somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মৃত্যু নয় জীবনের শোকাগ্নিগাঁথা ‘রবীন্দ্রনাথ : জীবনে মৃত্যুর ছায়া’

১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ২:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



:: আসিফ আজিজ ::
একটি কাব্যের দুটি কবিতা- ‘জন্ম’ ও ‘মৃত্যু’। জন্ম- ‘জীবনের সিংহদ্বারে পশিনু যে ক্ষণে/ এ আশ্চর্য সংসারের মহানিকেতনে/ সে ক্ষণ অজ্ঞাত মোর।’ মৃত্যু- ‘মৃত্যুও অজ্ঞাত মোর। আজি তার তরে/ ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে।’ কবিতা দুটি নৈবেদ্য কাব্যের। রবীন্দ্রনাথের মধ্যবয়সে লেখা এই কবিতা দুটি পড়লে মনে হয় জন্ম-মৃত্যু কোনো এক অজ্ঞাত অনুভূতি, যা নিয়ে মানুষ জন্মায় এই জ্ঞাতলোকে; আবার লোকান্তরিত হয় আরেক অজ্ঞাত অনুভূতি নিয়ে; চলে যায় অজানালোকে। সে জানে না, জানতে পারে না মাঝের সময়টুকু ‘জীবন’ না ‘মৃত্যু’র জন্য ক্রমাগত অপেক্ষায় সাজানো পসরা। সে যাই হোক সত্য জন্ম, সত্য মৃত্যু। উল্কাপিণ্ডের মতো জীবন থেকে নবজীবন; তারপর আঁধারলোকে আরেক নতুন উপলব্ধি। কী সে উপলব্ধি? তা জানে না কেউ; কেউ দেখেনি। ইকারুসের মতো পাখা লাগিয়ে সে নতুন জগৎ দেখার স্বাদ সতত হয় না। হয়ত পরিণতির কথা ভেবেই। কয়েক সেকেন্ড বয়সী একজন মানুষ জানে না তাঁর প্রথম আলো দেখার অনুভূতি; জানতে পারেনি আজও। যেমন জানতে পারে না মৃত্যুর স্বাদ, গন্ধ, রং, অনুভূতি। শুধু পারে কল্পনার সারথি হতে। সে যাই হোক, এবারের একুশে বইমেলার গোধূলিলগ্নে হাতে পেয়েছিলাম তরুণ কবি, গবেষক অঞ্জন আচার্যের গ্রন্থ ‘রবীন্দ্রনাথ : জীবনে মৃত্যুর ছায়া’। জীবনে মৃত্যুর মতো শেষক্ষণে পাওয়া বইটি একটু চমকে দিয়েছিল মৃত্যুর মতো। কিন্তু অনুভূতিটি ছিলো আনন্দের। হয়ত জন্মের মতো, হয়ত মৃত্যুর মতো। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র এবং পাঠক হিসেবে যতটুকু খোঁজখবর রাখি তাতে ওপার বাংলা এবং এপার বাংলা মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ, তাঁর কাছ থেকে দেখা কিংবা উপলব্ধি করা মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া নিয়ে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা-গ্রন্থ এর আগে প্রকাশ হয়নি। গ্রন্থটির অভিনত্ব এখানেই। যদিও রবীন্দ্রনাথের জীবনে মৃত্যুর প্রভাব এবং মৃত্যু নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা-বিষয়ক বিচ্ছিন্ন লেখোলেখি একবারে কম হয়নি। শূন্য দশকের একজন তরুণ কবি, গবেষক অঞ্জন আচার্য আশি পৃষ্ঠার ছোট্ট কলেবরে চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্রজীবনের এক শোকাগ্নিগাঁথাকে বেঁধে রাখতে, কিংবা বলা যায় রাখতে হয়েছে। গ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশত বছরে প্রকাশনা সংস্থা ‘মূর্ধন্য’-র বিশেষ গ্রন্থমালার ১৫১টি বইয়ের এটি একটি প্রকাশনা। হয়ত ১৫১টি বিচিত্র বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে করতেই বেরিয়ে এসেছে এরকম আকর্ষণীয়, অভিনব একটি বিষয়। তরুণরা সবসময় চেষ্টা করে পরিশ্রম করে কাজ করতে। হয়ত বৃহৎ প্রাপ্তির কথা ভেবে; হয়ত