একটা ইন্টারভিউ দিয়ে বিকেলে বাসায় ফিরছিলাম। আশেপাশে অনেকগুলো নির্মাণাধীন ভবন। হয়তো এগুলোর কোনো একটার পাশ দিয়ে আসার সময় উপর থেকে টুপ করে কি জানি মাথায় পড়লো। আস্তে আস্তে যন্তণাদায়ক দুনিয়া স্বর্গের মতো মনে হচ্ছিল। বেখেয়ালে পথ চলতে গিয়ে কখন উপর থেকে মাথায় ইটের টুকরোটা পড়লো বুঝতেই পারিনি। আস্তে আস্তে দৃষ্টি থেকে পর্দা সরে যাচ্ছে...
হাজার বছরের সভ্যতা উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। লটকন-জাম-আনারস আর গাবগাছে ভরপুর উয়ারী বটেশ্বর। নিভৃত গ্রাম রাইঙ্গারটেক। কাকডাকা ভোরে উঠতে হচ্ছে, কিন্তু কোনো কাউয়ার দেখা পাইনা। একটু পরেই প্রফেসরের তাড়া। মালসামানদি প্যাক কৈরা এযুগের ফেরাউন মুক্তার হাজির। তার সেই বিখ্যাত রিংটন মোরগের ডাক. কক কক কক.। স্যার বেটাকে কত ধমকেছেন। কিন্তু এরশাদ কাকার মতো ধৈরাই রাখছে এই যুগের সরকার, মোরগ লোকের দরকার, আর আমার চাই রিংটোনে মোরগ। বেকুবটা চিল্লছে, ভাইয়ারা উঠেন স্যার বকা দিবে। আমরাও তড়িঘড়ি করে উঠলাম। দৌড়ে ঢুকলাম টিনের ঝুপড়ি টাইপ প্যালা দেয়া বাথরুমে। দুর্গন্ধে বমি ঠেলে আসে, তবুও মনে হচ্ছে ভেতরে ঢুকে একপ্রস্থ ঘুমিয়ে নেই। বাইরে থেকে ধুম করে লাত্থি পড়ে দরাজায়। বাইরে থেকে মিরাজ চিল্লাছে ঐ ... বাইরা। বের হয়ে ফ্রেশ হই, তারপর নাস্তার টেবিল. যথরীতি সবাই নড়েচড়ে বসার আগেই আমার হাত ধোয়ার শেষ। মিজানুর ভাই রেগে গিয়ে বলে ঐ খাওয়াটা ঠিকঠাক খা। একটু ভেংচি টাইপ হাসি দিয়ে বেরিয়ে আসি পাইচারি করতে থাকি বাইরে।
দুই.
বেলা সাড়ে বারোটা হবে। আবার ককককককক। মুক্তারের আগমন। পাশ থেকে মিরাজ গালি দিলো। .. পুত। এতোক্ষণ মরছিলো নাকি। এখানে একই দিনে তিনটা ট্রেঞ্চে খনন চলছে। গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নবস্তু কিছু পাই না পাই বিরক্তিকর মাটির চাড়া উঠার কমতি নাই। এগুলো পাওয়ার ঝামেলা বহুমুখী। এক তো পাওয়ার পর সাবধানে বাছো, লেবেল লাগাও, প্যাক করো। তারপর ফিল্ড থেকে ফিরে ধোয়া আর নতুন করে প্যাকেট করা, ওজন দেয়া থেকে শুরু করে বিস্তর ঝামেলা।
মিরাজ পাশ থেকে বলে বালডা ফালাইয়া দে, কি হবে এই মাটির চাড়া দিয়ে। আমি ওকে থামাই ধুর বেটা, দে। পরম যন্তে প্যাক করতে থাকি মনের মধ্যে কাজ করছে এক ধরণের রোমান্টিকতা। আরে যাই হোক হাজার বছরের পুরাতন সভ্যতা বলে কথা। কিছু না বলে চেঁচিয়ে ওঠে হালিম পাঠান। বলে পাইছি। দেহেন এইডা মাট্টির পত্থুল। মিজানুর ভাই দ্রুত এগিয়ে আসেন। কিন্তু খুব সাবধানে ট্রেঞ্চে নামেন। চেচিয়ে বলেন অর্ণব লেভেল মেশিন ধরো, তুষার, তানিম ফিতা কই, ত্রিডি নিতে হবে। রেকর্ডিং হয়ে যায়। এরপর মুখ ভেংচি দিয়ে অনেকটা গুরুগম্ভীর আবেশে ছবি তুলেন ফটোগ্রাফার শামীম ভাই। ততোক্ষণে মুক্তার বিশাল একটা গামলায় ঝালমুড়ি রেডি করে ফেলেছে। বারবার ডাকছে কিন্তু হাজার বছরের সভ্যতার টান বলে কথা। সবাই নাস্তার জন্য উঠলেও আমি এক গ্লাস পানি খেয়ে টেঞ্চেই বসে থাকলাম। এমনভাবে হাঁ করে টেঞ্চের সেকশনের দিকে তাকিয়ে আছি মনে হচ্ছে কোনো মাছিকে দাওয়াত দিচ্ছি। চোখ যায় সারফেসের দিকে। একটি গোলাকৃতির রেখার মতো। সেটাকে আস্তে আস্তে সরাতে থাকি। এখানথেকেই আবিষ্কার করা হয় বৌদ্ধধর্ম আর প্রাচীনত্বের সাথে সম্পর্কিত একটি নবযুক্ত মাটির পাত্র।
তিন.
