দুনিয়াতে এমন অনেক প্রাণী আছে যাদের মধ্যে আমরা গুলিয়ে ফেলি। কিছু প্রাণীর মধ্যকার পার্থক্য জানিনা। কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে মিলসমুহ জানিনা। কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে জানিই না যে তাদের অস্তিত্ব আছে। আবার কিছু প্রাণীকে অন্য একটি প্রায় একই রকম দেখতে প্রাণীর সাথে গুলিয়ে ফেলি। এরকম ই কিছু প্রাণীর মধ্যকার কিছু পার্থক্য/ মিল/ অমিল নিয়ে আলোচনা করার চিন্তাধারা নিয়ে শুরু করেছিলাম এই সিরিজটি, যেখানে আমরা আমাদের অতিথিদের সম্পর্কে প্রথমে আলাদা আলাদা ভাবে জানার চেষ্টা করি হাল্কা পাতলা ভাবে। তারপর তাদের মধ্যকার পার্থক্যগুলোর ব্যাবচ্ছেদ করার চেষ্টায় রত হয়। তার-ই ধারাবাহিকতা হিসেবে এই পর্বটি। এবং এবারের অতিথি কচ্ছপ এবং কাছিম। So, lets start, eh?
আজ আমরা জানব কচ্ছপ ও কাছিম সম্পর্কে। এখন এইখানে অনেকেই বলবে কচ্ছপ আর কাছিম-র মধ্যে আবার পার্থক্য কিসের? দুটো তো একই। Well, কথাটা ঠিক আবার ঠিক ও না। কারণ সকল কচ্ছপ ই কাছিম, কিন্ত সকল কাছিম কচ্ছপ নয়।
হ্যাঁ?!? এ আবার কেমন কথা?!? তাইলে কচ্ছপ কোনটা, কাছিম কোনটা? এদের মধ্যে পার্থক্য কী? আজকে এই নিয়েই জানব। কিন্তু শুরুতে এদের বৈশিষ্ট্যগুলো জানতে হবে। তো চলুন শুরু করা যাক।
কচ্ছপ(Tortoise):
Kingdom: Animalia
Phylum: Chordata
Class: Reptilia
Order: Testudines
Suborder: Cryptodira
Superfamily:Testudinoidea
Family: Testudinidae
কচ্ছপ এক ধরনের সরীসৃপ প্রাণী যারা জল এবং ডাঙা দুই জায়গাতেই বাস করে । এদের শরীরের উপরিভাগ শক্ত খোলসে আবৃত থাকে যা তাদের শরীরকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে রক্ষা করে। কচ্ছপ পৃথিবীতে এখনও বর্তমান এমন প্রাচীন প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে কচ্ছপের প্রায় ৩০০ প্রজাতি পৃথিবীতে রয়েছে, এদের মধ্যে কিছু প্রজাতি মারাত্মক ভাবে বিলুপ্তির পথে রয়েছে। কচ্ছপ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজের শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা পরিবর্তন করতে পারে। এদের শরীরের উপরিভাগ শক্ত খোলসে আবৃত থাকে, যা এদের শরীরকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে রক্ষা করে। খোলসের ওপরের অংশকে (Carapace) ক্যারাপেস এবং নিচের অংশকে (Plastron) প্লাস্ট্রন বলে। এরা কয়েক সেন্টিমিটার থেকে দুই মিটার পর্যন্ত বড় হতে পারে। কচ্ছপ সাধারণত দিবাচর প্রাণী। দলবদ্ধ থাকতে এরা পছন্দ করে না। একাকী জীবনেই এরা অভ্যস্ত। কচ্ছপের অনেক প্রজাতি পানিতে বা পানির আশপাশে বাস করলেও ডাঙায় ডিম ছাড়ে। এদের খোলসের ওপরের অংশে যে সমকেন্দ্রবিশিষ্ট রিং থাকে তা থেকে এদের বয়স সম্পর্কে একটি ধারণা করা যায়; যেমনটা গাছের ক্ষেত্রে তাদের বর্ষবলয়ে দেখা যায়। ডাঙায় বসবাসকারী বেশির ভাগ কচ্ছপ তৃণভোজী। এরা সাধারণত ঘাস, আগাছা, পাতা, ফুল ও ফল খেয়ে বেঁচে থাকে। যদিও কিছু সর্বভুক কচ্ছপও এই পরিবারে আছে। পোষ্য কচ্ছপ সাধারণত ঘাস, পাতা, আগাছা ও কিছু প্রজাতির ফুল খায়।
কাছিম (Turtles):
পৃথিবীর প্রায় সকল সমুদ্রেই এদের বিস্তৃতি রয়েছে এবং এরা বাসা বানানোর জন্য সাধারণত তুলনামূলক উষ্ম অঞ্চল পছন্দ করে। খাবার গ্রহণ, বিপরীত লিংগের সাথে মিলন থেকে শুরু করে সকল আনুষঙ্গিক কাজই সাগরে করলেও ডিম পাড়ার সময়ে স্ত্রী কাছিমকে দ্বীপে আসতেই হয়। এরা ডিম পাড়ার সময়ে খুব নির্জন স্থান বেছে নেয় এবং যদি সেখানে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতি দেখে তাহলে সাথে সাথে ডিম পাড়া বন্ধ করে মা কাছিম আবার সাগরে ফেরত চলে যায়। ডিম পাড়ার সময় বালিতে গর্ত করে ডিম পাড়ে এবং শেষ হবার সাথে সাথে বালি দিয়ে ঢেকে দেয় যাতে করে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার সাথে সাথেই বাচ্চাগুলো আবার সাগরে চলে যেতে পারে। