“Under the spreading chestnut tree
I sold you and you sold me:
There lie they, and here lie we
Under the spreading chestnut tree.”
― George Orwell, 1984
১।
আমরা কি এশিয়া আর আফ্রিকার দরিদ্র্য দেশগুলিতে গণতন্ত্র'র সক্ষমতা ও সম্ভাব্যতা নিয়ে বেশী রোম্যান্টিসাইজ করে ফেলছি? যে মৌলিক সংজ্ঞায় ও যে প্রতিশ্রুতিতে গণতন্ত্রের জন্ম, তা এই সমস্ত অঞ্চলে প্রয়োগ সম্ভব কি না এই প্রশ্ন কি কখনো আমাদের মাথায় আসে? এমন গণতন্ত্র কেন এতটা জরুরী আমাদের, যারে সামরিক বাহিনী এক ফুঁয়ে উড়ায়ে দিতে পারে? এমন গণতন্ত্রের কি যৌক্তিকতা, যার আড়ালে দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়ন করেও, স্রেফ নিজের 'গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী' ইমেজকে পুঁজি করে রাজনীতিতে টিকে থাকা যায়?
গণতন্ত্রের সবচে বড় সমস্যা, উপর্যুক্ত রাষ্ট্রসমূহের প্রেক্ষিতে, হল - এটা আপনাকে ভোটের রাজনীতির রূপকথা শুনায়। আপনাকে স্বপ্ন দেখায় ব্যালট বক্সের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের। পৃথিবীর অধিকাংশ অনুন্নত ও দরিদ্র্য দেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, সে রূপকথা বাস্তবে পর্যবসিত হয় না। স্বপ্ন থেকে যায় স্বপ্নের জায়গায়। শাসক শাসনক্ষমতা অধিকার করে পেশীর জোরে। আর্মি - প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে। তারপর, 'আপনার' ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দেশ - দশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন কাজেই আপনার পরামর্শ চায় না। আপনার মতামতের তোয়াক্কা করে না। স্বেচ্ছাচারীর মতো সিদ্ধান্ত নেয়। এদিকে আপনি বসে থাকেন পরবর্তী ইলেকশনের জন্যে। সুষ্ঠ - গনতান্ত্রিক নির্বাচনে ক্ষমতা বদল করবার।
আমার মতে, অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলিতে ভোটের রাজনীতি হল এক 'বাবল' (bubble), যার ভেতরে আটকা পড়ে জনগন আর সিস্টেমকে প্রশ্ন করতে পারে না। কারন, সিস্টেম থেকে তাকে বোঝানো হয়, তুমি আমাকে প্রশ্ন করা মানে গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করা (কারন যে সিঁড়ি বেয়ে সিস্টেমটা উপরে উঠে এসেছে সেট গণতন্ত্র), মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে প্রশ্ন করা(কারন সিস্টেমটা 'জনগনের ভোটে' নির্বাচিত), সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা, এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রদ্রোহীতা করা। কাজেই সিস্টেমকে প্রশ্ন করার সাহস কোন একক সত্ত্বার হয়ে ওঠে না, স্বপ্ন স্বপ্নের জায়গায় থেকে যায়। পেশীর জোর যার বেশী - সে গণতন্ত্রের নামে, ভোটের রাজনীতির নামে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখে।
'ব্যালট বক্সের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়' - এই বাবল থেকে অনুন্নত দেশের জনগোষ্ঠী বের হয়ে আসা মাত্রই এই নগ্ন সত্য উপলব্ধি করতে পারবে যে রাজনীতি রুথলেস মানুষের খেলার জায়গা। 'লড়বো লড়বো জিতবো রে' এই খেলার থিম সং। সুশীলদের জায়গা রাজনীতিতে নাই। এটা এতো বড় বাজি যেখানে আপনার সবকিছু হারানোর বিনিময়ে / রিক্স নিয়ে সবকিছু জিতার দুঃসাহস দেখাইতে হবে।
