ডারউইন যখন শিশু, তখন পুরো ইউরোপ জুড়ে বৈজ্ঞানিক ও খ্রিস্টীয় যৌথ মতবাদ ছিল এই যে - অ্যাডাম অ্যান্ড ইভের পৃথিবীতে আগমন থেকে শুরু করে নোয়ার মহাপ্লাবন হয়ে তৎকালীন পৃথিবীর বয়স ছয় হাজার বছরের বেশী না। অথচ আজ আমরা জানি যে, পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর। সে কৃতিত্ব বহুলাংশে, ডারউইনেরই।
তরুণ ডারউইন দক্ষিণ অ্যামেরিকার গ্যালাপ্যাগোস আইল্যান্ডে গিয়ে ন্যাচারাল ফ্লোরা অ্যান্ড ফনা, তথা পশুপাখি ও গাছপালা নিয়ে যে জীববৈচিত্র্য - তা নিয়ে গবেষণা করেন। ডারউইনের সবচে বিখ্যাত বই অরিজিন অফ দা স্পিসিস ১৮৫৯ সালে ইংল্যান্ডে প্রকাশিত হয়। প্রকৃতিতত্ত্ববিদ হিসেবে ডারউইন দক্ষিণ অ্যামেরিকা এবং প্রশান্ত মহাসাগরের বহু স্থানে ঘুরে বেড়িয়ে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেন, এবং সেই সঞ্চিত তথ্য - উপাত্ত ও গবেষণার মাধ্যমে যুক্তি দিয়ে আলোচনা করে বোঝালেন - কীরকম করে স্বাভাবিক অবস্থা নির্বাচনের ভেতর দিয়ে প্রত্যেক জাতের জীবজন্তু বদলে বদলে পরিণত রূপ ধারণ করেছে। ১৮৭১ সালে তাঁর প্রকাশিত "দা ডেসেন্ট অফ ম্যান" বইয়ে তিনি মানুষ ও অন্যান্য বিবিধ প্রাণীর মধ্যে মিল দেখিয়ে এই তত্ত্বের জন্ম দেন যে - মানুষ, এবং অ্যানথ্রপয়েড এইপস/ বানর/ শিম্পাঞ্জীর বিবিধ গোত্র সম্ভবত একই প্রজাতির জিন থেকে বিবর্তিত হয়ে এসেছে। ডারউইনের তত্ত্ব চার্চের কট্টর সমালোচনার মুখে পড়ে, কিন্তু ডারউইনের সৌভাগ্য, ততদিনে ইউরোপিয়ান এম্পায়ারগুলি চার্চের প্রভাব থেকে অনেকাংশেই বের হয়ে এসেছে। নইলে, ষোড়শ, এমনকি সপ্তদশ শতকের ইউরোপ হলেও ডারউইনকে চার্চের ইনকুইজেশনের সম্মুখীন হতে হত।
তবে, বিবর্তনবাদের সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য, বলা মুশকিল, বিবর্তনবাদকে নিজেদের রাজনৈতিক মতাদর্শ চরিতার্থ করবার জন্যে পলিটিকাল এজেন্ডা হিসেবে গ্রহণ করে যারা , তারা মহামান্য হিটলারের নাজি বাহিনী।
বিবর্তনবাদী/বিবর্তনমুখী মানবতাবাদে বিশ্বাসীদের মানুষের সংজ্ঞা ঘোরতরভাবে ডারউইনের বিবর্তনবাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত। নাজিরা বিশ্বাস করতো যে, হোমো স্যাপিয়েন্স 'মানুষ' - এর বৈশিষ্ট্যও এভালিউশনের বশবর্তী হয়ে কালে কালে বদলায়। আর এই বদল মানবজাতিকে উন্নতির দিকেও নিয়ে যেতে পারে, নিয়ে যেতে পারে অবনতির দিকেও।