মানুষ হিসেবে দায়িত্বপালন করতে। লেখককে যখন শব্দ, বাক্য, পরিসর বেঁধে দেওয়া হয় তখন বলা যায় একটু বিপদেই পড়েন তিনি। ঘোড়াকে লাগাম টেনে ধরলে, কিংবা চলন্ত ট্রেনে হঠাৎ চেইন টানলে অনিচ্ছাকৃতভাবে তাকে হঠাৎ থামতে হয়; সামলে নিতে হয় পুনরায় চলার গতি আনতে। তবু চলাই তাদের ধর্ম, থেমে থাকবে কী করে। যেমন লেখকের কাজ লিখে যাওয়া এবং অবশেষে পৌঁছানো নির্দিষ্ট গন্তব্যে। গ্রন্থটি সম্পূর্ণ মন্থন করলে পরতে পরতে লেখকের কঠোর পরিশ্রম, গভীর অভিনিবেশ, নিজেকে সংযত বা পরিমিত হওয়ার প্রয়াস সচেতন পাঠকের চোখ এড়াবে না।

মৃত্যু রবীন্দ্রনাথের জীবনে ছায়া ফেলেছিল, কিন্তু ঢেকে দিতে পারেনি আঁধারে। কারণ মৃত্যুকে তিনি অন্তরে পালন করেছেন অমৃত রূপে। মৃত্যু সেখানে জীবনের নতুন শিল্প। কাছের মানুষের মৃত্যুতে সাময়িক শোকবিহ্বল হয়েছেন। কিন্তু যখন অন্যকে সান্ত্বনা দেওয়ার ছলে নিজেও সান্ত্বনা খুঁজেছেন তখন শোককে পরিণত করেছেন শক্তিতে; এগিয়ে রেখেছেন জীবন থেকে অনেক বেশি মহৎ করে, যেখানে জীবন-মৃত্যু শিল্পে, এবং শিল্প পরিণত হয়েছে সৌন্দর্যে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮০ বছরের জীবদ্দশায় চল্লিশটি মৃত্যুতে প্রকাশ করা শোকানুভূতি গবেষক তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় খুঁজে বের করে উপস্থিত করেছেন পাঠকের সামনে। আমরা এগুলোকে প্রামাণ্য বলেই ধরে নিতে পারি। তবে হয়ত গবেষণার অনিচ্ছাকৃত প্রতিবন্ধকতার কারণে শোক প্রকাশ করে, বা কোনো মৃতকে উদ্দেশ্য করে লেখা সব দৃষ্টান্ত আমাদের কাছে উপস্থিত করতে পারেননি; যেমন পারেননি ভূমিকার সামান্য দু একটি কথা ছাড়া রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুকে দেখা এবং প্রতিক্রিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কোনো কথা বলার সুযোগ। এই দায়ভার গবেষকের উপরই রইল। আশাকরি দায়টা ভবিষ্যতে এড়িয়ে যাবেন না। কারণ পাঠকের জানার ক্ষুধা চিরন্তন, অসীম। আর সেটা পূরণ করার দায়িত্ব অবশ্যই লেখকের উপরই বর্তায়। গ্রন্থটি প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে পড়তে গিয়ে বুঝেছি গবেষক অঞ্জন আচার্য রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রশান্তকুমার পাল, ভারতী, তত্ত্ববোধিনী, সাধনা প্রভৃতি পত্রিকা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে কর্ষণ করেছেন। যার ফলবতী ফসল ‘রবীন্দ্রনাথ : জীবনে মৃত্যুর ছায়া’ গ্রন্থটি। ফলবতী বললাম একারণে যে রবীন্দ্রানুরাগী গবেষকগণ যাঁরা নিউরোনিক শূন্যতায় ভুগছেন, তারা পাবেন চিন্তার নতুন রসদ। উন্মোচিত হবে তাঁদের চিন্তার নতুন দ্বার। রবীন্দ্র সাহিত্যের বয়সও তো কম হলো না। হাতে-কলমে বলতে গেলে একশ পঁয়ত্রিশ বছরের বেশি। অসংখ্য গবেষণায় বিচিত্র সব বিষয় বেরিয়ে আসার পরও রবীন্দ্রনাথ ফুরিয়ে যাননি। এখনো সমান প্রাসঙ্গিক, বৈচিত্র্যময়। গ্রন্থটি মানুষের অবিরত অনুসন্ধিৎসু মানসিকতার ফসল বললে অত্যুক্তি হবে না।

