ছোটবেলায় খুব বিভীষিকাময় কিছু স্মৃতির মধ্যে একটা হচ্ছে, শুঁটকির গন্ধ। আমার ঘরটা ছিল একদম রান্নাঘরের পাশে (এখন সবচেয়ে দূরে)। যাই রান্না হত, ধূয়া খেতাম আমি আগে। শুঁটকির বিকট গন্ধও তাই আগেই পেতাম।
ওই গন্ধই যথেষ্ট ছিল আমার মধ্যে কমপালসিভ-শুঁটকি-ভীতি সৃষ্টি করে দেয়ার জন্য। চারিদিকে শুনতাম চ্যাপা শুঁটকি চ্যাপা শুঁটকি। আমার দাদু বাড়ি, নানু বাড়ি দুই জায়গাতেই এই চ্যাপা শুঁটকি বস্তুটা খুব বিখ্যাত। খাওয়ার ধরণ অবশ্য একটু আলাদা। দাদুবাড়িতে কাঁচা শুঁটকিটা প্রচুর কাঁচা মরিচের সাথে বেটে খাওয়া হয়, নানুবাড়িতে প্রচুর পেঁয়াজের সাথে ভেজে। তখন অবশ্য এত কিছু বুঝতাম না। শুঁটকি মানেই বিভীষিকা। দুর্গন্ধ!
খুব খারাপ ছিলাম না শুঁটকিহীন জীবনে... এখন থেকে দুই বছর আগ পর্যন্ত আর কি। কথা বলছিলাম আমার একজন প্রিয় মানুষের সাথে। রাত তিনটা বাজে তখন। আমি শুঁটকি খাই না বলে আমাকে নিয়ে সে কি হাসাহাসি! রীতিমত সাক্ষী হিসেবে ব্যবহার করছে আমি যে 'পিচ্চি' তার ব্যপারে। আমার এত সইবে কেন, আঠারো হল না? অভিমানে ফুলতে ফুলতে রান্নাঘরে গেলাম সেই রাত তিনটার সময়। ফ্রিজ থেকে ভাত আর শুঁটকি তরকারী বের করলাম। মাইক্রোওয়েভে গরম করলাম এবং গোগ্রাসে গিললাম। দেখতে পাচ্ছিলাম না কিছু, নোনা জলের চাদরে চোখ ঝাপসা!
এখন শুঁটকি খুবই ভাল লাগে।
আমার প্রিয় স্টাইলে রান্না শুঁটকির রেসিপি দিচ্ছি তাই।
শুঁটকি মাছ দুইটা ভিন্ন সংরক্ষণ প্রকিয়ায় তৈরি হয়, একটা রোদে শুকিয়ে, আরেকটা হল মাটির নিচে পুঁতে রেখে ব্যাকটেরিয়া ব্রিড করে। অনেকটা পান্তাভাত স্টাইলে। চ্যাপা শুঁটকি দ্বিতীয় ভাবে তৈরি হয়। তাই পুরো শুকনো না, মাংসল। আর গন্ধটাও মাশাল্লাহ... ভালই বিকট।
তাই অল্প শুঁটকিতেই হয়ে যায়।
আচ্ছা, পরিমাণ আন্দাজে দিচ্ছি... (মায়ের থেকে রান্না শিখেছি, অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। আমি দায়ী না!)
- 5/6 টা চ্যাপা শুঁটকি (খুব ভাল করে ধুয়ে, গায়ের ছোট ছোট অাঁশ পরিষ্কার করে, যেগুলো একটু ঘষাতেই আলগা হয়ে উঠে আসে।)
- প্রচুর পরিমাণে পেঁয়াজ কুঁচি (শাব্দিক অর্থেই প্রচুর পরিমাণে। বাংলাদেশী পেঁয়াজের 15টার মত।)
- প্রচুর পরিমাণে রসুন কুঁচি (কুঁচি, মানে কোয়াগুলো গোল গোল করে কাটলেই হবে। 10/12 টা কোয়া।)
- পরিমাণ মত হলুদ, লবণ, মরিচ আর তেল
প্রথমে তেলে পেঁয়াজ আর রসুন ঢেলে অ-নে-ক্ষ-ণ নাড়ুন। যখন মনে হবে হয়ে গেছে, তারও বেশিক্ষণ রাখবেন। গোশত রান্নার সময় যতক্ষণ রাখতে হয়, তার দেড়গুণ বেশি সময়। হালকার চেয়ে একটু বেশি বাদামী রং হয়ে, 120% সিদ্ধ হয়ে, নরম হয়ে যাবে। তখন হলুদ, মরিচ আর লবন দিয়ে আরও কিছুক্ষণ নাড়ুন। তারপরে শুঁটকি দিয়ে দিন। এর পরে আবারও নাড়ুন। ঢেকে রেখে দিন, একটু পরে খুলে আবারও নাড়ুন। অ-নে-ক্ষ-ণ পরে যখন পুরোটার রং গাঢ় বাদামী হয়ে যাবে, শুঁটকি, পেঁয়াজ, রসুন কিছুই আলাদা করে চেনা যাবে না, পেঁয়াজ আর মসলা থেকে তেল আলাদা হয়ে ভেসে উঠবে, তখন নামিয়ে ফেলুন। হয়ে গেল আপনার চ্যাপা শুঁটকি ভর্তা... পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবারগুলোর একটা!
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: রান্নার আগে ঘরের দরজা জানালা ভাল করে বন্ধ করে নিবেন। নইলে প্রতিবেশীদের দ্বারা গণপিটুনী খাওয়ার ভয় আছে। রান্নার পরে ঘরে ভাল করে এয়ার ফ্রেশনার ছিটিয়ে নিন, নইলে দম বন্ধ হয়ে মরে যাওয়ার আশংকা আছে।
উৎসর্গ: যে শিখালো শুঁটকি খাওয়া
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৬ রাত ১০:২৪