৩
গত রাতে আপনার ফুপু আবার স্ট্রোক করেছেন খুব বেশি চিন্তা করবেন না তবে যত দ্রুত সম্ভব চলে আসুন লর্ড।
টেলিগ্রাম পেয়েই রডিকে ফোন দিয়েছে এলেনর। দুজনেই এখন হান্টারবেরির ট্রেনে।
হান্টারবেরি থেকে ফেরার পর এক সপ্তাহ রডির সাথে তেমন একটা দেখা হয়নি এলেনরের। যে দুইবার দেখা হয়েছে, দুজনের মাঝে কেমন যেন একটা বরফ অনুভূত হয়েছে। রডি তাকে ফুল পাঠিয়েছিলো, যেটা তার জন্য অস্বাভাবিক। দুজনে যখন একসাথে ডিনার করেছে , তখন এলেনরের চাহিদার প্রতি বেশ নজর রেখেছে রডি। ঠিন যেন প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া হবু বর।
‘সব তোমার কল্পনা’, নিজেকে প্রবোধ দিয়েছে এলেনর। অন্যদিকে সে যেন রডির থেকে আরো দূরে সরে গেছে, তার আচরণে এমনই মনে হচ্ছে।
মিসেস ওয়েলম্যানের দ্বিতীয় স্ট্রোকের পর থেকে দুজন আবার স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে।
‘বেচারি ফুপু এমনিতেই আর পারছিলো না, তার ওপর এখন অবস্থা আরো খারাপ হলো। রডি, আমার মনে হয়, কেউ যদি নিজে থেকে চায়, তাহলে তাকে এত কষ্ট থেকে মুক্তি দেয়াই উচিত।’
একমত হলো রডি। ‘জন্তু-জানোয়ারের বেলায় করা গেলে মানুষের বেলায় কেন করা যাবেন না? সম্পত্তি, বুঝলে? সম্পত্তি পাওয়ার আশাতেই মানুষ সেটা করে না মনে হয়।’
-
বিছানার ওপর ঝুঁকে আছে ডা. লর্ড, পেছনে নার্স ও’ব্রায়েন। রোগীর মুখ থেকে বেরিয়ে আসা দুর্বোধ্য শব্দগুলো বোঝার চেষ্টা করছে ডাক্তার।
‘উত্তেজিত হবেন না। সময় নিন। হ্যাঁ বলতে চাইলে ডান হাতটা একটা ওঠালেই হবে। কিছু নিয়ে চিন্তা হচ্ছে?’
হ্যাঁ।
‘জরুরি কিছু? কিছু করতে হবে? ডাকবো কাউকে? মিস কার্লাইল আর মি. ওয়েলম্যান? ওনারা আসছেন।’
আবারও কথা বলার চেষ্টা করলেন মিসেস ওয়েলম্যান।
‘অন্য কাউকে চাচ্ছেন? আত্মীয়? না? কাজের কথা? আচ্ছা। টাকা-পয়সার ব্যাপার? উকিল? আপনার উকিলকে দেখতে চান? তাকে কিছু করতে বলবেন? ঠিক আছে। সময় নিন। কী বলছেন? এলেনর? উনি আপনার উকিলকে চেনেন? উনি ব্যবস্থা করবেন? হ্যাঁ, হ্যাঁ। উনি এখনই চলে আসবেন। আমি ওনাকে সব খুলে বললো। আপনি চিন্তা করবেন না।’
রোগীকে শান্ত করে পাশের ঘরে গেলো ডাক্তার লর্ড। নার্সদের কী কী করতে হবে সব বলা হলো। নার্স হপকিন্স রাতে থাকবে। থাকার জন্য আরেকজন নার্স খোঁজা হবে পরদিন। নির্দেশনা শেষে ডাক্তার নিচতলায় নেমে এলো এলেনর আর রডির অপেক্ষায়। সিঁড়িতে দেখা হলো মেরির সাথে।
‘ওনার শরীর এখন কেমন, ডাক্তার সাহেব?’