কোনো দার্শনিক ছাড়া মৃত্যুকে এমন নিরাসক্তভাবে বোধ হয় অবলোকন করেন না আর কেউ। যেমনটি করেছেন রবীন্দ্রনাথ নিজের জীবনের মধ্য দিয়ে। মৃত্যুশোককে আমরা সবসময় কল্পনা করি পাহাড় কিংবা সমুদ্রের সঙ্গে যা সহজে লঙ্ঘন বা অতিক্রম করা যায় না। কিন্তু মৃত্যু পৃথিবীতে এসেছে জিততে, হারতে শেখেনি সে। কিন্তু মৃত্যু নিজে জেতে না, কেউ জিতিয়ে দেয় তাকে। মৃত্যু নতুন সৃষ্টির অনুপ্রেরণা। তাহলে সে কেন হারবে? কেনই বা হারবে মানুষ তাঁর (মৃত্যু) কাছে। কিন্তু এও সত্য মানুষ হেরে যায়। যে ‘হার’টা শব্দের ফ্রেমে বাঁধা। হেরে গিয়ে জিতে যায়। কিন্তু যিনি বলেন ‘আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো এই শেষ কথা বলে/যাব আমি চলে’- তিনি তো হারতে আসেননি। তিনি মৃতুঞ্জয়ী।

এখন জানা যাক কাদের মৃত্যু ছায়া ফেলেছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনে। কোনো লেখক অথবা বলা যায় কোনো মানুষ নিজ পরিবারের এতসংখ্যক মৃত্যু জীবদ্দশায় দেখেছে কি না তা হতে পারে আরেকটি গবেষণার বিষয়। পরিবার-পরিজনের মধ্যে : মা- সারদাসুন্দরী দেবী; বউদি- কাদম্বরী দেবী; স্ত্রী- মৃণালিনী দেবী; মেয়ে- রেণুকা দেবী ও মাধুরীলতা দেবী (বেলা); বাবা- দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর; পুত্র- শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর; ভ্রাতা- সোমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর; ভ্রাতুষ্পুত্র- নীতীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর; একমাত্র নাতি- নীতীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। বন্ধু-বান্ধবের বা শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে হারিয়েছিলেন- মোহিতচন্দ্র সেন; শ্রীশচন্দ্র মজুমদার; উইলিয়াম টনস্ট্যানলি পিয়ার্সন; চিত্তরঞ্জন দাস এবং আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুকে।

সাহিত্যজগতে যাঁরা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধার বা স্নেহের বা অনুরাগী মানুষ : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিহারীলাল চক্রবর্তী (বড় মেয়ে মাধুরীলতার শ্বশুর), রজনীকান্ত সেন, ডি.এল. রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায় এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে : কার্ল এরিখ হ্যামারগ্রেন, সতীশচন্দ্র রায়, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এবং মৌলানা জিয়াউদ্দীন। এবং অন্যান্যের মধ্যে আছেন মহারানী ভিক্টোরিয়া, স্বামী বিবেকানন্দ, যতীন দাস, দুইজন ইংরেজ নারী (যারা বিপ্লবী ক্ষুদিরামের বোমার আঘাতে মারা যান), চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ডুজ, বিনয়িনী দেবী, শান্তা দেবী এবং একান্ত সহকর্মী কালীমোহন ঘোষ প্রমুখ। আপনজন, কাছের মানুষের এতগুলি মৃত্যু একজন মানুষের নিজের অন্তর্ধানের আগে দেখে যাওয়ার অর্থ কী তাহলে বেঁচে থাকার নতুন অদম্য শক্তি, যা রবীন্দ্রনাথের ছিল? এ বইটি হাতে নিলে পাঠক বুঝতে পারবেন। গবেষক অত্যন্ত যত্ন সহকারে প্রতিটি মৃত্যুর সময়, বার, তারিখ, সাল, মৃত্যুর কারণ এবং মৃতের বয়স উল্লেখ করার চেষ্টা করেছেন। তা ছাড়া চল্লিশটি মৃত্যুর ঘটনাই কালানুক্রমিকভাবে বর্ণিত। তবে দেখা গেছে কারও কারও