নাজিদের প্রধান আগ্রহ ছিল মানবজাতির চরিত্রকে কলুষিত না করে, তাঁদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যকে অবনতির দিকে না নিয়ে গিয়ে একটা "প্রগ্রেসিভ এভলিউশনের" দিকে ধাবিত করা। এই সূত্র ধরেই তারা যুক্তি দাঁড়া করিয়েছিল যে, জর্মন অ্যারিয়েন / আর্যজাতির জেনেটিক বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে হবে। এবং সেজন্যে নিম্নশ্রেণীর মানুষ যারা আছে - ইহুদী, সমকামী, পাগল - এদের কোয়ারেন্টাইনড করে রাখতে হবে, সম্ভব হলে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে অস্কার জেতা দা পিয়ানিস্ট মুভিটি দেখে থাকলে প্রুশিয়ার ইহুদী ঘেঁটোগুলোর বা ইহুদী পার্সিকিউশনের ব্যাপারে আপনাদের ধারণা থাকার কথা।
নাজি'রা বিবর্তনবাদীদের সঙ্গেই কণ্ঠ মিলিয়ে বলতো - হোমো স্যাপিয়েন্স নামে একটি প্রজাতি প্রকৃতির ন্যাচারাল সিলেকশনের মাধ্যমে , সবচে ফিটেস্ট কন্টেস্টান্ট হিসেবে বের হয়ে এসেছে, হোমো নিয়েন্ডারথেলস, হোমো ইরেকটাস, অথবা হোমো সলেনসিসসহ 'হোমো' জিন বিশিষ্ট ভিন্ন ভিন্ন স্পিসিসকে পিছে ফেলে। কিন্তু, নাজিদের মতে, বিংশ শতাব্দীতে এসেও মানুষ, বা হোমো স্যাপিয়েন্সের জেনেটিক মিউটেশন শেষ হয় নি। বিবর্তন এখনো চলছে। পৃথিবীতে বিদ্যমান বিভিন্ন বর্ণ, গোত্র - এবং তাঁদের মধ্যে বিদ্যমান হানাহানিই তো তাঁর উৎকৃষ্ট প্রমাণ। অতঃপর, নাজি'রা ইউরোপের রাজনীতির ময়দানে নামলেন এক "মহান" বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্য সাধন করতে, প্রকৃতির হয়ে ন্যাচারাল সিলেকশনের কাজটি করে দিতে। বর্ণে বর্ণে, গোত্রে গোত্রে বিদ্যমান নিচুজাতের মানুষের বিভেদ ও হানাহানিকে একেবারে, এবং চিরতরে শেষ করে দিতে, একটি মাত্র মহান যুদ্ধের দ্বারা। আমরা একে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামে চিনি।
ইতোমধ্যে বৈজ্ঞানিকরা নাজিদের সমর্থন ল্যাবে জড়ো করলেন প্রমাণের পাহাড়। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হল যে র্যাশনালিজম বা যুক্তিবাদ, শারীরিক সৌন্দর্য, ইন্টিগ্রিটি বা আত্মমর্যাদায় - সবচে অগ্রসর জাতি হচ্ছে জর্মন আর্যজাতি। পৃথিবীর সকল ইহুদী, নিগ্রো, সমকামী , এবং মানসিক ভারসাম্যহীনেরা বর্তমান পৃথিবীর হোমো নিয়েন্ডারথ্যালস। আর্যজাতির যেখানে সম্ভাবনা আছে মানুষকে সুপারম্যান বা অতিমানবীয় গুণাবলীতে গুণান্বিত করার - ইহুদী, নিগ্রো আর সমকামীরা আর্যজাতির সঙ্গে জিন মিক্স হয়ে গেলে আর্যজাতির সেই অপার সম্ভাবনা বিঘ্নিত হবে। অর্থাৎ, মানবতা, ইন জেনারেল, ঘোরতর বিপদের সম্মুখীন। পৃথিবী তাকিয়ে আছে , বিজ্ঞান তাকিয়ে আছে মানবতার রক্ষাকারী মহাপ্রভু হিটলারের দিকে।