অনুন্নত, দরিদ্র দেশ সমূহের হাজার বছরের ইতিহাসে আমজনতার 'গণতান্ত্রিক' ও 'রাইচুয়াস' আন্দোলন কখনোই কোন পরিবর্তন আনে নাই, এবং রাজনীতিতে তার কোন হক আদৌ নাই এইটা সে তখন বুঝতে পারবে। সে অনুধাবন করবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন রক্তপাত দাবী করে। তখন সে অনুধাবন করবে একটা জীবন আফসোস কইরা কাটায়ে দেয়ার অর্থ নাই। তখন সে আসেপাশের ফুল - লতাপাতা - পাখির দিকে আরও রোম্যান্টিক দৃষ্টিতে তাকানো শুরু করবে। বসন্ত ঋতু নিয়া কবিতা লিখবে। প্রেমের উপন্যাস লিখবে।
২।
উপর্যুক্ত দেশসমূহ, যাদের প্রসঙ্গে এই লেখার শুরুয়াদ, চিন্তা করে দেখেন, সচরাচর এ সমস্ত দেশে ক্ষমতার হস্তান্তর প্রক্রিয়া সুখকর হয় না। নির্বাচন হোক বা যাই হোক, ঐ সময় মানুষের লাশ পড়ে, আদিম কৌম সমাজের মতো সম্মুখ সমরে। অর্থাৎ, ক্ষমতার হস্তান্তরে বা পালাবদলে পেশীশক্তির প্রয়োগ বরাবরই এই সমস্ত দেশে প্রাসঙ্গিক।
কোন রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের চর্চাটা না থাকলে পেশীশক্তি দিয়ে টিকে থাকা একটি রেজিম রে পেশীশক্তি দিয়ে আরেকটা রেজিম লিগ্যালি উৎখাত করতে পারে। গণতন্ত্র থাকলে যে সুশীলিয় মুখোশটা পড়ে ভায়োলেন্স করা লাগে, সেই মুখোশ পড়ার প্রয়োজন পড়ে না। আবার এই রেজিমরে যদি পূর্ববর্তী রেজিম কোনভাবে ছলে বলে কৌশলে রিপ্লেস করতে পারে, তবে তারে 'অগণতান্ত্রিক' , 'স্বৈরতান্ত্রিক' ইত্যাদি বালছাল টাইটেলে ভূষিত করার প্রয়োজন থাকে না। সমস্যা জর্জর সবাই। ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেশন, আর কষ্ট করে এক - দুই দশক পর নতুন করে ইতিহাস রচনার প্রয়োজন পড়ে না।
যেমন ধরেন, যে বাদশাহ হুমায়ূনরে যখন শের শাহ লৌড়ানি দিয়েছিল, তিনি যখন ইরানি বাদশাহ শাহ তাহমাস্পের বদৌলতে ফিরে এসে যখন শের শাহের গুষ্ঠিরে উপড়ায়ে ফেলে মুঘল সাম্রাজ্যের ঝাণ্ডা বুলন্দ করে, সে শের শাহরে আর যাই বলুক, অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসক ইত্যাদি বলে নাই। সময় নষ্ট তাই না? রাজনীতির খেলাটাই এরকম। লড়বো লড়বো জিতবোরে। শের শাহরে অগণতান্ত্রিক - স্বৈরতান্ত্রিক বলে নাই বইলা কি আমরা হুমায়ূনরে দোষ দিই, বা কম পছন্দ করি?
বাদশাহ হুমায়ূন, বা আকবর, বা শাজাহান, বা জাহাঙ্গীর কখন কারে কোন এলাকার জায়গীর দিবেন - এই নিয়ে মতামত দেয়ার, হাসিঠাট্টা করার দুঃসাহস কি তাদের প্রজারা কখনো দেখিয়েছে? গণতন্ত্র শুধুমাত্র প্রজাদের জন্যে না, শাসকদের জন্যেও নিতান্ত অস্বস্তিকর একটা সিস্টেম।
৩।
যদি আমারে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা জিগান, আমি বলবো, গণতন্ত্র তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলিতে চর্চিত স্বৈরতন্ত্র/ পরিবারতন্ত্র/ রাজতন্ত্র ইত্যাদি ফ্যাসিস্ট রেজিমরে মেকআপ দিয়া একটা উপস্থাপনযোগ্য সুরত দেয়ার জন্যে ব্যবহৃত একটা পলিটিক্যালি কারেক্ট টার্ম মাত্র। যদি উপরে উপরে গণতন্ত্রের একটা মুখোশ চাপায়ে যদি সমস্ত দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তায়নরে জায়েজ করা সম্ভব হয়, তাইলে অমন গণতন্ত্রের আমাদের কি দরকার, এই প্রশ্নটা নিজেরে করা বোধয় দরকার হয়ে পড়সে।
(ছবিঃ শহীদ নূর হোসেন। সুত্রঃ উইকিপিডিয়া)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সকাল ১১:৫৫