সারাদিন ক্লান্ত থাকার পর ক্যাপ্নের উঠান মানে বিশালাকৃতির মাঠে প্লাস্টকের চেয়ার পেতে এফ.এম রেডিওতে গান শুনছি। তৌসিফের খুব হিট সেই গানটা। বৃষ্টি ঝরে যায় দুচোখে গোপনে.... । মনের অজান্তেই মুখ ফুটে বেরিয়ে আসতে চাইছে আশায় আশায় বসে আছি বিদ্যুত কখন আসে। এমন এক এলাকা যেখানে বিদ্যুত যেতো না, আমরা ধন্য হয়ে যেতাম যখন মাঝে মাঝে বিজলী রোশনির দেখা মিলতো। হ্যা দেখা মিললো.. রাতের খাওয়ার শেষ। আগামীকাল ফিরছি ঢাকায়। তারপর সেই ক্লাস। ভাবতে ভাবতে খোলা মাঠেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম স্রেফ ঘাসের উপরে। সকালে ঘুম ভাঙে ফজরের আযান শুনে। ধড়ফড় করে জেগে উঠি। ঢাকার উদ্দেশ্যে চেপে বসি চলনবিল পরিবহনের একটি বাসে।
চার.
উয়ারী বটেশ্বর থেকে ফিরেছি ক’দিন হলো। এখন ক্লাস চলছে নিয়মিত। সবাই ছুটি কাটিয়ে ফুরফুরে মেজাজে। আমার খুবই মন খারাপ। এতো বড় ছুটি গেলো আর বাড়িতে যেতে পারলাম মাত্র একদিনে জন্য। ধ্যত। ভর দুপুর। বিরক্তিকর ক্লাস চলছে। ব্লগিং করতে গিয়ে তেনা প্যাচানি শব্দটার যে নাম শুনেছি তার বাস্তব উদাহরণ মিলছে ক্লাসে।
স্যার ক্লাস নিচ্ছেন। কিন্তু বিষয়ের প্রতি তার তেমন কোনো ধারণাই নাই। আমার একটু ঘুম ঘুম আসছিলো। এক্কেবারে সামনের বেঞ্চেই বসে ঢুলছি। হটাত স্যারের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো। সালিম.. আপনি সামনের বেঞ্চে বসে ঘুমাচ্ছেন। এগুলো কি। ক্লাসে মনোযোদ দিলে থাকবেন, নাহলে দরজা খোলা আছে। আমি আস্তে আস্তে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে মুক্তি চাইছিলাম বিরক্তিকর এই ক্লাস থেকে। পেছন থেকে স্যারের চিতকার। হাউ ডেয়ার ইউ ইনসাল্ট মি। আমি প্রচণ্ড বিরক্তিভরে বললাম। মানে.......। স্যারের জবাব আপনি আমার অনুমতি বাদে ক্লাস থেকে বেরুচ্ছেন কেনো। আমি কোনো কথা না বলে ক্লাসে এসে বসি। সামনের ডাইসের দিকে খেয়াল করি। ওদিকে বিদ্যেঝাড়া চলতে থাকে। সাজ্জাদ আপনি যা বলেছেন তা ঠিক, কিন্তু সুমি আপনি সেটা বলেছেণ সেটা আংশিক ঠিক। আপনি অনেকটা সুন্দরের পুজারী কিন্তু সবক্ষেত্রে সৌন্দর্যটাই মূখ্য না। আমি ভাবলাম স্যার স্কেল দেখছে নাকি, সুমিকে দেখে বক্তব্য ঝাড়ছে। যাইহোক বুঝলাম না। আমি হাত উঠাই কিছু বলার জন্য। কিন্তু স্যার ইগনোর করে। বলে অন্যদের বলার সুযোগ দিন। পেছনের দিকে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি হাতের উপর মাথা রেখে। ঘন্টা দেড়েক পর ঘুম ভাঙে। এমনিতে ভাঙেনি। ভ্রাইব্রেট মোডে থাকা মোবাইলে কে জানি