বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞান-চর্চার সবচেয়ে বড় জায়গা। যেকোনো দেশেরই খুব কম সংখ্যক ব্যাক্তিরই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হয়। এখানে পড়াশোনা করা ছাত্র-ছাত্রীরা সর্বোচ্চ মানের শিক্ষা নিয়ে দেশ জাতি সমাজ ও সারা পৃথিবীর কল্যাণে কাজ করবে-এই প্রত্যাশাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্ত প্রায় ৫ টা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এখানকার বেশীরভাগ শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত শোচনীয়। দীর্ঘ শিক্ষাজীবনে দেখেছি যে বেশীরভাগ বিম্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীই বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা ও মর্যাদা সম্পর্কে কিছু জানে না। একজন শিক্ষার্থীর দায়িত্ববোধ সম্পর্কেও তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নাই।
এদের বেশীরভাগের কাছেই বিশ্ববিদ্যালয় একটা ফাজলামি ও সর্বপ্রকার অনৈতিক কার্যক্রম ও অসভ্যতা করে যেকোনোভাবে সনদ লাভের জায়গা। নিজেদের উন্নত রুচি,শিক্ষা-জ্ঞান ও মানসিকতার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কোনো ইচ্ছাও তাদের নাই। তাই এদের অনেকে এখানে অবাধে সন্ত্রাস ও চাদাবাজি ও দলীয় লেজুড়বৃত্তি করে। প্রেমের নামে অসভ্যতা, নিজেদের চেয়ে যোগ্যদের প্রতি প্রচন্ড পরশ্রীকারতা,হিংসাপরায়ণতা ও হীনমন্যতায় ভোগে। নিজেদের যোগ্যতায় কিছু করে দেখানোর পরিবর্তে এসব নোংরামিতেই এদের বেশী আনন্দ। এছাড়া এদের প্রায় প্রত্যেকেই পরীক্ষায় নকল করে।
একজন শিক্ষার্থীর প্রথম এবং সবচেয়ে বড় দায়িত্ব জ্ঞান-অর্জন হলেও বই পড়ার প্রতি এদের কোনো আগ্রহ নাই।গ্রন্থাগারে গিয়েও তারা বই পড়ার চেয়ে আড্ডাবাজি বেশী করে।
এসব কর্মকান্ডে এগিয়ে আছে গ্রামের নোংরা পরিবেশ থেকে হঠাৎ করে ঢাকায় পড়তে আসা কিছু নষ্ট ছেলে-মেয়ে। পরিবার থেকে দূরে থাকায় সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষর্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসে থেকে অথবা কয়েকজন মিলে বাড়ি ভাড়া নিয়ে এরা অবাধে মাদক গ্রহণসহ সবরকম অপকর্ম করে।তবে ঢাকার অভিজাত এলাকায় বসবাসকারী এবং নামী-দামী কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসাদের বেশীরভাগের আচরণও এইসব নোংরাদের চেয়ে উন্নত না।অবাক হয়ে দেখেছি,সামাজিক,অর্থনৈতিক ও পারিপার্শিকতার পার্থক্য সত্বেও তদের মধ্যে সর্বপ্রকার অসভ্যতার ক্ষেত্রে প্রচন্ড মিল।
উন্নত দেশ থেকে নীতি,আদর্শ,সততা,দেশপ্রেম,শ্রমের মর্যাদা,শৃংখলা,নিয়মানুবর্তিতা –এসব ভালো জিনিসের একটাও না শিখলেও বিবাহ-পূর্ব সম্পর্ক,সিগারেট-মদ-মাদকে প্রায় প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আসক্ত।
ভাষা আন্দোলন,মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো।কারণ সেইসময়ে তারা প্রচুর পড়াশোনা করতেন। শিক্ষা তাদের নিজেদের অধিকার সচেতন ও জাতীয়তাবাদী করেছিলো,যার ফলে প্রায় হাজার বছর পর বাঙ্গালীরা নিজেরা নিজেদের রাষ্ট্র শাসন করার ক্ষমতা পেয়েছিলো। কিন্ত ১৯৯০-এর এরশাদের পতনের পর জ্ঞান ও মেধানির্ভর ছাত্র রাজনীতির পরিবর্তে ছাত্ররা টাকার লোভে দলীয় লেজুড়ে পরিণত হয়ে সন্ত্রাস-বিরোধী দলকে দমন ও টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়লে গৌরবময় ছাত্র রাজনীতির অবসান হয়।
