somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দংশন (আগাথা ক্রিস্টির 'স্যাড সাইপ্রেস' উপন্যাসের অনুবাদ) - পার্ট ২

১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম খণ্ড



হাতে ধরা উড়ো চিঠিটার দিকে অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে এলেনর কার্লাইল। সস্তা কাগজে লেখা চিঠিটা ভুল বানানে ঠাসা।

শাবধান,
নাম বলবো না, কিন্তু একজন তোমার ফুপুকে ত্যালাচ্ছে আর শাবধান না হইলে শম্পত্তি হাতছারা হবে। মেয়ে চালু আছে আর ত্যালাইলে বয়স্ক মহিলারা খুশি হয় তারাতারি আশো দেখো কি হচ্ছে তুমি আর সাহেব পাওনা কেন পাবা না- মেয়ে বহুত চালু আর মহিলা যেকোন সময় ঠুশ।
তোমাদের শুবাকাংখি


ঘরে রডির আগমন ঘটলো।

সবসময়ের মতই রডিকে দেখে এলেনরের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। হঠাৎ প্রচণ্ড আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো তার মাঝেই, যেটা সাথে সাথেই ঢাকতে হলো তার। সে স্পষ্ট জানে রডিকে সে যতটা ভালোবাসে, রডি তাকে ততটা ভালোবাসে না। আজব লাগে- এত সাধারণ একটা লোক কী অসাধারণ হতে পারে! যাকে এক নজর দেখলেই চারপাশের দুনিয়াটা চক্কর দেয়, যার কণ্ঠ শুনলে কেমন যেন... কান্না পায়। ভালোবাসা না আনন্দের এক অনুভূতি? ভালোবাসার তো কষ্ট দেয়ার কথা না।

একটা জিনিস পরিষ্কার: এটা কখনোই প্রকাশ হতে দেয়া যাবে না। ছেলেরা অন্ধ অনুরাগ চায় না। রডি তো না-ই।

হালকা চালে বললো সে, ‘হ্যালো, রডি!’
‘হ্যালো ডার্লিং। তোমাকে এমন লাগছে যে? বিল নাকি ওটা?’
মাথা ঝাঁকিয়ে না বললো এলেনর। ‘উদ্ভট একটা উড়ো চিঠি।’
রডির খুঁতখুঁতে চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। ‘তাই নাকি?’
‘মনে হয় ছিঁড়ে ফেলাটাই ভালো হবে।’

প্রায় ছিঁড়ে ফেলেছিলোও এলেনর। পরমুহূর্তেই সিদ্ধান্ত পাল্টালো সে।

‘তুমি পড়ে দেখো। লরা ফুপুর কথা লিখেছে।’
চিঠি পড়ে বিরক্ত হলো রডি। সে-ও রাজি হলো পোড়াতে।

‘মনে হয় চাকরদের কারো কাজ।’
‘তাইতো মনে হয়। আচ্ছা, যে মেয়েটার কথা লিখেছে, সে কে হতে পারে?’ ইতস্তত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো রডি।
‘নিশ্চয়ই মেরি জেরার্ড।’
‘ওটা আবার কে?’
‘ছোট লজটায় যে থাকে, তার মেয়ে। ছোটবেলায় চিনতে ওকে। লরা ফুপু খুব পছন্দ করেন ওকে। ওর পড়াশোনার সব খরচ দিয়েছেন। সাথে পিয়ানো, ফ্রেঞ্চসহ আরও অনেক কিছু শেখার পয়সা দিয়েছেন।’
‘মনে পড়েছে। শুকনোমত মেয়েটা যে। মাথাভর্তি সোনালি চুল।’
‘হ্যাঁ, তুমি আমার মত এত ঘন ঘন হান্টারবেরি যাওনি বলে চিনছো না। ছোটবেলায় আমরা একসাথে খেলতাম। এখন ও দেখতে বেশ সুন্দর হয়েছে। পড়াশোনা করে বেশ ভদ্রও হয়েছে। মনেই হয়না ও জেরার্ডের মেয়ে।’
‘পুরোদস্তুর ভদ্রমহিলা তাহলে?’
‘হ্যাঁ। মনে হয় এজন্যই বাপের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না। মা-ও তো গেছে কয়েক বছর আগে। ভদ্রলোকি দেখতে পারে না ওর বাবা।’
‘ এই ‘পড়াশোনা’ করিয়ে মাঝেমধ্যে উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়,’ বিরক্ত স্বরে রডি বললো।
‘ও মনে হয় আসলেও আমাদের বাড়িতে অনেক বেশি যাওয়া-আসা করে। ফুপুর স্ট্রোকের পর থেকে তাকে বই পড়ে শোনায় ও।’
‘নার্স পড়তে পারে না?’
হাসলো এলেনর। ‘নার্স ও’ব্রায়েনের যে সাংঘাতিক আইরিশ উচ্চারণ!’