মৃত্যুর অনেক বছর পর তিনি শোক প্রকাশ করেছেন কিংবা প্রকাশ করে কিছু লিখেছেন। যেমন মায়ের মৃত্যুর প্রায় ৪৭ বছর পর মাকে নিয়ে লিখেছেন ‘মনে পড়া’ কবিতাটি। মৃত্যু পরবর্তী রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়াগুলোও অদ্ভুত। মৃত্যু মানুষকে কাঁদায় না এটা ভাবতে কষ্ট হয়। কষ্টটা অবার হয় দুই কারণে- তবে এটা কী নিষ্ঠুরতা? না, অধিক শোকে বাকহীনতা? না কি লুকিয়ে আছে অন্য কোনো রাবীন্দ্রিক দর্শন? সেটা বইটিতে লিপিবদ্ধ শোকস্মৃতিগুলো পড়লে উত্তর পেয়ে যাবেন যে কেউ। মা, বাবা, ভাই, ছেলে, মেয়ের মৃত্যু রবীন্দ্রনাথ শোক, ক্ষোভ, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, ধিক্কার, নীরবতা প্রকাশ করেছেন কখনো কবিতায়, কখনো স্মৃতিকথায় কখনো গানে, কখনো চিঠিতে, কখনো বক্তৃতা, কখনো প্রবন্ধ, কখনো বা গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে। এঁদের সবার মৃত্যুর প্রভাব কবির জীবনে একরকম ছিল না। সেটাই স্বাভাবিক। তাঁর লেখালিখিতে তিনি তা লুকাতে পারেননি। যেমন লুকাতে পারেননি প্রাণপ্রিয় বউদি কাদম্বরি দেবীর অকৃত্রিম ভালোবাসা, বেদনার্ত মৃত্যুশোক। তাই দেখা গেছে স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ, চিঠি, ভ্রমণকথা, কবিতা, গান ইত্যাদি সবকিছুর মধ্যে তাঁকে খুঁজে ফেরার আকুল আকুতি। চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত এই বউদিই যে তাঁকে প্রতিমুহূর্তে দাঁড় করিয়েছিলেন নতুনের সামনে; খুলে দিয়েছিলেন চিন্তার নব নব দ্বার। তাই মৃত্যু যে গতিশীল, হোক সে স্থির গতি, তা কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুপরবর্তী এবং রবীন্দ্রপ্রয়াণ পূর্ববর্তীকাল পর্যন্ত নানা রচনায় দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়। তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ বইয়ের ‘মৃত্যুশোক’ অধ্যায়ে এক জায়গায় কবি লিখেছেন ‘‘আমার চল্লিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় ঘটলো তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছে। ...যাহা আছে এবং যাহা রহিল না এই উভয়ের মধ্যে কোনোমতে মিল করিব কেমন করিয়া।’’ এ ছাড়া ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’ সহ অনেক গান, কবিতা তাঁকে নিয়ে লেখা বলে জানা যায়। প্রায় চৌদ্দ বছর বয়সে দেখা মায়ের মৃত্যু ছিল তাঁর প্রথম পরিচয় মৃত্যু নামক না ‘অমৃত’, না ‘গরলে’র সাথে। মায়ের মৃত্যু নিয়ে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি অবিশ্বাস্যরকম কম। হয়ত ছেলেবেলায় মায়ের সংস্পর্শে কম থাকাই এর পেছনের কারণ। কিন্তু মায়ের আবেদন কি কখনো কম হয় কারো জীবনে? তাঁর জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন : ‘‘প্রভাতে উঠিয়া যখন মা’র মৃত্যুসংবাদ শুনিলাম তখনো সে-কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। ...কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর সে-দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল না। ...