somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড:নিজস্ব কিছু বিশ্লেষণ

১৫ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৩:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকান্ড সমগ্র বাঙালি জাতির ইতিহাস এমনকি বিশ্ব ইতিহাসের একটি অন্যতম বর্বরোচিত ঘটনা। পৃথিবীর অনেক দেশেই তাদের জাতির জনক কে অনেক নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে কিন্তু সপরিবারে এতটা নারকীয় হত্যাকান্ড হয়তো আর একটিও ঘটেনি , যা সমগ্র বাঙালি জাতির রাজনৈতিক , সামাজিক এমনকি অর্থনৈতিক গতিধারাকে সম্পূর্ণ পাল্টায় দিয়েছিলো। এই হত্যাকান্ড ছিল একটি সুদূরপ্রসারি ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত বাস্তবায়ন । বঙ্গবন্ধুকে নিরাপত্তায় নিয়োজিত ব্যাক্তি, সেসময়কার সেনাপ্রধান , সেনাবাহিনির উর্ধতন অফিসারবৃন্দ , রক্ষিবাহিনী, আওয়ামীলীগ নেত্রিবৃন্দ কেউ এই হত্যার দায় এড়াতে পারে না ।সমগ্র ঘটনা পর্যালোচনা করলে সামগ্রিক বিষয়কে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায় :

প্রথমত, সরকারের এতো এতো নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা , সেনা গোয়েন্দাসংস্থা তারা কি কিছুই জানলেন না এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে? মানা গেলো বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার সতর্কবার্তা বঙ্গবন্ধু অগ্রাহ্য করেছেন এই বলে যে বাঙালি জাতির কেউ তাকেই কোনোদিন কিছু করবে না !! কিন্তু একটি প্রশিক্ষিত বাহিনীর ভিতরে যখন দীর্ঘদিন যাবৎ একটি ষড়যন্ত্র চলতে থাকে তখন সেই বাহিনীর নিজস্ব দায়িত্ব তার রহস্য উন্মোচন করা তাকে প্রতিহত করা , এ জন্য রাষ্ট্রপতির অনুমতির দরকার হয়না ।

দ্বিতীয়ত, ১৫ই অগাস্ট প্রথম প্রহরে যখন ঘাতকেরা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়ি আক্রমণ করলো সে সময় বঙ্গবন্ধু তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লার নিকট সাহায্য চেয়ে ফোন করেছিলেন । জেনারেল শফিউল্লাহ প্রতিউত্তরে বঙ্গবন্ধুকে কোনোভাবে ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে বলেন । সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে দেখলাম জেনারেল শফিউল্লাহ বলছেন , কর্নেল জামিলের মতো তার জীবন বিপন্ন হবার আশংকায় তিনি যান নি । দেশের রাষ্ট্রপ্রধান যখন আক্রান্ত হয়, তখন সে যেই দলের কিংবা যেই মতাদর্শের হোক না কেন , জনপ্রিয় কিংবা অজনপ্রিয় , তখন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত আসে । একজন সেনাপ্রধান শপথ নেয়ার সময় কিন্তু তার জীবনের বিনিময়ে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার অঙ্গীকার নিয়েই দায়িত্ব প্রাপ্ত হয় । আমি বলবো সেদিক থেকে উনি চরম হৃদয়হীন একটি কাজ করেছেন । আমি বা আমরা একবার ১৫ই অগাস্ট প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর জায়গায় নিজেকে কল্পনা করি ! একজন মানুষ যিনি কিনা মৃত্যুর সামনে সহযোগিতার জন্য এদিক সেদিক ফোন করে যাচ্ছেন , একে একে তার পরিবারের সব সদস্য নিহত হচ্ছেন , সেই মুহূর্তে সেনাপ্রধান কতৃক তাকে বলা হলো বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য ! এটা কোনো বুদ্ধিমান ব্যাক্তির পরামর্শ হতে পারেনা , একজন সেনাপ্রধানের তো নয়ই । উপায়হীন বঙ্গবন্ধুর তখন মৃত্যুর কাছে নিজেকে সমর্পন করা ছাড়া আর কোনো পথই ছিলোনা । ব্যাক্তিগতভাবে আমি মনে করি , এটি তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লার চরম ব্যার্থতা ।