রিং দিছে তাই। তখনো দেখি ক্লাস চলছে কিশোর আপনি কি বলতে চা্ন, সাজ্জাদের স্কেল আর পুন্যির স্কেলের মধ্যে পার্থক্য কোথায়। দিনা আপনি কি নেছারের সাথে একমত। আজমেরী আপনার স্কেলে এতোগুলো বেশি ঘর কেনো। আচ্ছা রিয়াসাদ আপনি আর দীনবন্ধু কি একই কথা চিন্তা করছেন। আব্বাস আপনি কি বুঝলেন... মোস্তাফিজ আপনি তো নিজেকে বড় নেতা ভাবেন।
পাঁচ
অনার্সের রেজাল্ট বের হলো। ফার্স্ট হলাম। মার্কশীট উঠিয়ে দেখছি যথারীতি ভাইবাতে যাচ্ছেতাই নম্বর। তারপরেও বন্ধুরা কয়েকজন মিলে বেশ হৈ হুল্লা করলাম। আস্তে আস্তে মার্স্টর্সের রেজাল্ট হওয়ার দিনটাতে গিয়ে হাজির। তারপর চাকরীর জন্য ঘুরছি। কিছুদিন পর চাকরী পেলাম একটি গোরস্তানের চিফ গোর খোদক হিসেবে। এই সময় রানা প্লাজায় ধ্বসে অনেক মানুষ মারা গেছে। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের ব্যানারে অনেকগুলো বেওয়ারিস লাশ দাফন হবে। গর্ত খোড়ার আগে চারটা খুঁটি পুঁতে নিতে বললাম লেবারদের। আমি পাশের এক হুজুর টাইপের কাকাকে বললাম সোজা শাবল চালাতে হবে। তাইলে সেকশন ঠিক থাকবে। তারপর আপনি পাতালি করে প্লান বরাবর এগুতে থাকেন। চাচা কোনো কথাই শোনে না। যত্রতত্র কোপাতে থাকে। হটাত মাথা তুলে উপরে তাকান। তাকায় কয় ভাই বাংলার মানুষ, এতো তত্ত্ব কথার ধার ধারে না। আমিও বাবা ইন্টার পর্যন্ত লেহাপড়ি করছি। এই সব সেকশন-পেলাম বাল-ছাল যেসন হাউয়ার পুতে শিখে আর শিখায় তাগো মায়েরে বাপ। কুনো লাভ নাই। আপনে এককালে বহুত মাটি কাটছেন। এক্সপিরেনছ ঐছে তাই আমাগের লিডার হৈছেন। আর ঐ হাউয়ার পুতেরা দেখেন মাথার চান্দি খালি হৈ গেছে গা। একখান বউ পর্যন্ত জুটে নাই। আমি তাকে থামিয়ে বলি কাকা ঐ যে মাটির কলসির মতো কি জানি দেখেন তো ঐটা কি। কাকা প্রচন্ড রেগে যায়। বলে লন আন্নের হাজার বছর আগেকার মাডির ফাডা কলসি। লিয়া পুজার করেন। অনেকটা ক্রোধে সে উপরে ছুড়ে মারে, অসাবধানে থাকায় সোজা আমার মাথায় লাগে।
ছয়.
আসলে মাথায় থাবা দিয়েছেন ডাক্তার। আমি উনাকে চাচা বলি। মুচকি হেসে বললেন। কিরে কোথা থেকে আসছিলি। ব্যাপার কী? কি বিড় বিড় করছিলি অজ্ঞান হওয়ার পর.....। আমি ক্লান্ত চোখে তাকাই। মাথায় হাত চলে যায়। দেখি বড় সড় একটা ব্যান্ডেজ। ভাবি হায়রে প্রত্নতত্ত্ব তুই কি মরার পরও শান্তি দিবি না।
ডিসক্লাইমার: কোনো ব্যক্তি বা পরস্থিতির সাথে মিলে গেলে ঐ ব্যক্তি দায়ী। কারণ লেখার সময় অতকিছু নিয়ে ভাববার সময় ছিলো না।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ১০:২১