জীবনে প্রথম যে-মৃত্যু কালো ছায়া ফেলিয়া প্রবেশ করিল, তাহা আপনার কালিমাকে চিরন্তন না করিয়া ছায়ার মতোই একদিন নিঃশব্দপদে চলিয়া গেল।’’ আবার কোনো কোনো মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া লেখার উদ্দেশ্য ছিল অজানাকে জানানো। যেমন ফরাসি ভাষা-শিক্ষক কার্ল এরিখ হ্যামারগ্রেন। ইনি সুদূর সুইডেনে বসে রাজা রামমোহন রায়ের পরিচয় পেয়ে বাংলাদেশে এসে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। আবার কারো কারো মৃত্যু ছিল রবীন্দ্রনাথের কাছে ক্ষোভ, ধিক্কারের, প্রতিবাদের। যেমন, বিপ্লবী ক্ষুদিরামের বোমা হামলায় নিহত দুজন নিরীহ ইংরেজ নারীর মৃত্যুর পর কালীমোহন ঘোষকে লিখিত এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “মজঃফরপুরে বম্ব্‌ ফেলিয়া দুইটি ইংরেজ স্ত্রীলোকেকে হত্যা করা হইয়াছে শুনিয়া আমার চিত্ত অত্যন্ত পীড়িত হইয়াছে। এইরূপ অধর্ম্ম ও কাপুরুষতার সাহায্যে যাহারা দেশকে বড় করিতে চায় তাহাদের কিসে চৈতন্য হবে জানি না। সাহিত্যিকদের মধ্যে বঙ্কিম কিংবা শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথের যে বক্তব্য পাওয়া যায় তা ছিল কেবল কর্তব্যের খাতিরে স্মরণ মাত্র। কিন্তু আত্মীয় না হওয়া সত্ত্বেও একান্ত স্নেহের পাত্র সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যুর পর এক স্মরণ সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে কবি কেঁদে ফেলেন। সম্ভবত এটাই বোধ হয় ছিল রবীন্দ্রনাথের কোনো মৃত্যুজনিত কারণে প্রকাশ্য কান্না। তথ্যটি গবেষক আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে উদ্ধৃত করেছেন। সত্যেন্দ্রনাথের মতো সুকুমার রায়ও কবির অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন। তাঁর শয্যাপাশে বসে ‘‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/ তবু শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে’’ গানটি দুইবার শুনিয়েছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। আর মৃত্যুর পর সুকুমার রায়ের স্ত্রীকে এক পত্রে লেখেন- “মৃত্যুকে তিনি মহীয়ান করে, তাকে অমৃতলোকের সিংহদ্বার করে দেখিয়ে গেছেন, আমরা যারা মর্ত্যলোকে আছি, আমাদের প্রতি তাঁর এই একটি মহার্ঘ্য দান। এই কথা স্মরণ ক’রে তুমি সান্ত্বনা লাভ কর; ঈশ্বর তোমার শান্তি দিন, তোমার শোককে কল্যাণে সার্থক করুন।’’

অন্যদিকে মেজো মেয়ে রেণুকা দেবী, ভাইপো নীতিন্দ্রনাথ ঠাকুর, ছেলে শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুপূর্ব অসুস্থতা কবিকে কীরকম বিচলিত করেছিল তা এ বই থেকে আমরা জানতে পারি। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন নানা ধরনের ওষুধ, চিকিৎসাব্যবস্থা করে তাদের বাঁচাতে। কিন্তু সবাই চলে গেছে তাঁকে ফাঁকি দিয়ে, একরাশ সত্যের সঙ্গে নিরন্তর বসবাসের সুযোগ করে দিয়ে। আর রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সহিষ্ণু ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আসলে সহিষ্ণু তাঁকে হতে হয়েছিল। মৃত্যুর বিচিত্র রূপ তাঁকে স্বতন্ত্র একটি জগৎ প্রস্তুত করে দেয়, যেখানে মৃত্যুকে পাথেয় করে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া