সম্প্রতি টেকনাফে নিহত কর্মকতার মেয়ে সহকর্মীর যেসব ছবি ও ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে ,তাতে এই কথাগুলি আবারও মনে পড়লো। শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা করতে হলে মদ বা সিগারেট খেতে হবে বা চরিত্রহীন-লম্পট হতে হবে এমন কোনো নিয়ম নাই।তাহলে ব্যাবসায়ী-রাজনীতিবিদসহ সব পেশার নষ্ট আর লম্পটরাই দেশের বড় লেখক-সাহিত্যিক,পরিচালক অভিনেতা আর গায়ক হতো।
সেই মেয়ে এবং তার সহপাঠীরা গ্রাম থেকে ঢাকায় পড়তে এসে যেসব অশোভন আচরণ করছে,তাতে প্রশ্ন জাগে-এরা কি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে এসেছে না এই সব অসভ্যতা করার জন্য এসেছে? একজন ছেলের মতো একটা মেয়েরও মদ –সিগারেট খাওয়া বা অশ্লীলভাবে নাচা এবং সেগুলির ছবি তোলা নৈতিকতাহীন অপরাধ। হঠাৎ করে কেউ এরকম অসভ্য হয়না,বরং এরা আগে থেকেই এসব অপকর্মে অভ্যস্ত এবং এদের নষ্টামির ভাইরাস এরা অন্যদের মধ্যেও সংক্রামিত করেছে ।
এদের দিয়ে দেশ -জাতি-সমাজের কি ভালো হবে?
এরা চলচ্চিত্র নির্মাণ করলে সেখানেও এসব অসভ্যতাই থাকবে।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়,আমিও ১৫ বছর আগে সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই চলচ্চিত্র বিভাগে পড়তাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জ্ঞানচর্চায় আগ্রহী করার জন্য ক্লাস শুরু হওয়ারও ৩ মাস আগে আমার লেখা ১২ টা বই সেখানকার গ্রন্থাগারে দিয়েছিলাম,গুগল খূজলে এখনো দেখা যাবে, আমার দেয়া কোন বইটা কত নম্বর তাকে আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়কে নকল,মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত করা জন্য নিজে কোনোদিন নকল না করে, নীতি-নৈতিকতা অনুসরণ করে, নকল,মাদক ও সন্ত্রাসবিরোধী এবং রাজধানী ঢাকার যানযটসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধানভিত্তিক নাটক ও প্রামাণ্যচিত্র তৈরী করে,প্রশাসনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করে বারবার চিঠি দিয়ে সবরকম চেষ্টা করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক ও পরিচালক কর্তৃপক্ষ এসব সম্পর্কে খুব ভালোভাবে অবগত।
এসব কাজে আমাকে সর্বোতোভাবে সাহায্য করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্মানিত একজন শিক্ষক এবং কিছু নীতিবান কর্মকর্তা-কর্মচারী।কিন্ত অধিকাংশ নীতিহীন ও অপরাধী শিক্ষক - কর্মচারী এবং ততোধিক নীতিহীন কর্তৃপক্ষের কারণে শেষ পর্যন্ত আমার কোনো প্রচেষ্টাই সফল হয়ননি।
বরং আমার জাতি গঠনমূলক কাজের জন্য কোনোরকম সন্মান জানানো দূরে থাক,স্বৈরাচারী –খুনী-লম্পট এরশাদের বিরুদ্ধে বইয়ে লেখার কারণে ক্ষুদ্ধ এরশাদের পা চাটা সেই বিভাগের চেয়ারম্যান এবং হঠাৎ ধনী,পেশাদার সন্ত্রাসী-দুর্নীতিবাজ-দুর্বৃত্ত মালিক চরম হেনস্তা করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় করেছে।
