকে উদাহরণ দিলেন। বললেন - তার বাবা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু তিনি সাহিত্যেও অগাধ জ্ঞান রাখতেন। স্যার সাহিত্যের ছাত্র হয়ে কেন বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি জানবেন না- সেটা নিয়ে স্যারের বাবা অনুযোগ করতেন।

আমি বিপদে। অ্যাকাডেমিয়া, সাহিত্য আর সঙ্গীত - বাহ্যিকভাবে এ তিন নিয়েই আমার অস্তিত্ব। এর একটিও যদি বাদ দেই, তবে আমি তো আর আমি থাকবো না। স্যার তো আমাকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দিলেন! আমি মরিয়া হয়ে বললাম - কিন্তু স্যার সত্যজিৎ রায় তো পেরেছেন।

স্যার বললেন - সত্যজিৎ রায় একজন অসাধারণ মেধাবী মানুষ ছিলেন। তার বংশ পরম্পরাও তাকে অগাধ সাহায্য করেছে। বললেন - রবীন্দ্রনাথ যদি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে না জন্মে আসামের জঙ্গলে জন্মাতেন, তবে আমরা এ রবীন্দ্রনাথকে পেতাম না।

সত্যি বলতে কি - স্যারের এ কথায় আমি বেশ কষ্ট পেলাম। কারন সারাজীবন আমি যাকেই শিল্প সাহিত্য নিয়ে আমার বহুমুখী স্পৃহার কথা বলেছি এবং প্রত্যুত্তরে শুনেছি - সম্ভব নয়, সঙ্গে সঙ্গে দিয়েছি সত্যজিৎ রায় বা হুমায়ুন আহমেদের উদাহরণ। তখন সবাই মুখস্ত বুলির মত বলতো এই দুইজনেই ক্ষণজন্মা পুরুষ, তাদের মত আর কারও হওয়া সম্ভব নয়। আমার প্রচণ্ড জেদ হত। আমার প্রতিভা কতটুকু - তার ব্যাপারে তারা কতটুকু জানে? আমি নিজেই কি সম্পূর্ণ জানি? কে ই বা জানতে পারে? অন্তরের খুব গভীর থেকে প্রতিনিয়ত যে তাড়না আমি অনুভব করে নূতন কিছু সৃষ্টি করবার, তা থেকে বলতে পারি - ভবিষ্যতের কথা জানি না, তবে প্রতিভার বিচারে আমি নিজেকে কখনো হুমায়ুন আহমেদ বা সত্যজিৎ রায়ের চে' খাটো করে দেখিনি। শুনলে পাগলের প্রলাপ লাগতে পারে - কিন্তু পরিণত বয়সের বা শেষ বয়সের হুমায়ুন- সত্যজিতের সাথে আমাকে তুলনা না করে পঁচিশ বছর বয়সে এই দুই মহান ব্যক্তির সাথে আমার পঁচিশ বছর - অর্থাৎ বর্তমান সময় পর্যন্ত যে সৃষ্টিশীলতার জীবন - সেটা মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে আমার এই আত্মবিশ্বাসের উৎস কোথায়।

যাক, আমি বুঝে উঠতে পেরেছিলাম যে এটা স্যারের সাথে আমার মুক্ত আলোচনার কোন ক্ষেত্র নয়, স্যারের ব্যক্তিগত পাঠচক্রে সদস্য রিক্রুট করার ইন্টারভিউ, এবং আমার পর আরও ডজনখানেক স্যারের সাক্ষাৎপ্রার্থী বসে আছে অপেক্ষায়। কাজেই স্যারের মুখ থেকে - 'চলে যাও' শোনার বদলে নিজ থেকেই আলোচনা সমাপ্তির দিকে নিয়ে যাওয়াটা স্যারের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎকে সারাজীবন স্মরণীয় করে রাখবে। তাই আর নিজ থেকে কোন প্রসঙ্গ উত্থাপন না করে ভাবলাম - স্যারের সাথে দেখা হলে স্যারকে আন্তরিকভাবে একটা ধন্যবাদ দেব ঠিক করে রেখেছিলাম বহুআগে। এই ফাঁকে সে কাজ সেরে ফেলি।

স্যারকে বললাম - স্যার আমার বয়স যখন মাত্র ১১ সেই তখন, ২০০১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর আপনি প্রথমবারের মত ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরীতে গাড়ি ভর্তি করে আমার জন্যে বই পাঠান। আমি তখন সদ্য নিজের পড়ার নেশা গড়ে তুলছি। ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরীর প্রথম দিনেই সদস্য হয়েছিলাম আমি। এখন লাইব্রেরীর সদস্য সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে, আমার লাইব্রেরীর সদস্য নম্বর ছিল মাত্র ৪১। সেই ২০০১ সাল থেকে নিয়ে ২০১৫ সাল - এই ১৪ বছরে প্রতি সপ্তাহে গড়ে অন্তত একটি করে বই আমার পড়া হয়েছে আপনার লাইব্রেরী থেকে নিয়ে। চোখ ফুটে যখন জগত সংসার চিনতে শুরু করেছি ঠিক তখন আপনি বইয়ের আস্ত এক ভাণ্ডার আমার হাতে তুলে দিয়ে আমার মনের চোখ খুলে দেবার বন্দোবস্ত করে রেখেছিলেন অনেক দূরে বসে। শুধু আমি না, আমার মত এরকম হাজারো তরুণের তরফ থেকে আমি আপনাকে ধন্যবাদ দিতে চাই।

স্যারের পাশে বসা ভদ্রলোক বললেন - স্যার, এতো দেখছি আপনার অনেক পুরনো ভক্ত!