তৃতীয়ত , বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকেরা হত্যা করলো । বীরদর্পে এই ঘটনা রেডিওতে প্রচার করা হলো । খন্দকার মোশতাক আহমেদকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা হলো । একে একে সব বাহিনী প্রধান তার প্রতি আনুগত্য পোষণ করলো । সেদিন বিকেলে বঙ্গভবনে শপথ অনুষ্ঠান হলো , কিন্তু বঙ্গবন্ধুর লাশ তখনও তার ৩২ নম্বর বাড়ির সিঁড়ির উপর !! পৃথীবির ইতিহাসে এই ঘটনাও বিরল যে সে দেশের একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এবং স্থপতিকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের পর তার লাশ সৎকারের পূর্বেই , সেই লাশের উপরে দাঁড়িয়ে নতুন প্রেসিডেন্ট শপথ নেয় !!! সেসময়ের সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ , ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ , সাফায়াত জামিল , এদেরকে বঙ্গবন্ধু সন্তানতুল্য মনে করতেন । জেনারেল শফিউল্লাহকে তো বঙ্গবন্ধু সিনিয়রিটি ভেঙে দুইবার পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান পর্যন্ত বানিয়েছেন । তারা তো পারতেন অন্তত একটিবার শেষবারের মতো ৩২ নম্বরে এসে বঙ্গবন্ধুকে দেখে যেতে !!!! কিন্তু তারা কেউই আসেন নাই , জেনারেল শফিউল্লাহর উচিত ছিল ঘটনার পরদিন বিবেকের তাড়নায় হলেও একবার ৩২ নম্বরে আসা । পরবর্তীতে তৎকালীন সময়ের ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল হামিদের নেতৃত্ত্বে একটি দল এসে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের মরদেহ গ্রহণ করে , ততক্ষনে খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও তার পরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেছে । লেফটেন্যান্ট কর্নেল হামিদের তত্ত্বাবধানে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্য সকল সদস্যের লাশ বনানী কবরস্থান এ দাফন করা হয় এবং বঙ্গবন্ধুর মরদেহ তার জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয় । যদিও বিভিন্ন ভাষ্যমতে জানা যায় , জেনারেল ওসমানী ও কয়েকজন বঙ্গবন্ধুকে ঢাকায় দাফনের জন্য বলেছিলেন কিন্তু খন্দকার মোশতাকের বিরোধিতায় তা আর হয়ে ওঠেনি ।

সেসময়কার সংবাদপত্রের কথা আর নাই বা বললাম । ১৫ই অগাস্ট এর পরের সংবাদপত্র গুলো দেখলে মনে হয় বঙ্গবন্ধু হয়তো ভিন্ন গ্রহের কোনো মানুষ যাকে এক রাতের ব্যাবধানে সমস্ত বাঙালি জাতি ভুলে গেছে। দোষ ,গুন, ভালো , মন্দ মিলিয়েই মানুষ । দেশ পরিচালনায় হয়তো সফল হতে পারেনি , মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় একটি সদ্য স্বাধীন দেশের সফলতা , ব্যার্থতা নির্ণয় করা যায় না , এর জন্য সময়ের প্রয়োজন । যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশ পুনর্গঠনে সময় এর দরকার ছিল , বঙ্গবন্ধু সেই সময় পাননি, কিন্তু পরবর্তীতে ওনাকে যেভাবে কলংকিত করা হয়েছে , বাংলাদেশের কোনো রাজনীতিককেই তা করা হয়নি ।

হত্যা শুধু হত্যাকেই ডেকে আনে , অস্ত্র কেবল অস্ত্রকেই ডেকে আনে , এরপরের ঘটনা যদি আমরা দেখি , ১৫ই অগাস্ট পরবর্তী ক্ষমতার লড়াই এ প্রাণ হারায় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররাফ , মেজর হায়দার । দৃশ্যপটে আসে জেনারেল জিয়া , তার হাতেই বিচারিক প্রহসনে প্রাণ হারান কর্নেল তাহের , তার কয়েক বছর পর আবার সেনা অভ্যুত্থানে প্রাণ হারান জেনারেল জিয়া । তার হত্যাকণ্ডের দায়ভার জেনারেল মঞ্জুর এর উপর চাপিয়ে তাকেও হত্যা করা হয় , এনারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা সেনাকর্মকর্তা ছিল । বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য , যারা একদিন সকল স্বার্থের উর্ধে উঠে দেশ স্বাধীন করার লড়াই এ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারাই কিনা স্বাধীন দেশে ক্ষমতার লড়াই এ প্রাণ হারান !!! পাকিস্তান ফেরত সেনা অফিসার জেনারেল এরশাদ কিন্তু নয়বছর দেশ শাসন করে এখনো বহাল তবিয়তেই টিকে আছে , বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড না হলে হয়তো এই মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার গুলো বেঁচে থাকতো !!!

ব্যাক্তিগতভাবে আমি কোনো দলের সমর্থক না , নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে যতটুকু বিচার করা যায় তা ব্যাখ্যা করলাম । একটি ঘটনার কথা বলে শেষ করি , তখন ২০১৪ সাল । সবে বিশ্ববিদ্যালয় এর গন্ডি পেরিয়ে নতুন চাকরিতে ঢুকেছি। প্রচন্ড গরমের এক দুপুরে রিক্সা করে বাড়ি ফিরছিলাম । রিক্সাওয়ালা এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা তখন ভালো না , নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা চলছে। হঠাৎ করে রিক্সাওয়ালা চাচার কাছে জানতে চাইলাম দেশের পরিস্থিতি কিরকম দেখছেন ? সে বললো , বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে এই দেশে অভিশাপ চলছে । অনেক বছর পর আবার আজ কথাটা মনে পড়লো , বঙ্গবন্ধু কিন্তু এই রিক্সাওয়ালা , কৃষক , শ্রমিক , দিনমজুর এদের পক্ষেই রাজনীতি করেছে , এলিট শ্রেনির স্বার্থানেষী রাজনীতি সে করেন ও নি , এবং তাদের রাজনীতির মারপ্যাচ হয়তো সে বুঝতেও পারেননি । তাদের হৃদয়ে তারা আজও বঙ্গবন্ধুকে সযত্নে লালন করে

(লেখাটি আমার রিপোস্ট , আজ ১৫ ই অগাস্ট , জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আমি লিখাটি আবার পোস্ট করলাম )
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৩:২০
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×