নার্ভাস ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ পায়চারি করলো রডি। তারপর বলে উঠলো, ‘এলেনর, আমাদের মনে হয় ওখানে যাওয়া উচিত।’
‘এই- সবের জন্য?’
‘না না! বোটেই না। ধুত্তোর! সত্যি বলতে কি, হ্যাঁ। কিছু সত্যতা তো থাকতে পারে। মানে, চাচীর শরীর তো আসলেও বেশ খারাপ...। তাছাড়া তোমার-আমার টাকাটারও দরকার, এলেনর।’
‘তা ঠিক।‘
‘এমন না যে আমি অর্থলোভী। কিন্তু ফুপু নিজেই বারবার বলেছেন আমরাই ওনার একমাত্র রক্তের সম্পর্ক। তুমি ওনার ভাতিঝি, ওনার স্বামী আমার আপন চাচা। চাচী বলেছেন সব আমাদেরই হবে। তাছাড়া টাকা তো কম পাবো না...’
‘ঠিকই বলেছো।’
‘হান্টারবেরি দেখাশোনার খরচ বিশাল। বিয়ের সময় চাচা স্বচ্ছল ছিলো বটে, কিন্তু তোমার ফুপুর ছিলো অগাধ সম্পত্তি। উনি আর তোমার বাবা, কারোরই টাকার অভাব ছিলো না। দুঃখ, তোমার বাবা নিজেরটা খোয়ালো।’
‘ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে বাবা একেবারেই আনাড়ি ছিলো। বাবা মরেছেও অনেক চিন্তা নিয়ে।’
‘লরা চাচীর মাথা সেদিক দিয়ে ভালো ছিলো। হেনরি চাচাকে বিয়ে করে উনি হান্টারবেরি কিনেছিলেন। যেখানে টাকা ঢেলেছেন, কোনোটাতেই পস্তাননি।’
‘ফুপা মরার সময় তো সব ফুপুর নামে লিখে দিয়েছিলেন, না?’
‘হ্যাঁ। চাচা মরলোও অল্প বয়সে। চাচী বেচারি আর বিয়ে করলেন না। আমাকে রক্তের সম্পর্কের মত দেখেছেন সারাজীবন। বিপদে-আপদে সাহায্যও করেছেন।’
‘আমার জন্যও অনেক করেছেন উনি।’
‘সত্যি বলতে কী এলেনর, আমরা দুজন তো কম খরচ করি না।’
‘তা ঠিক’, দুঃখী গলায় বললো এলেনর। ‘সবকিছুর দাম এত বেশি! কাপড়, গয়নাগাটি... সাথে সিনেমা, ককটেল... মরার গ্রামোফোন রেকর্ডেও কত টাকা বেরিয়ে যায়।’
‘তোমাকে আমার কেন এত ভালো লাগে জানো? কারণ তুমি কেমন যেন দূরে দূরে থাকো। মাথা বেশি ঘামিও না। চাচী তো আছেন, নইলে তোমাকে চাকরি খুঁজতে বেরোতে হতো। আমার বেলায়ও তাই। আমার লুইস অ্যান্ড হিউমের চাকরিটা হচ্ছে বলতে গেলে লোক দেখানো। ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা নেই আমার অত। চাচী আছেন।’
‘আমাদের সাথে দেখি জোঁকের কোনো পার্থক্য নেই।’
‘দেখো, আমাদের উনি সারাজীবন বুঝিয়ে গেছেন টাকা আমরাই পাবো।’
‘ঠিক কীভাবে পাবো বলেছেন কিছু?’
‘তাতে কী? আমাদের দুজনের মাঝেই নিশ্চয়ই ভাগ করেছেন। তা না হলে পুরোটা বা বেশিরভাগ রক্তের হিসাবে তুমি পেলে সেটা আমিও পাবো, কারণ আমি তোমাকে বিয়ে করছি, আর যদি ওয়েলম্যান পরিবারের পুরুষ প্রতিনিধি হিসেবে সম্পত্তি আমি পেলে তুমিও সেটা একইভাবে পাচ্ছো। ভাগ্য ভালো আমরা একে অন্যকে ভালোবাসি। তুমি আমাকে ভালোবাসো তো, না?’
‘হ্যাঁ’, বাইরে দিয়ে শীতল কণ্ঠে জবাব দিলো এলেনর।
‘তোমার এই শীতলতার জন্যই আমি তোমাকে এত ভালোবাসি, এলেনর। কিছু কিছু মেয়ে থাকে একদম লেগে থাকা স্বভাবের, কী ভাবছে না ভাবছে সব ঢোল পিটিয়ে বলে বেড়ায়। কিন্তু তোমার বেলায় কী হবে কেউ আন্দাজ করতে পারে না। যেকোনো মুহূর্তেই তুমি চোখের পাতা একটুও না কাঁপিয়ে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলতে পারো,’ বলে চললো রডি, ‘আমাদের সংসার হবে একদম ঠিকঠাক। আমরা অতিরিক্ত প্রেম-পিরিতি দেখানোর মধ্যে নেই। তাছাড়া আমরা রক্তের সম্পর্ক না হয়েও আত্মীয়তার সুবিধাটা পাচ্ছি। লরা চাচী যেহেতু আমাদের ব্যাপারটা জানেন, তাই মনে হয় আমাদের যাওয়া উচিত। অনেকদিন যাওয়াও হয় না। প্রায় দুই মাস হয়ে গেলো। আত্মীয়তার খাতিরেই যাওয়া উচিত।’