আমি পুনরায় বলে চললাম - স্যার পরিণত বয়সে এসেছি কিছু শিখতে। আশা করি এই সুযোগটুকু আপনি আমাকে দেবেন।

(কথাগুলো শুনতে অনেকটাই অবাস্তব এবং নাটকীয় লাগতে পারে। মনে হতে পারে যে এই ধরনের কোন কথাই আমি বলি নি। সত্য কথা হচ্ছে - এতটা গুছিয়ে কাব্যিক ভাষা ব্যাবহার হয়তো করতে পারি নি, লেখার সময় কিছুটা গুছিয়ে লিখতেই হয়, কিন্তু হুবহু এই কথোপকথনই হয়েছে আমার ও স্যারের মাঝে। তদুপরি - আমি সাংঘাতিক গুরু শিষ্য ট্র্যাডিশনে বিশ্বাসী। কারোই অন্ধ অনুকরণ করি না, যত বড় জ্ঞানী মানুষই কেউ হোক না কেন, কিন্তু যাদের প্রজ্ঞার ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ, তাদের কাছ থেকে আমি আমাদের সময়, ইতিহাস, দর্শন, সংস্কৃতি, চিন্তা- চেতনা সম্পর্কে ফার্স্ট হ্যান্ড জ্ঞান নেয়ার চেষ্টা করি।)

স্যার মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন - আমার বই পড়েছ কিছু?

আমি বিপদে পড়ে গেলাম। স্যারের কোন বইই আমার পড়া নেই। আমি মূলত সাহিত্য অনুরাগী, সাহিত্যের বইপত্রই পড়া হয়। স্যারের কিছু সাক্ষাৎকার এবং প্রবন্ধ পড়েছিলাম বিবিধ ম্যাগাজিনে। স্যারকে সে কথা জানালাম। স্যারের পাশে বসা ভদ্রলোক বললেন -আমাদের স্যারের সব বই আমাদের বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের লাইব্রেরীতে পাওয়া যায়... ভদ্রলোক এই পর্যন্ত বলতেই স্যার তাকে হাত দিয়ে ইশারা করে থামিয়ে দিলেন। বললেন - এই উদ্দেশ্যে উনি আমাকে এই প্রশ্ন করেন নি। স্যারের উদ্দেশ্য যাই হোক এ প্রশ্নটি করার, আমি লজ্জা পেলাম ঠিকই। ভালো পাঠক আমি নই একেবারেই। সায়ীদ স্যারের অন্তত কিছু বই তো আমার পড়া অবশ্যকর্তব্য ছিল। আবার নিজেকে ঠিক সেভাবে দোষও দিতে পারছিলাম না , কারন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ আমাদের মাঝে বিখ্যাত একজন অসাধারণ বক্তা, সংগঠক এবং উপস্থাপক হিসেবে। স্যারের হোক বা আমাদের - দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওনার লেখা বই পুস্তক অতটা ব্যাপকভাবে আমাদের জেনারেশনের মাঝে পৌঁছায় নি। অন্তত আমি কোন সাহিত্য চক্রের আড্ডায় স্যারের সাহিত্যকর্মের আলোচনা সমালোচনা শুনিনি।

আমি বেশ বড় গলা করে বললাম - স্যার ইউটিউবে আপনার যে কয়টি লেকচার পাওয়া যায় তার সবই আমি শুনেছি। স্যার প্রসন্ন চিত্তে মাথা দুলিয়ে বললেন - হ্যাঁ, ইউটিউবে আজকাল ছেলেপেলেরা বেশ কথা শোনে। জানালেন যে - উনি উনার বক্তৃতার আরও পঞ্চাশটি ভিডিও প্রস্তুত করছেন ইউটিউবে আপলোড করার জন্যে।

