স্কুলজীবনের সেই দুরন্তপনাগুলো মানুষকে জীবনের প্রতিটি বাঁকেই পুড়িয়ে চলে।টেনে ধরে সেই হাসি কান্না খুনসুটির মুহূর্তগুলো পুনঃপুন ফিরে পাবার আকাঙ্খা।আমি যখন খুব ছোট,বয়স ঠিক মনে নেই তখন শুনলাম একদিন পিতা অফিস থেকে বাসায় এসে মাতাকে বলছে-"এই শোন উদয়ন স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা চলছে,আমি ফর্ম তুলবো কালকে।তোমার ছেলেকে কয়েকদিনে রেডি কর।"এরপর আমার মা চিরাচরিত বাঙ্গালী মায়েদের মত রাতদিন এক করে আমাকে প্রস্তুত করতে থাকলো।মিথ্যে বলবো না একরকম শিক্ষা গেলানোর মতই আমাকে বেশ কয়েকদিন পড়ানো হল।পরীক্ষার দিন,খুব ভোরে আড়মোড়া ভাঙ্গতে না ভাঙ্গতেই আমি নিজেকে আবিষ্কার করি আমার চারপাশে বেশ বড়সড় কিছুমানুষ তাদের সাথে আমার বয়সেরই কিছু পিচ্চি দাঁড়িয়ে।তাদের কারো চোখে তখনও আমার মত ঘুম।কারো মুখে রাজ্যের বিরক্তি।এবং মজার ব্যাপার আমার যখন ঘুম ভাঙলো আমি দুচোখ মেলিয়া উদয়ন নামক লাল ইটের বিদ্যালয়টিকে দেখলাম।এবং প্রথম দেখায় আমি আম্মুকে বললাম-"আম্মু দেখ স্কুলটি কি গরিব!!তাদের স্কুল রঙ করার টাকা নাই,দেখোনা লাল ইট দেখা যাচ্ছে।"মা আমার কথা শুনেই হেসে দিয়েছিলো।আমি তার হাসি শুনে বললাম-"চল যাই গা আমি এই গরীব স্কুলে পড়বোনা।"মা আমার কথা শুনে আতকে উঠেছিলেন।পিতা আমার পিঠে হাত রেখে বলেছিলো-"বাবা তোর মায়ের কষ্টের মূল্যটা রাখিস,যা বাবা ভালো করে পরীক্ষা দিবি টিক না টিক সেটা ব্যাপার না।শুধু সর্বোচ্চ চেষ্টা করিস।"বয়স অল্প ছিলো তখন পিতার কথাগুলো শুধুই মাথার উপর দিয়েই গেলো।অবশেষে আমি ভিতরে ঢুকলাম।এবং লিখিত পরীক্ষা ভালোই হল।বিধায় আমাকে মৌখিকে ডাকা হলো।এবং মৌখিক পরীক্ষার আগে আমি আমার পিতামাতারর সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলাম।মা তো খুব খুশি আমি লিখিত পরীক্ষা তে টিকে গেছি।পিতা আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললো-"যা তোকে যা জিগ্গেস করবে সত্য উত্তর দিবি।"আমি চলে গেলাম।এবং ভিতরে ঢুকেই আমার সর্ব প্রথম যে লোকটা নজর কাড়লেন আমি গিয়ে তার সামনে দাড়ালাম।তখন সেখান থেকে এক ম্যাডাম আমাকে বসতে বলেছিলেন।সেখানে কি কি প্রশ্ন হয়েছিলো তা আমার স্মৃতিতে ধুলো পড়ায় আমি মনে করতে পারছিনা।তবে একটা প্রশ্ন মনে আছে।আমাকে সেই ভদ্রলোক প্রশ্ন করেছিলেন যিনি প্রথমেই আমার নজর কেড়েছিলেন।"তুমি জানো আমি বিগ্রেডিয়ার জেনারেল??"আমি নাসূচক মাথা নাড়লাম।এবং তিনি বললো-"বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মানে জানো??!"আমি বললাম-"জ্বী,যারা আগুন নিভায় তাদের বিগ্রেডিয়ার বলে।"তিনি আমার উত্তরে হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়েছিলেন এবং পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন-"যাও আবার দেখা হবে।"সত্য বলতে লোকটাকে আমার ভালোই লেগেছিলো।তাই আমি বের হয়ে মাকে বলেছিলাম-"আম্মু আমি এখানে পড়বো,এখানে এক লোক আছে যিনি আগুন নিভায়।"