রাজি হলো এলেনর।

‘কে জানে চিঠিটা কে লিখেছে? উপকারই হলো একদিক থেকে। মনে আছে, জিম প্যাটারসনের মা বিদেশ গিয়ে যে এক চ্যাংড়া ইতালিয়ান ডাক্তারের মোহে পড়ে তাকেই সব সম্পত্তি লিখে দিয়েছিলো? জিম আর তার বোনরা উইলটা আর বদলাতে পারেনি।’
‘লরা ফুপু ডা. রানসামের জায়গায় আসা নতুন ডাক্তারকে বেশ পছন্দ করে, তবে অমন পাগলের মত না,’ উত্তর দিলো এলেনর।

-

মিসেস ওয়েলম্যানের ঘর থেকে বেরিয়ে নার্স ও’ব্রায়েন বললো, ‘যাওয়ার আগে এক কাপ চা খেয়ে যাও, নার্স? নার্স হপকিন্সের সম্মতিতে পানি বসালো ও’ব্রায়েন।

নার্স ও’ব্রায়েনের বয়স ত্রিশ। হালকা তিলে ছাওয়া মুখের লালচুলো লম্বা এই নার্স সদাহাস্যোজ্জ্বল বলে রোগীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। ডিস্ট্রিক্ট নার্স হপকিন্স মাঝবয়সী মহিলা, প্রতিদিন আসেন বিশাল গড়নের মিসেস লরা ওয়েলম্যানের বিছানা ঠিক করতে আর টয়লেটে সাহায্য করতে। বাড়িটা বেশ ভালো লাগে তার। ও’ব্রায়েনও একমত,