বললাম - স্যার, যে পাঠচক্র আপনি সঞ্চালনা করবেন, তার প্রতি পর্বের পড়াশোনা ঠিকঠাক মত সম্পন্ন করতে প্রয়োজনবোধে আমি আলোর ইশকুলের বাকি বিভাগের ক্লাসগুলো ছেড়ে দেব। স্যার শুনে একদম হা হা করে উঠলেন। বললেন - অন্য কোন বিভাগের একটা ক্লাসও গ্যাপ দেয়া যাবে না। স্যারের পাশের সঙ্গী ভদ্রলোক বললেন - গত একবছরে কেন্দ্রের তরফ থেকে ২৬০ (অথবা ৩৬০) টি বক্তৃতার আয়োজন করা হয়েছিল দেশবরেণ্য জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের দিয়ে। স্যার ২৬০টি লেকচার পুরোটা বসে শুনেছেন, এবং নিজের খাতায় নোট নিয়েছেন। স্যার এরপর নিজে যোগ করলন - তার বয়স হয়েছে, স্মৃতি মাঝে মাঝেই ভ্রমের সৃষ্টি করে। তাই তিনি প্রতিদিন সেই নোটখাতাগুলো পুনরায় রিডিং পড়েন আদ্যোপান্ত।

আমি শুনে একদম অবাক! স্যার যাদের লেকচারার হিসেবে নাম বললেন - তারা অধিকাংশই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কিন্তু বয়সে স্যারের তুলনায় অনেক ছোট।

আমি প্রশ্ন করলাম - স্যার, যারা বক্তৃতা দেয়, তারা তো সবাই আপনার তুলনা বয়সে এবং প্রজ্ঞায় ছোট। আপনি তাদের কাছ কিই বা পাবেন যে তাদের বক্তৃতা এত মনোযোগ দিয়ে শোনেন? বরং এই সময়টুকু আপনার দরকারি বইপত্র পড়ে কাটালে ভালো হোতো না? স্যার এ প্রশ্নের উত্তরে যা বললেন - তা সবার জন্যেই অত্যন্ত জরুরি।

স্যার বললেন - মনে রেখো, ছাপার হরফে যা দেখো, তা পরিশীলিত জ্ঞান। ফিলটারড। অনেক কিছু বলা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার পুস্তকের থিসিসের বিপরীতে যায় - এমন সব কথাই বইয়ের লেখক খুব যত্নের সাথে বাদ দিয়ে দেয়। কিন্তু একজন মানুষ বক্তৃতা করে তার সমস্ত জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে, অর্জিত সমস্ত জ্ঞান একটির সাথে আরেকটিকে রিলেট করে। একজন জ্ঞানী মানুষের বক্তৃতা থেকে তুমি গ্রহণ করতে পারবে যেকোনো বইয়ের তুলনায় অনেক বেশী।

স্যার বিদায় বলবার আগে আমি পুনরায় কাঁচুমাচু স্বরে বললাম - স্যার আপনার জন্যে আমার নিজের দুটি বই নিয়ে এসেছি। স্যার আগ্রহের সাথে আমার বইদুটো দেখতে চাইলেন। আমি স্যারের হাতে তুলে দিলাম ২০১৪ সালে আমার প্রকাশিত প্রথম গল্পের বই - 'শেষ বসন্তের গল্প' এবং ২০১৬র বইমেলায় প্রকাশিত আমার শেষ গল্পের বই - ' আয়াজ আলীর ডানা'। স্যার বইদুটি হাতে নিয়েই আদ্যোপান্ত উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে বললেন - বলেছিলেনা একটা বই অনুবাদ করেছো - প্যাত্রিক মোদিয়ানোর? ঐ অনুবাদটাও আমার জন্যে নিয়ে এসো। শুনে আমি যারপরনাই খুশী হলাম। তার মানে - আমি যে বলেছি আমার এখন পর্যন্ত তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে - স্যার একথাটা ঠিকমতই শুনেছেন এবং মনে রেখেছেন।

পরবর্তী সাক্ষাতের সময়ই আমি স্যারের জন্যে বইটি নিয়ে আসবো বলে বিদায় নিয়ে সাক্ষাৎকার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসি।

স্যারের সাথে কথা বার্তা বলার শেষে আমার মাথায় কিছু প্রশ্ন ঘুরছিল। সেগুলোর উত্তর আমি খুঁজে চলেছি বিগত এক সপ্তাহ ধরে। যেমন - সারা জীবন বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করার জন্যে পরিশ্রম করলেন যে মানুষটি, তার কাছে গিয়ে আমি আমার বই পড়ার অভ্যেস নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই কেন তিনি বলে উঠলেন - অ্যাকটিভিজমই সব? অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের অ্যাক্টিভিজম কোনটি? এটা কি আমারও অ্যাক্টিভিজমের পথ হবে? স্যার কি উনার মত- পথ আমার উপর জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইবেন এখানে? কথায় কথায় প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ হয় যে লোকটির তার ছাত্ররা আজ কে কোথায়? সমাজ ও দেশের পরিবর্তনে, সমাজ ও দেশের সেবা করতে তারা কতটুকু প্রস্তুত? আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সাথে আমার কথোপকথনের আফটারম্যাথ নিয়ে আলাদা একটা লেখা লিখবো কোন দিন। আজ এ পর্যন্তই।

২৩ মে, ২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১১:০০
১১টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×