‘রাতে ভালো ঘুম হবে বড়জোর। আর কিছু করার নেই।’
ভেঙে পড়লো মেরি। তাকে সান্ত্বনা দিলো ডাক্তার। পরক্ষণেই গাড়ি আসার শব্দ শুনে মেরি ওপরতলায় চলে গেলো। ভেতরে এলো এলেনর আর রডি। দুজনেরই চেহারা উদ্বিগ্ন। ফুপুর খবর জানতে চাইলো এলেনর।
‘প্যারালাইসিস একেবারে শেষ করে দিয়েছে ওনাকে এবার। ওনার কথা বোঝা যাচ্ছে না। আর হ্যাঁ, ওনার উকিলের কথা বলছিলেন উনি। আপনি নাকি তাকে চেনেন, মিস কার্লাইল।’
‘মি. সেডন। ব্লুমসবেরি স্কয়ারে তার অফিস। কিন্তু এই সময়ে ওনাকে অফিসে পাওয়া যাবে না। আর আমি ওনার বাসার ঠিকানাও জানি না।’
‘ওনাকে কালকে ডাকলেও চলবে। তবে আমি চাচ্ছি ওনাকে যত দ্রুত সম্ভব শান্ত করতে। আপনি বরং আমার সাথে ওপরে আসুন।’
‘আমার তো যাওয়ার দরকার নেই, না?’ নিজেকে নিয়ে কিছুটা লজ্জিত শোনালো রডিকে।
‘আপনার এখন না আসলেও চলবে, মি. ওয়েলম্যান।’
রডির চেহারায় স্বস্তির ছাপ ফুটে উঠলো। ওপরে গেলো ডাক্তার আর এলেনর।
লরা ওয়েলম্যানের দিকে অপলক চেয়ে রইলো এলেনর, যেন বিশ্বাস করতে পারছে না সে। হঠাৎ চোখ খুললেন মিসেস ওয়েলম্যান। এলেনরকে দেখে চেহারায় পরিবর্তন এলো তার।
‘এলেনর...”
শব্দটা না জানা থাকলে বোঝার উপায় নেই উনি কী বলছেন।
‘আমি এসেছি, ফুপু। কী করতে হবে, বলো? মি. সেডনকে আসতে বলবো?’
আবারও ঘড়ঘড় শব্দ। বোঝার চেষ্টা করলো এলেনর।
‘মেরি জেরার্ড?’
হ্যাঁ-সূচক ভঙ্গি দেখে ফুপুর পরের কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করলো এলেনর। একটা শব্দ কেবল ধরতে পারলো সে।
‘অংশ? মানে, ওকে টাকার একটা অংশ দিতে বলছো? নিশ্চয়ই। মি. সেডন কালকে আসছেন। তুমি যা বলো, তা-ই হবে।’
শান্তি পেলেন ফুপু। তার দুর্বল হাতটা ধরলো এলেনর।
‘তুমি—সবকিছু—তুমি...’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি সব দেখবো। তুমি যেমন চাও, সেভাবেই হবে সব।’
হাত শিথিল হয়ে গেলো ফুপুর। ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। ডা. লর্ড রোগীর পাশে নার্স ও’ব্রায়েনকে রেখে এলেনরকে নিয়ে ঘরের বাইরে গেলো। সিঁড়ির মাথায় মেরি নার্স হপকিন্সের সাথে কথা বলছিলো। ডাক্তারের অনুমতি পেয়ে ভেতরে গেলো মেরি।
‘আপনাদের ট্রেন দেরি করেছে মনে হলো। আপনি—’ থেমে গেলো ডাক্তার।
এলেনর মেরির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলো। ডাক্তার হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়ায় তার দিকে ফিরলো সে। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মত তার দিকে তাকিয়ে আছে ডা. লর্ড। মুখ লাল হয়ে গেলো এলেনরের।
‘দুঃখিত। কী যেন বলছিলেন?’