‘হ্যাঁ, বাড়িটা পুরনো, কিন্তু গ্যাস-বিদ্যুৎ সবই আছে। কাজের মেয়েগুলো কথা শোনে। মিসেস বিশপও সবকিছু যত্ন নিয়ে দেখে রাখে।’
‘তবে আজকালকার মেয়েদের নিয়ে আমি আর পারি না। একটা কাজেরও আগা-মাথা নেই ওদের’, কিছুটা দ্বিমত হপকিন্সের।
‘মেরি জেরার্ড মেয়েটা অবশ্য সবদিক থেকেই ভালো’, বললো ও’ব্রায়েন। ‘মিসেস ওয়েলম্যান ওকে ছাড়া কী করবেন কে জানে?’
‘মেরির জন্য আমার খুব খারাপ লাগে। বাপটা দুই চোখে দেখতে পারেনা ওকে।’
কেটলির আওয়াজ শোনা গেলো। মিসেস ওয়েলম্যানের পাশের ঘরে চা নিয়ে বসলো দুজন।
‘সকালে টেলিগ্রাম এসেছে। মি. ওয়েলম্যান আর মিস কার্লাইল আসছেন আজকে।’
‘এজন্যেই বলি মহিলা এত খুশি কেন’, বললো হপকিন্স। ‘অনেকদিন পর এলো, না?’
দুই মাসেরও বেশি হবে। মি. ওয়েলম্যান দেখতে ভালোই, তবে কেমন যেন অহংকারী লাগে।’
‘মিস কার্লাইলকে একবার আমি কাগজে দেখেছিলাম এক বন্ধুর সাথে ঘুরতে।’
‘ অনেক মানুষের সাথে মিস কার্লাইলের পরিচয় আছে। সুন্দর সুন্দর জামাও পরে সবসময়। ওনাকে দেখতে দারুণ লাগে, কী বলো নার্স?’
‘এত মেকআপের নিচে বোঝা কঠিন আজকালকার মেয়েরা কেমন। তবে আমার মতে মেরি জেরার্ডের ধারেকাছেও নেই উনি।’
‘তা ঠিক, তবে স্টাইল বলতে যা বোঝায়, মেরির সেটা নেই’, বললো ও’ব্রায়েন।

চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছে। সাথে গভীর হচ্ছে আলাপ।

‘জানো? কালকে রাতে আজব একটা ঘটনা ঘটেছে। রাত দুইটায় আমি মিসেস ওয়েলম্যানকে দেখতে গিয়ে দেখি উনি জেগে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘ছবিটা দাও।’ আমি বললাম, ‘নিশ্চয়ই, কিন্তু সকালে দেখলেই বেশি ভালো হয় না?’ উনি বললেন, ‘না, এখনই।’ তো আমি বললাম, ‘মি. রডরিকের ছবি?’ উনি তখন বললেন, ‘রডরিক? না, লুইস।’ ওনাকে আমি তারপর ধরে বসালাম। উনি বিছানার পাশের বাক্স থেকে চাবি বের করে আমাকে বললেন ওয়ার্ডরোবের দুই নম্বর ড্রয়ারটা খুলতে। খুলে দেখি রূপালি ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবি। অপূর্ব সুন্দর চেহারার একটা লোক। ফ্রেমের কোণায় লেখা ‘লুইস’; অনেক পুরনো ছবি। ছবিটার দিকে উনি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন, ‘লুইস, লুইস’ করে বিড়বিড় করলেন, তারপর আমাকে বললেন ছবিটা রেখে দিতে। ছবিটা রেখে উল্টা ঘুরে দেখি উনি গভীর ঘুমে।’

ও’ব্রায়েনের বিবরণের পর হপকিন্স জিজ্ঞাসা করলো, ‘ওনার স্বামীর ছবি নাকি?’
‘না। সকালে মিসেস বিশপকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম মি. ওয়েলম্যানের নাম কী ছিলো। বললো ‘হেনরি’।
নার্স হপকিন্স ভাবতে লাগলো, কিন্তু ভেবে পেলোনা লুইসটা কে।
‘অনেক আগের ছবি কিন্তু’, মনে করিয়ে দিলো ও’ব্রায়েন।
‘হ্যাঁ, তা ঠিক। আমি এখানে আছি তো মাত্র কয়েক বছর।’
‘লোকটা দেখতে যা সুন্দর ছিলো, কী বলবো! সেনাবাহিনীর অফিসার মনে হলো দেখে। হয়তো দুজনের প্রেম ছিলো, বাবা মেনে নেয়নি...’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে হপকিন্স বললো, ‘কিংবা হয়তো সে যুদ্ধে মারা গেছে...’