এরপরের গল্প বেশ মজার।আমি টিকে গেলাম।গুটি গুটি পায়ে আমার উদয়ন যাওয়া শুরু হলো।এবং আমি আস্তে আস্তে জানতে পারলাম সেই আগুন নিভানো লোকটার নাম বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আশরাফুজ্জামান।এবং তিনিই আমাদের প্রিন্সিপাল।আস্তে আস্তে যখন আমার সেই গুটি গুটি পাগুলো বড় হতে থাকলো আমি বড় হতে থাকলাম তখনই স্কুলজীবনের মজাগুলো টের পেতে থাকলাম।জীবনের সেরা বন্ধুগুলো পেলাম এই উদয়নেই।
সারাবছর হৈ-হল্লা করে বেড়াতাম।স্কুল ছুটির পর আড্ডা জমতো ভেলপুরির সেই দোকানটায়।আড্ডা শেষ হতে হতে যেদিন বিকেল হয়ে যেতো সেদিন মায়ের কানডলা থেকে কোনভাবেই বাঁচতাম না।স্কুলজীবনে সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিলো পরীক্ষাগুলো।সারাবছর পড়তাম না বিধায় শেষের দিকের ছাত্র ছিলাম।তাই টিচারদের আমি জ্বালাতনও বেশি করতাম।তবে টিচারদের আদর পাওয়া কোন কারণেই কমেনি আমার।এই ১০ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে আমি প্রিন্সিপাল পেয়েছিলাম ৩ জন।প্রথমজনের কথা বললামই।পরেরজন ছিলেন খালেদা হাবিব আপা।তার শাসন বেশ কড়া থাকলেও তাতে ভালোবাসা ছিলো যথেষ্টই।
সর্বশেষ আমি পেয়েছিলাম উদয়নের বর্তমান প্রিন্সিপাল উম্মে সালমা বেগম।তার আসার পর উদয়নে কেমন যেন এক জোয়ার আসলো।যাতে হুহু করে উবে যেত লাগলো সেসব ভালোবাসা মাখানো রঙ্গিন দিনগুলি।উদয়ন নিয়ে যে খেলা আজ শুরু তা ভাই আমাদের ব্যাচ খুব কাছ থেকে দেখেছে।আমরা যখন ১০ম শ্রেণীতে তখন থেকেই এই উদয়নের ডিজিটাল হওয়ার পথে পথচলা শুরু।এরপর এক রকম ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ব্যাচ ১৫ কে বের করে দেয়ার মাধ্যমে যেন এই ডিজিটাল উদয়নে পরিণত হওয়া শুরু।স্কুলটাকে কাটা ছেড়া করে এক কর্পোরেট অফিস কিংবা জেলখানার মত বানাতে কোন চেষ্টার কমতি আমাদের এই অত্রকালীন প্রিন্সিপাল বাদ দেননি।জানেন ভাই আমাদের এই উদায়নকে নিয়ে কেন আফসোস হয়!!কেন কান্না পায়!!!কারণ এই লাল ইটের বিদ্যালয়ের সোনালী দিনের আমরা সাক্ষী।কিন্তু আজ এই উদয়ন থেকে যেই আমাদের ছোট ভাই বোনেরা বের হবে তাদের কি এই আফসোস থাকবে!!!মনে হয়না।কারণ তারা এই উদয়নকে পেয়েছে ডিজিটাল উদয়ন রূপে!!তারা দেখেনি শ্যামলী নাসরিন ম্যাডামের উদয়ন,দেখেনি বিগ্রেডিয়ার জেনারেল স্যারের মিষ্টি শাসনের উদয়ন।তারা পায়নি আমদের সেই লেজেন্ড টিচারদের।তাদের শিক্ষা নিয়ে গড়ে দেয়া হয় এক চাপা আতংক। সেই আতংকে ভর করে তাদের শিক্ষা গেলানো হয়।উদয়ন ডিজিটাল হোক তা নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই বরং গর্ব।