আমি বাংলাদেশের নাগরিক, একজন শিক্ষিত নাগরিক। অনেক বেশি উচ্চশিক্ষিত না হলেও যে কেউ আমাকে শিক্ষিতই বলবে। আমি এই দেশেই জন্মেছি, বড় হয়েছি, শিক্ষা অর্জন করেছি। আমি যখন এসএসসি পরীক্ষা দিলাম তখন পরিচিত অনেকেই বলেছিল এই দেশে না থেকে দেশের বাইরে চলে যেতে। বলেছিল পড়াশোনা করে কিচ্ছু হবেনা, অনেক টাকা রোজগার করতে হলে দেশ ছেড়ে বিদেশ পাড়ি দিতে হবে। তখন আমার সাথের অনেক বন্ধুরাই চলে গিয়েছিল দেশের বাইরে। কিন্তু আমি বলেছিলাম আমার অনেক টাকার প্রয়োজন নাই, আমার শিক্ষা অর্জন করতে হবে আর নিজের মেধাকে নিজের দেশের কাজেই ব্যবহার করতে হবে। আজ আমি দেশকে কিছু দেয়ার সময় হয়েছে, কিন্তু দেশ আমাকে কোনো সুযোগই দিতে পারেনি।
মূল কথায় আসা যাক, পিছনের সাড়ির বন্ধুগুলো আজ প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু আমরা প্রথম সাড়ির কয়েকজন আজও ভালো কিছু করে উঠতে পারিনি। বাংলাদেশ শিক্ষার দিক দিয়ে নিঃসন্দেহে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। আগে বাবা-মা সন্তানকে পিটিয়েও স্কুলে পাঠাতে পারতেননা, কিন্তু বর্তমানে বাবা-মা না চাইলেও সন্তান স্কুলে চলে চলে যায় নিজের তাগিদেই। সবাই বলবে এই পরিবর্তনটা যেকোনো দেশের জন্য অনেক ভালো একটি বার্তা। কিন্তু আমি বলবো, আমাদের এই বাংলাদেশের জন্য এই পরিবর্তনটা অশুভ ফলাফল বয়ে নিয়ে এসেছে।
উদাহরণ, বর্তমান চাকরির বাজার।
কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করলে আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারিঃ
- প্রথমত, আমরা সবাই জানি বাংলাদেশে বর্তমানে শিক্ষিতের হার অনেক বেশি, কিন্তু সেই পরিমাণ কর্মক্ষেত্র নেই বললেই চলে।
- যতটুকুই কর্মক্ষেত্র রয়েছে সেখানে মেধাবীরা স্থান পায়না, স্থান পায় পয়সাওয়ালারা
- আপনার পর্যাপ্ত পরিমাণ পয়সা নেই, কোনো সমস্যা নেই মামা-খালু আছে
- মামা-খালু নেই, কোনো সমস্যা নেই দলীয় ক্ষমতা আছে
- দলীয় ক্ষমতা নেই, কোনো সমস্যা নেই কোটা আছে
- আপনার উপরের কোনটিই নেই, সমস্যা নেই একটি পদবি আপনার জন্যই খোলা আছে, ‘আপনি বেকার’।
এইভাবে আমাদের দেশে অনেক ছেলে বছরের পর বছর একটি চাকরির জন্য বেকার সময় কাটাচ্ছে। অনেক ছেলে বাবার কষ্টের কামানো টাকায় দিনের পর দিন নিজের পেট চালাচ্ছে। অনেকের মনেই হয়তো একটা প্রশ্ন চলে আসে, বেকার বসে না থেকে ছোট খাটো কিছুও কি করা যায়না? আমি বলবো ভাই করা যায়, কিন্তু সেটা আমাদের দেশে না। কারণ আপনি অনেক পরাশোনা করেছেন, এইটা আপনার পায়ে শিকল ছোট খাটো কিছু করার জন্য। আপনি বড় কিছু করার যোগ্যতা অর্জন করেছেন, আপনার সমাজ আপনাকে যেকোনো কাজ করতে দিবেনা। আপনার সমাজ আপনাকে বলবে এই কাজ তোমাকে মানায়না, তুমি ভালো কিছু কর।
নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে একটি ছোট্ট ঘটনা শেয়ার করছি,
ধানমন্ডি ২৭ নাম্বার থেকে আসাদগেট যেতে রাস্তার পাশে একটি ফুলের দোকান আছে, একদিন আমি সেখানে ফুল কিনতে গিয়েছিলাম। আমি যখন সেখানে গেলাম, আমার আগে কলেজপড়ুয়া একটি ছেলে ফুল কিনছিল। ফুল বিক্রেতার সাথে ফুলের দাম তার নিয়ে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল। ছেলেটি চলে যাওয়ার আগে আমাকে লক্ষ্য করে একটি কথা বলে গেল, “সবকিছু বাদ দিয়ে ফুলের ব্যবসা করা দরকার, এখানে অনেক লাভ”। মজা পেয়েছিলাম ফুল বিক্রেতার উত্তরটা শুনে, “পড়াশোনা করতেছেন বড় অফিসার হবেন, এই কাজ করবেন কেন?”
তাই বলছিলাম যেকোনো কাজ চাইলেই আপনি করতে পারবেন না, আমাদের দেশে এটা সম্ভব না, এই কাজ আপনাকে মানায় না। আপনি যদি শিক্ষিত না হতেন তাহলে আপনার যেকোনো কাজ করতে কোনো বাধা ছিলনা।
সবকিছু বিবেচনা করে আমি বুঝলাম বাংলাদেশে এই শিক্ষার হার বৃদ্ধি কোনো প্রয়োজন নাই, প্রয়োজন কর্মক্ষেত্রের। শিক্ষিত হওয়াটা আজ অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে। বাংলাদেশ উন্নত, অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ এই নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই। কারণ আমার টাকা নেই আমি বেকার, আমার মামা-খালু নেই আমি বেকার, আমার দলীয় ক্ষমতা নেই আমি বেকার, আমার কোটা নেই আমি বেকার। মোটকথা, “আমি শিক্ষিত তাই আমি বেকার”।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৪০