-

চা আর গল্প শেষে বাড়ি থেকে বের হতেই নার্স হপকিন্সের পেছন পেছন দৌড়ে এলো মেরি জেরার্ড।
‘আমি একটু হাঁটি আপনার সাথে?’
‘নিশ্চয়ই, সোনামণি।’
‘আপনার সাথে আমার অনেক কথা আছে,’ বললো মেরি। ‘আমার না অনেক দুশ্চিন্তা হয়।’

একুশ বছর বয়সী মেরি জেরার্ডকে প্রায় অপ্সরী বললেও ভুল হবে না। লম্বা ঘাড়জুড়ে এলিয়ে থাকা ঢেউ খেলানো সোনালি চুল আর জ্বলজ্বলে গাড় নীল চোখ দুটো অন্য এক রূপ দিয়েছে তাকে।

‘কী হয়েছে?’
‘আমি বুঝে উঠতে পারছি না কী করবো। আর কয়দিন এমন বেকার থাকা যায়?’
‘সময় তো এখনও ফুরিয়ে যায়নি তোমার।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু কেমন যেন লাগে! মিসেস ওয়েলম্যান এত পয়সা ঢেলে আমাকে পড়িয়েছেন, আমার তো কিছু একটা করা উচিত। আমি ওনাকে বুঝিয়েছি, কিন্তু উনি বলেন আমার হাতে আরও সময় আছে।’
‘ওনার শরীর যে খারাপ ভুলে যেও না।’
‘তা ঠিক, কিন্তু বাবাও খুব ঝামেলা করছে। ‘ভদ্রমহিলা’ হওয়া নিয়ে সারাক্ষণ খোঁটা দিচ্ছে। কিছুর যে ট্রেনিং নেবো, তারও তো খরচ অনেক। আমি ভালো জার্মান পারি, সেটা দিয়ে কিছু করা যায়, কিন্তু আমার ইচ্ছা হাসপাতালের নার্স হওয়া। আমি পারবো। সেবা করার কাজটা আমার ভালো লাগে। তাছাড়া আমার এক খালা নিউজিল্যান্ড থাকেন, উনি নার্স। কাজেই নার্সিং আমার রক্তেও আছে বলা যায়।’
‘তুমি ম্যাসাজ করা শিখতে পারো। ভালো টাকা আসে।’
‘খরচ তো অনেক... উনি এমনিতেই অনেক করেছেন আমার জন্য’, দ্বিধাভরা কণ্ঠে বললো মেরি।
‘মিসেস ওয়েলম্যান তোমাকে পড়াশোনা করিয়েছেন, কিন্তু সেগুলো কাজে আসার মত না। ওনার এখন এটা দায়িত্ব। আচ্ছা, তুমি তো স্কুলেও পড়াতে পারো।’
‘আমার অত বুদ্ধি নেই।’
‘বাজে কথা বোলো না। দেখো, মিসেস ওয়েলম্যান তোমাকে খুব পছন্দ করেন, তাই চোখের আড়াল করতে চান না। অসহায় মানুষ, শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে আছে। এর মাঝে তোমার মত কেউ পাশে থাকলে ভালো লাগে না?’
‘ওনাকে আমার এত ভালো লাগে! ওনার জন্য আমি সব করতে পারি।’
‘তাহলে তুমি যেখানে আছো সেখানেই থাকো আর দুশ্চিন্তা বন্ধ করো। আর বেশিদিন নেই এমনিতেও।’
‘আপনি কি বলতে চাচ্ছেন-’ মেরির চোখে ভয়।
‘ওনার স্বাস্থ্য ভালো, কিন্তু সেটা বেশিদিন থাকবে না। আরেকটা স্ট্রোক হবে, তারপর আরেকটা। ওনার শেষ দিনগুলো আনন্দে রাখো, সেটাই অনেক বড় কাজ। আরো তো সময় আছে। ওই যে, তোমার বাবা আসছে। তার মেজাজ দেখি ভালো না।’

বড় লোহার গেটের কাছে চলে এসেছে দুজন। লজের সামনের সিঁড়ি ধরে বাঁকা হয়ে নেমে আসছে একজন বয়স্ক লোক।