কিন্তু ডিজাটাল করতে গিয়ে এর অক্সিজেন কি কেড়ে নেয়া হচ্ছে না!!স্কুলজীবনের রঙ,হাসি,সেই ভেলপুরির দোকানের সামনেকার আড্ডা কি কেড়ে নেয়া হচ্ছে না!!!সেদিন শুনলাম প্রতিটি তালায় তালায় কলাপসিবল গেট হচ্ছে,টিচারস রুম হচ্ছে।কেন??যাতে শিক্ষার্থীরা আড্ডা দিতে না পারে ক্লাস ফাকি দিতে না পারে দুষ্টমি বাঁদরামি না করতে পারে।এখন কথা হচ্ছে তবে কি স্কুলজীবন শুধুই পড়ালেখার জন্য!!তাহলে তারা স্কুলজীবনের সেই সুন্দর মুহূরতগুলো আড্ডা,মারামারি,ক্লাস ফাকি,প্রেম,খেলাধুলা এসব পাবেনা!!তারা হয়তো শিক্ষিত হবে ঠিকই তবে তাদের ভিতরে কি আর কোন স্বপ্ন,আশা,ভালোবাসা থাকবে!এসব ভেবে উদয়ন নিয়ে ভাবা বাদই দিসিলাম।সেদিন পত্রিকায় উদয়ন নিয়ে একটা খবর দেখে চোখ আটকে গেলো।যতই চাপা ক্ষোভ থাকুক,অভিমান থাকুক ভালোতোবাসি এই উদয়নকে।তাই বিস্তারিত পড়লাম।পড়ে যা দেখলাম ঘটনা অতি সাধারণ শিক্ষক দ্বারা ছাত্র নির্মমভাবে নির্যাতিত।ঘটনা যদিও অতি সাধারণ তাও এরূপ নিন্দনীয় ঘটনাটা উদয়নের সাথে যায়না। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো তাই আজ নিজে বহুদিন পর উদয়ন ছুটে যাই।যেয়ে দেখি অবস্থা আরো সুনন্দিত।যে শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকে রক্ষা করতে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের চেষ্টার শেষ নায়।তবে কেন তার এত চেষ্টা এ নিয়ে অনেক সিনিয়র শিক্ষকও নিশ্চিত নন।এক রকম স্বৈরাচার শাসন চলছে।ছাত্র,সিনিয়র শিক্ষকমন্ডলী কেউ মত প্রকাশের সুযোগ পায়না।তবে কার কাছে যেন শুনলাম ম্যাডামের এসকল চেষ্টা নাকি উদয়নের রেপুটেসন রক্ষা করতে।উদয়নের রেপুটেসন এখন কই তা ঐ দিনই বুঝে গেছিলাম যেদিন কানে এসেছিলো এক দারোয়ান এক মহিলা গার্ডিয়ান ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় তা নিয়ে প্রিন্সিপ্যাল একরকম নিরবই রয়।এখন তো ছাত্রদের রঙ্গিন স্কুলজীবন কেড়ে নিয়ে উদয়নের রেপুটেসন রাখা হচ্ছে,সেদিন হয়তো দূরে নেই যেদিন রেপুটেশনের জন্য ছাত্রদের রক্ত বেচা শুরু হয়ে যাবে।হয়তো হয়েও গেছে "নাদিম" নামক শিক্ষার্থীর রক্ত ঝরার মাধ্যমে।আর এক্স দের প্রতি বর্তমান ডিজিটাল উদয়নের আচরণ নিয়ে নাই বা বললাম।তবে এক্স উবিয়ান হিসেবে শুধু আগের মত আমার সেই লাল ইটের বিদ্যালয়ে দূর থেকে শুনতে চাই ছোট ভাইবোনদের হাসি,খুনসুটি,কিছু লেজেন্ড টিচারদের প্রাপ্য সম্মান,তাদের গর্জন,আর ভালোবাসার সেই উদয়ন।এসব ভাবতে ভাবতে মনের ভিতর হাহা করে হেসে উঠলাম পা বাড়ালাম বাড়ির দিকে।দিনশেষে এর আঙ্গিনায় প্রাণ ভরে অক্সিজেন কবে নিতে পারবো জানিনা,জানিনা আর হুংকার করে কবে বলতে পারবো "দেখ আমার স্কুল!!!আমার উদয়ন,ভালোবাসার উদয়ন।"
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১০:৩৭