১৯৩৩ সালের প্রেক্ষিতে পাশ্চাত্য বিশ্বের সেরা সব ইউনিভার্সিটির ল্যাবে বসে জীববিজ্ঞানীরা - নাজিদের এই থিওরিকে বৈজ্ঞানিক সত্য বলে ঘোষণা দিলেন। পেপারের পর পেপার পাবলিশ করে তারা প্রমাণ দেখালেন যে - শ্বেতাঙ্গরা আফ্রিকান, ইন্ডিয়ান, এবং আরব ইহুদীদের থেকে শ্রেষ্ঠতর। নাজিদের পলেটিকাল যজ্ঞের হোমঅগ্নিতে ঘৃত ঢাললেন তাবৎ বড়বড় জীববিজ্ঞানী, এবং সমাজবিজ্ঞানীরা।
ইউরোপে ইহুদীদের বিরুদ্ধে নাজিদের প্রোপ্যাগান্ডা মুভি, পোস্টারে শহরের পর শহর ছেয়ে গেল।
১৯৪২ সালের স্কুল পর্যায়ে শিশুদের জন্যে লেখা একটি টেক্সট বুকের অংশ সরাসরি তুলে দিচ্ছি, যার শিরোনাম ছিল দা ল'জ অফ নেচার অ্যান্ড ম্যানকাইন্ড (প্রকৃতির নিয়ম ও মানুষ) -
" প্রকৃতির সবচে চরম নিয়ম হল এই যে - প্রতিটি জীবন্ত সত্ত্বা নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে প্রতিনিয়ত সংগ্রামে লিপ্ত। এই যুদ্ধ নির্মম, ক্ষমাহীন। দয়া দেখানোর কোন সুযোগ এতে নেই। কিন্তু এই ন্যাচারাল সিলেকশনের নিয়মকে আমাদের ভালবাসতেই হবে, কারণ প্রকৃতিতে টিকে থাকার এই একমাত্র পথ। এই যুদ্ধে শুধু তারাই টিকে থাকে যারা যোগ্যতর। বাকিরা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে। জীববিজ্ঞান আমাদের শেখায় এই নিয়ম কেবল গাছপালা, এবং পশুপাখির ক্ষেত্রে নয়, বরং আমাদের, তথা মানুষদের জন্যেও প্রযোজ্য। বিজ্ঞানের এ নীতি আমাদের ইস্পাতসদৃশ প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ করে প্রকৃতির এ নিয়মকে শ্রদ্ধা দেখিয়ে টিকে থাকার এবং এই নিয়মকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। জীবনের অর্থই সংগ্রাম। তাঁদের প্রতি করুণা, যারা প্রকৃতির এই অমোঘ নিয়মের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মত পাপ করে।"
বিবর্তনবাদকে কাজে লাগিয়ে অবোধ শিশুদের মধ্যেও "নিচুশ্রেণীর" মানুষ, তথা লেসার হিউম্যান বিয়িং, তথা ইহুদী - নিগ্রো - সমকামীদের খুন করাকে জাস্টিফাই এই সম্পূর্ণ টেক্সট বইটির সঙ্গে প্রায় লাইন বাই লাইন পাই জার্মানিতে ১৯২৫ সালে প্রকাশিত আর একটি বিখ্যাত বইয়ের সঙ্গে, যা প্রায় অর্ধ শতক ব্যান হয়ে থাকার পর সম্প্রতি আবার সুলভ ভার্শনে ঢাকা শহরের নিউমার্কেট, আজিজ, বা শাহবাগের মোড়ে পাওয়া যাচ্ছে।
সেই বইয়েও লেখা আছে -
"যে মানুষ ন্যাচারাল সিলেকশনের এই আয়রন লজিকের বিরুদ্ধাচরণ করে, সে যেন সে অমোঘ নিয়মের বিরুদ্ধেই দাঁড়ায় - যে নিয়মের উসিলায় বিবর্তিত হয়ে হয়ে সে আজকের সত্ত্বায় পরিণত হয়েছে। তাঁর জেনে রাখা উচিৎ, বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে যে দাঁড়াবে, তাঁর পরিণতি ধ্বংস, এবং কেবলই ধ্বংস হওয়া।"
বলুন তো বইটি কার লেখা? বইটির নাম কি?