‘শুভ সকাল, মি. জেরার্ড। সুন্দর একটা দিন, কী বলো?’ হাসিমাখা গলায় বললো নার্স হপকিন্স।
মুখ কুঁচকে জবাব দিলো এফ্রেইম জেরার্ড, ‘তোমার জন্য হতে পারে, আমার জন্য না। পিঠের ব্যথায় জান শেষ।’
‘এখন একটু গরম পড়েছে। ব্যথা আস্তে আস্তে কমে যাবে।’
‘তোমরা সব নার্সরাই এমন। মানুষের কষ্টের সময় খুব হাসি বের হয় তোমাদের মুখ দিয়ে। মেরিটাও এখন নার্স হয়ে চায়। ওসব ঢংয়ের পড়াশোনা করে আর বিদেশে থেকে এসে এর চেয়ে ভালো কিছু হওয়া যায় না?’
‘নার্স হওয়াই আমার জন্য যথেষ্ট’, শক্ত কণ্ঠে মেরি জবাব দিলো মেরি।
‘তারপর? নার্সদের মত অকর্মাই তো হবে! আলসেমিই তো তোমার ভালো লাগে, তাই না?’
চোখে পানি এসে গেলো মেরির।
‘আজকে মেজাজটা একটু বেশিই খারাপ তোমার দেখছি। কিন্তু মেরির ওপর ঝাল ঝেড়ো না। তোমার মেয়েটা অনেক খেয়াল রাখছে তোমার।’
নিষ্ঠুর চেহারায় মেয়ের দিকে তাকালো জেরার্ড। ‘ও আমার মেয়ে না! এসেছেন চৌদ্দ জিনিস শিখে ভদ্রমহিলাগিরি ফলাতে! ছ্যাঃ!’
ঘরে ঢুকে গেলো সে।
ছলছল চোখে নার্সের দিকে তাকালো মেরি। ‘দেখেছেন অবস্থা? ছোট থাকতেও বাবা আমাকে দেখতে পারতো না। মা-ই ছিলো আমার সব।’
‘থাক। সব ঠিক হয়ে যাবে’, সান্ত্বনা দিলো নার্স হপকিন্স। ‘আমি বরং এখন যাই। অনেক জায়গায় যেতে হবে আমার।’


বড় একা আর অসহায় লাগছে মেরি জেরার্ডের। নার্স যতই স্নেহ করুক, এর বাইরে তার আর কী করার আছে?

‘কী করবো আমি?’

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১:১৮
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আমার ড্রোন ছবি।

লিখেছেন হাশেম, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩

বৃহত্তর প্যারিস তুষারপাত।

ফ্রান্সের তুলুজ শহরে বাংলাদেশের প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনার।

হ্যাসল্ট, বেলজিয়াম।

ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী ফ্রান্সের ফ্রিওল আইল্যান্ড।


রোডেসিয়াম এম রেইন, জার্মানি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতার সুফল কতটুকু পাচ্ছে সাধারণ মানুষ

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:২৮

(১) আমলা /সরকারের কর্মকর্তা, কর্মচারীর সন্তানদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব হতাশাজনক। মুক্তিযুদ্ধের ১৯৭১ সালের রক্ত দেওয়া দেশের এমন কিছু কখনো আশা কি করছে? বঙ্গবন্ধু এমন কিছু কি আশা... ...বাকিটুকু পড়ুন

এলজিবিটি নিয়ে আমার অবস্থান কী!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১০ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৫

অনেকেই আমাকে ট্রান্স জেন্ডার ইস্যু নিয়ে কথা বলতে অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়ে একজন সাধারণ মানুষের ভূমিকা কী হওয়া উচিত- সে বিষয়ে মতামত চেয়েছেন। কারণ আমি মধ্যপন্থার মতামত দিয়ে থাকি। এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলমানদের বিভিন্ন রকম ফতোয়া দিতেছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩


আপন খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুফাতো বোনের বা ছেলের, মেয়েকে বিবাহ করা যায়, এ সম্পর্কে আমি জানতে ইউটিউবে সার্চ দিলাম, দেখলাম শায়খ আব্দুল্লাহ, তারপর এই মামুনুল হক ( জেল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×