‘কী যেন বলছিলাম...? মনে পড়ছে না দেখি। যাহোক। মিস কার্লাইল, ভেতরে দারুণ আবেগ সামলে ছিলেন আপনি। কিছুই প্রকাশ করেননি। নিজের ওপর চমৎকার নিয়ন্ত্রণ আছে আপনার বলতে হবে।’
‘আমি শিখেছি—অনুভূতি কীভাবে প্রকাশ না করতে হয়’, এলেনরের মুখ পাথরের মত।
‘মুখোশটা একদিন খুলে যেতে বাধ্য’, ধীরে ধীরে বললো ডাক্তার।
‘মুখোশ?’ এলেনর সরাসরি তাকালো ডাক্তারের দিকে।
‘মানুষের মুখ তো আসলে মুখোশ ছাড়া কিছুই না।‘
‘আর মুখোশের ভেতরে?’
‘ভেতরেই আছে মানুষের স্বরূপ।’
পেছনে ঘুরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো এলেনর। ডাক্তারও নিচতলার পথ ধরলো। রডি এগিয়ে এলো তাদের দিকে। ‘
কী হলো ভেতরে?’
‘বেচারি ফুপু। ওনাকে এভাবে দেখে মনটাই ভেঙে যাচ্ছে। তুমি বরং... উনি না ডাকলে ভেতরে যেও না।’
‘চাচী কি বিশেষ কিছুর কথা বলেছেন?’
এলেনরের কাছ থেকে বিদায় নিলো পিটার লর্ড। যাওয়ার সময় এলেনরের একটা হাত ধরলো সে। কেমন যেন সান্ত্বনা পেলো এলেনর। মনে হলো, ডাক্তারও যেন দুঃখ পাচ্ছে। লর্ড বেরিয়ে গেলে প্রশ্নটা আবার করলো রডি।
‘ফুপু কিছু—কাজ নিয়ে চিন্তিত। আমি বলেছি মি. সেডন কালকেই আসবেন। সকালে উঠেই ওনাকে ফোন করতে হবে’, উত্তর দিলো এলেনর।
‘নতুন উইল বানাবে নাকি চাচী?’
‘তেমন কিছু বলেনি আমাকে।’
‘তাহলে কী বলে—‘ প্রশ্নের মাঝখানে থেমে গেলো রডি। সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে মেরি রান্নাঘরে ঢুকেছে।
‘কী বলছিলে যেন?’ শক্ত কণ্ঠে এলেনর জিজ্ঞাসা করলো।
‘হ-হ্যাঁ? কী বলছিলাম যেন? ভুলেই গেলাম’, উদাস কণ্ঠে উত্তর দিলো রডি।
হাত মুঠো হয়ে গেলো এলেনরের। হাতের তালুতে বিঁধে যাচ্ছে তার নখ।
‘অসহ্য... অসহ্য—আমি পারবো না... কল্পনা না... এটা সত্যি... রডি—রডি, তোমাকে আমি হারাতে পারবো না... আর ডাক্তার কী বললো তখন? সে আমার চেহারায় কী দেখতে পেয়েছিলো? কিছু একটা নিশ্চয়ই দেখেছিলো... হে ঈশ্বর! আমি আর সহ্য করতে পারছি না! না... ঠাণ্ডা হও, এলেনর। স্থির হও!’
শান্ত গলায় বললো সে,
‘আমার তেমন ক্ষুধা নেই, রডি। আমি বরং ফুপুর কাছে যেয়ে বসি, নার্সরা নেমে আসুক।’
‘আমার সাথে খেতে বসবে ওরা!’ আতঙ্কিত গলায় বললো রডি।
‘তাতে কী?’ শীতল জবাব এলেনরের।
‘তুমি খাবে না? কিছু তো খাও। আমরা বরং আগে খেয়ে নিই, নার্সরা পরে আসুক।’
‘না, থাক। এভাবেই ভালো হয়’, মুখে বললো এলেনর। মনে মনে ভাবছে সে,
‘টেবিলে খেতে বসে ওর স্বাভাবিক আচরণ... গল্পগুজব- যেন কিছুই হয়নি... সহ্য করতে পারবো না আমি...’
আমি যা বলি করো তো!’ অধৈর্য হয়ে বললো সে।
(চলবে)