এছাড়াও চিন্তার কারখানায় চিন্তা করবার জন্যে আজকের কিছু প্রশ্ন -
১। বাংলাদেশী ব্লগে যারা বিবর্তনবাদের সমর্থক, তারা কি হিটলারের চেয়ে বড় বিবর্তনবাদী? অর্থাৎ বিবর্তনবাদকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে হিটলার যেরকম ঝাড়ে বংশে উধাও হয়ে গেছেন - তারা কি বিবর্তনবাদকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে এতটুকু আত্মত্যাগ স্বীকার করতে পারবেন?
২। বাংলাদেশী ব্লগে যারা বিবর্তনবাদকে প্রাসঙ্গিক করে তোলার চেষ্টা করেন, তারা কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে বৈজ্ঞানিকভাবে জায়েজ করবার জন্যে হিটলারের এভলিউশনারি হিউম্যানিজম, তথা বিবর্তনবাদকে ব্যবহার করেছিলেন - এই ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাপারে ওয়াকেফহাল?
৩। যদি তারা বিবর্তনবাদকে কতটা বিপদজনকভাবে পলিটিক্যালি ইউজ কর সম্ভব, সে ব্যাপারে অবগত হয়ে থাকেন, এসমস্ত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বিপদজনক/ রেসিজম উস্কে দেয়া ব্যাবহারের ব্যাপারে সতর্কতামূলক কথাবার্তা তাঁদের মুখে কি বড় একটা শোনা যায়?
৪। বিবর্তনবাদী তত্ত্বের উপর ভর করে ২০২০ সালের পৃথিবীতে অন্য কোন রেসিজম চর্চা করা হচ্ছে, যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে আজকেও মানুষ পথে ঘাটে লড়াই করছে, প্রাণ দিচ্ছে?
বি। দ্রঃ মনে রাখতে হবে যে, চিন্তার কারখানার উদ্দেশ্য চিন্তাশীল মানুষদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বহুল প্রচলিত তত্ত্ব ও তথ্যকে অ্যাপ্রচ করতে অভ্যস্ত করে তোলা। উপর্যুক্ত প্রশ্নাবলীর উত্তর নিয়ে চিন্তাভাবনা করাই শ্রেয়। যদি মন্তব্যে লিখে জানাতে চান, স্বাগতম জানাই। কিন্তু , মূল পোস্টের বদলে মন্তব্যের সূত্র ধরে আলোচনার সূত্রপাত করতে চাইলে, বা প্রশ্নের ভাষা ব্যক্তি আক্রমণাত্মক হলে প্রত্যুত্তরের প্রত্যাশা না রাখাই ভালো।
তথ্যসুত্রঃ
১। ডারউইনের বিবর্তনবাদের তথ্যসমূহ নেয়া হয়েছে জওহরলাল নেহরুর গ্লিম্পস ওফ ওয়ার্ল্ড হিস্টোরি বইয়েরঃ ডারউইনিজম - দা ট্রায়াম্ফ অফ সায়েন্স নামক চ্যাপ্টার থেকে (পৃষ্ঠা ৪৯৯ - ৫০৫), এবং সোফি'স ওয়ার্ল্ডের "ডারউইন" - শীর্ষক অধ্যায় থেকে ( পৃষ্ঠা ৩৩৫ - ৩৫৫)।
২। নাজিবাদিদের বিবর্তনবাদের ব্যাবহার সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য নেয়া হয়েছে ইউভাল নোয়াহ হারারির স্যাপিয়েন্স বইটির দা ল' অফ রিলিজিয়ন চ্যাপ্টারের ২৫৮ - ২৬৩ পৃষ্ঠা থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০২১ বিকাল ৪:৪৫