তবে সেই চেয়ারম্যানেরও এবছরই মে মাসে অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে করোনায় মৃত্যু হয়েছে। আর আমাকে সরাসরি হুমকি দেয়া সেই পেশাদার সন্ত্রাসী-দুর্নীতিবাজ-নব্য ধনী মালিককেও সন্ত্রাসীদের হামলায় আধমরা হয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছিলো।
যে নষ্ট লোক জেনেশুনে একজন নীতিবান ও দেশপ্রেমিককে মূল্যায়ন এবং তাকে উপযুক্ত সন্মান দেয়া দূরে থাক,সন্ত্রাসী লেলিয়ে দেয়াসহ সবরকম অপমাণ ও অপদস্থ করেছে,৭/৮ বার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সেই চেয়ারম্যানের মৃত্যুর পর তার শেষ্যকৃত্যটাও হয়নি।
এভাবেই প্রকৃতি প্রতিটা অপরাধীকে তার পাপের উপযুক্ত শাস্তি দেয়।
তবে তাদের এসব অপরাধমূলক কাজের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্রও আমার পক্ষে কথা বলেনি।কারণ তারা প্রায় প্রত্যেককেই পরীক্ষায় খাতা খুলে নকল করতো। তাদের বক্তব্য আপনাকে কেউ পছন্দ করে না,আপনার সাথে কেউ চলতে চায় না।কারণ আপনি সন্ত্রাসী, নেশাখোর,নষ্ট লম্পট,নকলবাজ আর পরকিয়াকারী হলে কোনো সমস্যা ছিলো না। আপনি আমাদের সব অপরাধ-অপকর্মে বাধা দেন-তাদের সৎ-নীতিবান হতে বলেন। এটাই আপনার সবচেয়ে বড় অপরাধ।
এই হচ্ছে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র নিয়ে পড়তে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের কথা-যে বিষয়টা নিয়ে পড়তে গেলে সর্বোচ্চ মাত্রার মেধা ও জ্ঞান লাগে।শুধু ২/১টা বই পড়ে বা মুখস্থবিদ্যায় পরীক্ষায় পাস করে কেউ ভালো চলচ্চিত্রকার হতে পারে না।
এসবও ১০ বছর আগের কথা।
সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতেও আমাকে কোনোদিন আমন্ত্রণ জানানোর মতো শিষ্টতাও কেউ দেখায় না,যে সর্বোতোভাবে একটা বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটা জাতিকে প্রকৃত শিক্ষিত,ও নৈতিকতাবোধসম্পন্ন করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলো।
টাকার লোভে সরকারী এবং বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলি নৈতিকতার মান বিচার না করে যেকোনো ছাত্র-ছাত্রীকে বিশ্বদ্যিালয়ে পড়ার অনুমতি দিচ্ছে।যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে সন্ত্রাসী,চাদাবাজ, নেশাখোর ও মাদক ব্যাবসায়ী নীতিহীন এইসব শিক্ষার্থীর।এরা পরে কর্মজীবনে গিয়েও সবরকম অপরাধ ও অপকর্ম করে।
প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত,কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি করার আগে তার অতীত ইতিহাস ভালোভাবে অনুসন্ধান করা। প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ৩ মাস শুধু নীতি-আদর্শের উপরই পাঠ দেয়া উচিত ।বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিকতা নামে বাধ্যতামূলক একটা বিষয় রাখা উচিত এবং নৈতিকতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে কোনো শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ পাবে না ,এরকম এটা নিয়ম চালু করা উচিত।
এটা করা হলে দেশের নৈতিকতার মান উন্নত হবে,যার ফলে দুর্নীতি-সন্ত্রাস-মাদকসহ সব অপরাধ ও অনিয়ম মুক্ত হয়ে দেশ উন্নত হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০২১ রাত ৩:০৭