প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশের জনগণের প্রিয় আমিষ জাতীয় খাবার হচ্ছে মাছ, যেজন্য প্রবাদই হয়েছে, মাছে – ভাতে বাঙ্গালী। বাংলাদেশে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা এবং ব্রহ্মপুত্রসহ ২০০’র বেশী নদী, কিশোরগঞ্জ, নেতৃকোণা ও সিলেট বিভাগের বিভিন্ন হাওর, কাপ্তাই হ্রদ এবং বাংলাদেশের প্রায় সমান আয়তনের বিশাল বঙ্গোপসাগর থাকার পরও এদেশে মাছের দাম এতো বেশী হওয়াটা বিস্ময়কর।
অত্যন্ত দু:খজনক ব্যাপার হচ্ছে যে দেশের বিশাল জলাশয়ের খুব কম অংশেই এখনো মাছ চাষ ও উৎপাদিত হচ্ছে। যে কারণে দেশে মাছের বাজার দুর্মূল্য। ৩/৪ শ টাকা কেজির কমে বাজারে কোনো মাছ পাওয়া যায় না।
ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম হলেও ইলিশের দাম সারাবছর হাজার টাকা কেজি এবং কাতল-বোয়ালও হাজারের কাছাকাছি। দাম বেশী হওয়ার কারণে সাধারণ আয়ের মানুষরা মাছ কেনা থেকে বঞ্চিত হন। বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্টীর মধ্যে পুষ্টিহীনতা প্রকট । এখন মাছের দাম বৃদ্ধির ফলে মধ্যবিত্তের খাবারের তালিকা থেকেও মাছ প্রায় উঠে যাচ্ছে।
খাদ্য উপাদানের দিক দিয়ে মুরগি-গরু-ছাগলের তুলনায় পুষ্টিমানের দিক থেকে মৎস আমিষ বেশী শক্তিশালী। মাছে প্রোটিন ছাড়াও ভিটামিন এ, ভিটামিন ডি, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম, সেলেনিয়াম ও আয়োডিন, বিভিন্ন খনিজ পদার্থ আর ভিটামিন আছে, যা শারীরিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
খাদ্যতালিকায় মাছ থাকলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা পেয়ে সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকা সম্ভব। নিয়মিত পরিমিত পরিমাণে মাছ খেলে হৃদরোগও প্রতিরোধ করা যায়। এমনকি মাছের তেলের প্রোস্টাগ্লাডিন নামে রাসায়নিক পদার্থ ক্যানসার, ও উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করতে সক্ষম। মাছের তেল থেকে তৈরী হওয়া বিভিন্ন ওষুধ চিকিসার জন্য ব্যবহৃত হয়। পুষ্টিবিদরা সপ্তাহে কমপক্ষে তিন দিন ৭০ থেকে ৭৫ গ্রাম করে মাছ খাওয়ার পরামর্শ দেন।
মাছের ওমেগা-৩ ফ্যাটি এ্যাসিডসহ অন্যান্য উপাদান মানুষের মেধা ও বুদ্ধির বিকাশ এবং শারীরিক সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দৃষ্টিশক্তির স্বল্পতা,, শারিরীক দূর্বলতা, ক্ষুধামন্দা, সর্দি, কাশি হাপানী, যক্ষ্মা ইত্যাদি রোগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিমাণে মাছ খেলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং রোগ নিরাময় হয়। কাটাসহ ছোট মাছ ক্যালসিয়ামের উৎস। মলা, ঢেলা, চাদা, ছোট পুটি, ছোট চিংড়ি, কাচকি ইত্যাদি জাতীয় মাছে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম, প্রোটিন ও ভিটামিন এ থাকে। ছোট মাছ কাটাসহ চিবিয়ে খেলে প্রয়োজনীয় পরিমাণ ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। একারণে ছোট মাছ নিয়মিত খাদ্য তালিকায় রাখা উচিত। মাছে ডিএইচএ এবং ইপিএ থাকে। সন্তান-সম্ভবা মহিলাদের জন্য ডিএইচএ এবং ইপিএ প্রয়োজনীয়। নিয়মিত মাছ খেলে মস্তিষ্কে ডিএইচএ-র পরিমাণ বাড়ে এবং হতাশা ও আত্মহত্যার প্রবণতা কমে।