বিকল্প পথের সন্ধান রুদ্ধ। আমরা মৃত্যুর দার্শনিক রূপ দেখেছি ইডিপাস, হ্যামলেট, প্যারাডাইস লস্ট, শাহনামা, মেঘনাদবধ কাব্য প্রভৃতি কালজয়ী সাহিত্যকর্মে। আরো বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে অধিকাংশ মৃত্যুঞ্জয়ী সাহিত্যকর্মের অন্তরালে ভূমিকা ছিল মৃত্যুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় পঁয়ষট্টি বছরের সাহিত্যজীবনে মৃত্যু ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে সবখানেই। সেই ভাণুসিংহ ঠাকুরের পদবলী থেকে শুরু করে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে লেখা ‘শেষলেখা’র কবিতগুলো পর্যন্ত। তাই জীবনের গোধূলিলগ্নে নির্জ্ঞান স্তরে স্থিতি করেও কবি প্রথমদিনের সূর্য এবং অস্তরাগের সূর্যদেবতার কাছে জিজ্ঞেস করেছেন তাঁর সত্তা, স্বরূপ, স্বঋদ্ধি।

এ বইটি হাতে নিয়ে পাঠক আশা করি নিরাশ হবেন না। যদিও মৃত্যু নৈরাশ্যের, তবু মৃত্যু শিল্পের। জীবনের মতো মৃত্যু জীবনেরই শিল্প। যে শিল্পের নিপুন কারিগর শুধু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন না- আরও ছিলেন শেক্সপিয়র, বোদলেয়ার, ইয়েটস, টমাস মান, জীবনানন্দ দাশ, আবুল হাসান, সিলভিয়া প্লাথ সহ অনেকেই। মৃত্যুর জন্য মৃত্যুচিন্তা নয়- এরা সবাই কম-বেশি ছিলেন মৃত্যশিল্পী। তাঁদের মৃত্যু ভাবনায় সংযুক্ত হয়েছে মৃত্যুর দর্শন, নান্দনিকতা, শিল্পের গভীর রহস্য, সুন্দরের মনোহারিত্ব এবং জীবন জাগরণের উৎসারণ। কবি রিলকের দৃষ্টিতে যা ছিল জীবিতের চেয়ে উন্নত এবং পূর্ণ। আর রবীন্দ্রনাথের কাছে মৃত্যু জীবনের এক স্তর থেকে আরেক স্তরে যাওয়ার সিঁড়ি (‘‘তিনি আমাকে শিক্ষালয়ের এক শ্রেণী হইতে আরেক শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করিলেন’’- স্ত্রী মৃণালিণী দেবীর মৃত্যুর পর মোহিতচন্দ্র সেনকে লেখা দ্রষ্টব্য), জীবনে চলার নবগতি (‘‘যে রাত্রে শমী গিয়েছিল সে রাত্রে সমস্ত মন দিয়ে বলেছিলুম বিরাট বিশ্বসভার মধ্যে তার অবাধ গতি হোক আমার শোক তাকে একটুও যেন পিছনে না টানে।’’-দৌহিত্র নীতীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে কন্যা মীরা দেবীকে লেখা চিঠিতে প্রসঙ্গক্রমে লেখা পুত্র শমীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে)। এমন অনেক অজানা তথ্য পাওয়া যাবে বইটির প্রতিটি পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। বাকিটুকু পড়ে নেওয়ার দায়িত্ব পাঠকের ওপরই বরং রইল। আমার বিশ্বাস অঞ্জন আচার্যের ‘রবীন্দ্রনাথ : জীবনে মৃত্যুর ছায়া’ বইটি পাঠককের ওপর গভীর ছায়া ফেলবে, ভাবাবে, নবচিন্তালোকে নিয়ে যাবে, কিছুটা হলেও পাল্টে দেবে মানুষের মৃত্যুভাবনা; যেমন অনেক মৃত্যু পাল্টে দিয়েছিল একজন রবীন্দ্রনাথকে।

রবীন্দ্রনাথ: জীবনে মৃত্যুর ছায়া; লেখক: অঞ্জন আচার্য; প্রকাশক : মূর্ধন্য; প্রকাশকাল : অমর একুশে গ্রন্থমালা ২০১২; প্রচ্ছদশিল্পী : ন্যাহরীন নাবিহা মাহমুদ (৯বছর); পৃষ্ঠা : ৮০; মূল্য : ১২০ টাকা।

Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ২:২০
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×