পাক্কা দশ ঘন্টা ঘুমিয়েছি। উঠে দেখি আটটা বাজে। বৃষ্টি তখনো থামেনি, বরং বেড়েছে। তার সঙ্গে দমকা বাতাশ। ইলেক্ট্রিসিটি নেই, তাই খুঁজে খুঁজে আধখানা মোম পেয়ে তাই জ্বালালাম। ভাবছি ফ্রেশ হয়ে, বাইরে যাব খেতে। সমস্যা হচ্ছে, মোমটাকে জ্বালিয়ে রাখা যাচ্ছেনা। বাতাসের বেগ যেন বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। কুছ পরোয়া নেহি। লাইটারটা কোমরে গুঁজে নিলাম, তারপর একহাতে মোম নিয়ে অন্যহাতে আলোকে বাতাসের থেকে আড়াল করে ধীরে ধীরে যাচ্ছি ওয়াশরুমের দিকে। বাতাসে আমার লুঙ্গি পতাকার মত উড়ছে, মোমের পুরো আলো আমার মুখে। আর একটু দূরেই বাথরুম। বাতাস বাঁচিয়ে একহাতে দরজা খুললাম। বাতাসে কেঁপে উঠল মোম! আর সেই সাথে একটা গগনবিদারী চিৎকার। হুইইইইইইইইশশশশস.........!!! মোমটা হাত থেকে পড়ে নিভে যাওয়ার আগে চোখের সামনে যা দেখলাম, তার দৈর্ঘ্য প্রায় ৬-৭ ফুট। বটগাছের মত প্রস্থ। স্থানুর মত দাঁড়িয়ে আছি! সেও দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন বাস্তব আর পরাবাস্তবের সাথে এক অলিখিত স্নায়ু যুদ্ধ চলছে। আর এই যুদ্ধে জেতা-হারার উপরই নির্ভর করছে আমার বাঁচা মরা। আমি ঘোরের মধ্যে থেকেই এক পা পেছালাম। মানে রণে ভঙ্গ দেয়া। তারপর আরেকপা। বজ্রপাতের আচমকা আলোটুকুই আমার সম্বল। পেছাতে পেছাতে প্রায় রূমের সামনে চলে এসেছি। হার্টবিট মিস করছে অবিরত, তবু ভালো ওটা চলছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। ঢোক গিলতে পারছিনা। মরে যাচ্ছি নাকি!
দরজার হাতলে হাত দেয়া মাত্রই ইলেকট্রিসিটি এল।
-'এই বাচ্চা, কে তুমি?'
একটা বাজখাই আর প্রকম্পিত কন্ঠ কানে এল। ঘরের কোনাটা এখনো অন্ধকার, তবে এখন আর তেমন ভয় লাগছেনা। ভয়ের প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠেছি ততক্ষণে।
আমি বললামঃ 'পলাশ, ফার্স্ট ইয়ার, ফার্স্ট সেমিস্টার।'
ঘরের কোনের ছায়াটা একটু নড়ে উঠল। দেখলাম সে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে।
মানুষ!
মানুষই তো!
-'হেই মিয়া, তুমি তো আমারে তব্দা লাগাইয়া দিছিলা! আরেকটু হইলেই কইলজা হজম হইয়া গেছিল! আত্মা পুরা পলিথিন হইয়া গেছেগা!
আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
আমি শুধু মিন মিন করে বললাম, আমাকে একটু পানি খাওয়াবেন?
উপরোক্ত ভদ্রলোকের নাম মোসাদ্দেক হোসেন। ৬' ২" লম্বা। ওজন ৯৫ কেজি। সিলেটে আমার প্রথম পরিচিত লোক তিনিই। আমি যখন ঘুমে ছিলাম, তখন তিনি এসেছেন মেসে। অন্ধকার থাকায় আমার ঘরের তালাটা খোলা-এটা তিনি লক্ষ করেননি। আমরা দুজনেই জানি যে, আমরা ছাড়া আর কেউ নেই মেসে, যার ফলে দুজনের এই ভূত দর্শন।
এবার শুনি উনার ভাষায় আমাকে কেমন দেখাচ্ছিল!
"আমি ড্রেস চেঞ্জ কইরা হাফ টিকিটের একটা ঘুম দিয়া ফালাইছি। হালার ম্যাচ খুইজা না পাইয়া ভাবলাম অমনেই যাই। দরজার সামনে গিয়াই দেহি-সাদা একটা মানুষ, সাদা স্কার্ট বাতাসে উড়তাছে। মুহের মইধ্যে আলো পইড়া মনে অইতাছে মরা মানুষের মুখ। প্রথমে ভাবলাম, যাইতাছে যাউকগা। আমি চুপ মাইরা থাহি। চিক্কুরটা আতকা বাইরাইয়া গেছেগা ছোটভাই। তুমি মনে কিছু নিওনা। তুমি নিজে তুমারে দেখলেও ফিট খাইতা!"
বাসাবো'র বাসিন্দা এই মোসাদ্দেক ভাইএর কাছে আমি বিভিন্ন ভাবে ঋণী। স্নেহের ঋণ। যোগাযোগ নেই, তবু এই লোকটাকে আমি খুব মিস করি। তার বিরাট বপুতে তিনটা জিনিসে ঠাঁসা ছিল। বাস্কেটবল, সারল্য, আর স্নেহ-যার প্রতিদ্বন্দ্বী হবার চেষ্টাও কেঊ করেনি কখনো।
ভালো থাকুন মোসাদ্দেক ভাই।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০১১ রাত ১০:৪৫