অতীতে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলিতে জাল ফেললেই বড় আকৃতির মাছ ধরা পড়তো বলে শোনা যায়। কিন্ত এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। মাছের প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস, কল-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় সরাসরি নদীতে এসে পরা, পলি জমে নদীর নাব্যতা হ্রাস এবং প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরাসহ বিভিন্ন কারণে দেশে মাছের উৎপাদন কমে গেছে।
স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় বলা হলেও এই পরিমাণ দেশের জনসংখ্যার চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত কম। এজন্যই মাছের বাজার এতো চড়া।
বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রসীমা মাছের বড় উৎস। কিন্ত তারপরও বাংলাদেশে গলদা চিংড়ি, কোরাল,ম্যাকারেল, স্যামনসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের দাম অত্যন্ত বেশী। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রকাশিত বিশ্বের সামগ্রিক মৎস্য সম্পদবিষয়ক প্রতিবেদনে এই খাতে বাংলাদেশ অবস্থান ২৮তম। অথচ সমুদ্র থেকে তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ উত্তোলনের চেয়ে মাছ ধরা অনেক সহজ।
আধুনিক নৌযান এবং নিরাপত্তা সরঞ্জামসহ জেলেদের সমুদ্রে মাছ ধরার কাজ দেয়া হলে দেশে বেকারত্ব এবং মাছের দাম –দুইই হ্রাস পেতো। একইসাথে সরঞ্জাম উৎপাদন শিল্পে অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতো। মাছ উৎপাদন কোনোভাবেই লোকসানী না কারণ দেশ ছাড়াও বিদেশের বাজারে মাছের প্রচুর চাহিদা আছে। প্রবাসী বাংলাদেশীরা বিদেশী মাছের চেয়ে দেশী মাছ খেতেই বেশী পছন্দ করেন। খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হওয়া ছাড়াও মাছের চামড়া ও তেল থেকে বিভিন্নরকম ওষুধ, প্রসাধনী, ভোজ্য তেল, রং, মোম, লুব্রিকেন্ট তৈরী হয়।
দেশে মাছের দাম হ্রাসের জন্য দেশের সব নদী- নালা -খাল- বিলসহ সব জলাশয়ে মাছের চাষ শুরু করতে হবে। গ্রামের বাড়িগুলির বেশীরভাগ পুকুর এখনো চাষ না করে ফেলে রাখা হয়েছে। পরিকল্পিত সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মসূচীর মাধ্যমে মাধ্যমে গ্রামের সব বাড়িতে অব্যবহৃত জায়গায় গাছ লাগানো ও হাস-মুরগী পালণের মতো বসতবাড়ির সব জলাশয়ে মাছ চাষ শুরু করার জন্য জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে।
দেশের সব নদী জলাশয় এবং সমুদ্রসীমা ব্যবহার করে মাছ চাষ ও উৎপাদণের ব্যাবস্থা করা হলে অবশ্য বাজারে মাছের সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে সব পেশার ও মানুষ আয়ের মানুষ কম দামে মাছ কিনতে পারবেন এবং অপুষ্টিজণিত সমস্যা থেকেও রক্ষা পাবেন।
এব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
* ইলিশ, চিংড়ির বিভিন্ন রকম রান্না এবং চিতল মাছের কোপ্তা ছাড়া আমি নিজে মাছ খেতে খুব বেশী পছন্দ করিনা।
কিন্ত মাছ বাংণাদেশের কোটি কোটি মানুষের সবচেয়ে পছন্দের খাবার হওয়ার কারণে তাদের প্রতি সন্মানবোধ থেকেই লিখেছি। এছাড়াও আছে আমিষ জাতীয় খাবার খেয়ে শারীরিক ও মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে শক্তিশালী জাতি গঠনের পরিকল্পনা এবং মৎস খাতে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান এবং রপ্তানী আয় বৃদ্ধির সুযোগের সম্ভবনা।
*** এই লেখাটাা আজকের একটা দৈনিক পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০২২ বিকাল ৫:৫১