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার জন্য মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রার প্রয়োজন পড়ে। কুমিরের ক্ষেত্রে তাপমাত্রার সামান্য হেরফের হলে লিঙ্গের রূপান্তর অর্থাৎ পুরুষ থেকে স্ত্রী কিংবা স্ত্রী থেকে পুরুষ হলেও এদের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা পরিলক্ষিত হয়না। গড়ে ৬০ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়ে বাচ্চাগুলো সাগরে পাড়ি জমায়। বলে রাখা ভাল যে, পুরুষ কাছিম একবার ডিম ফুটে গভীর সাগরে চলে যাওয়ার পরে আর কখনো দ্বীপে ফেরত আসেনা, সমগ্র জীবনচক্র তার সাগরেই কেটে যায়।
কচ্ছপ ও কাছিমের মধ্যে পার্থক্যঃকচ্ছপ এবং কচ্ছপ দুটিই Testudines ক্রমের সরীসৃপ, তবে বিভিন্ন শ্রেণিবদ্ধ পরিবারের। কচ্ছপের বৈজ্ঞানিক নাম হল Testudinidae এবং কাছিমের বৈজ্ঞানিক নাম Chelonioidea। কচ্ছপ এবং কাছিমের দেহ উভয়ই একটি খোল দ্বারা রক্ষা করা হয়, যার উপরের অংশটিকে ক্যারাপেস বলা হয়, নীচের অংশটিকে প্লাস্ট্রন বলে। ক্যার্যাপেস এবং প্লাস্ট্রন একটি ব্রিজ দ্বারা সংযুক্ত থাকে, যার অর্থ যে কচ্ছপ বা কাছিমের মাথা এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গটি শেল থেকে প্রত্যাহার করা যেতে পারে তবে পুরো শরীরটি কখনও এ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হতে পারে না। এই সরীসৃপগুলি সাধারণত ধীর গতির ও লাজুক প্রকৃতির।
১। দুজনের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল বাসস্থা। কচ্ছপ হলো স্থলজ প্রাণী। এরা বেশিরভাগ সময় স্থলেই কাটায়। অন্যদিকে, কাছিম হলো জলজ প্রাণী। এরা পানিতে থাকতেই পছন্দ করে।
২। কচ্ছপ স্থলে থাকে বলে এর কোষগুলো গম্বুজযুক্ত এবং গোলাকার। কচ্ছপের পা ছোট ও বলিষ্ঠ, সোজা এবং সরাসরি শরীরের নীচ থেকে বাঁকানো হয়। অন্যদিকে, কাছিমের কোষগুলো পাতলা এবং পানিতে চলাচলের উপযোগী। এছাড়াও সহজে সাঁতার কাটার জন্য কাছিমের কোষ গুলো হলো স্ট্রীমলাইন্ড। একটি কাছিমের খোলের তুলনায় কচ্ছপের খোলা টি বেশ ভারী। কাছিমের খোলা ডুবে যাওয়া এড়াতে এবং সাঁতারের গতি বাড়ানোর জন্য হালকা হয়।
৩। কচ্ছপের পিছনের পা বড় হওয়ায় এটি সহজেই ভারী কচ্ছপের অতিরিক্ত ওজন বহন করতে পারে। অন্যদিকে, কাছিমের পা গুলো ফ্লিপার বা ওয়েব্ড হওয়ায় এরা সহজেই পানিতে চলাচল করতে পারে। কাছিমের সমতল শেল এবং লম্বা নখর যুক্ত ওয়েব যুক্ত পা রয়েছে।
৪। কচ্ছপের খোলস গম্বুজ আকৃতির। অন্যদিকে, কাছিমের খোলস সমতল ও সুষম আকৃতির।
৫। কচ্ছপ অধিকাংশই তৃনভোজী, তবে কোন কোনটি মাংস পছন্দ করে। অন্যদিকে, কাছিম ফল-ফুল, শাক-সবজি এবং মাংস অর্থাৎ সর্বভূক।
৬। কচ্ছপ এবং কাছিমের মা উভয়ই মাটিতে ডিম দেয়। মা একটি বড়ো গর্ত খনন করে এবং সেখানে দুটি থেকে বারোটি ডিম দেয়। ৯০ থেকে ১২০ দিনের পর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। ইনকিউবেশন প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হয়ে গেলে বাচ্চাগুলো নিজেরাই গর্ত থেকে বের হওয়ার পথটি খনন করে। কচ্ছপ মায়েরা প্রায় ৮০ দিন ধরে হ্যাচলিংগুলিকে সুরক্ষা দেয়, তারপরে তারা নিজেরাই বেঁচে থাকে। তবে কাছিমের হ্যাচলিংগুলি ( বাচ্চাগুলো) জন্ম থেকেই নিজেরাই বেড়ে ওঠে,মা ডিম দিয়েই জলে চলে যায়। কাছিমের ডিমগুলি কিছুটা নরম এবং চামড়ার মতো, অন্যান্য সরীসৃপ এর ডিমের সমান। কচ্ছপের ডিমগুলো পিংপং বলের মত বড়ো আর শক্ত খোলার হয়।
৭।কচ্ছপগুলি প্রায় ৬০/৮০ বছর ধরে বেঁচে থাকতে পারে, তবে কেউ কেউ ১৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বেঁচে থাকতে পরিচিত। দীর্ঘতম যাচাই করা কচ্ছপের আয়ুষ্কালটি ছিল ১৮৮ বছর।
বিপরীতে, কাছিমের সাধারণ জীবনকাল প্রায় ২০/৪০ বছর হয়, যখন সমুদ্রের কাছিমগুলি গড়ে ৬০ থেকে ৭০ বছর হয়, প্রায় ৪০ থেকে ৫০ বছর পূর্ণতায় পৌঁছতে পারে।
৮। কচ্ছপ বেশিরভাগ এশিয়া এবং আফ্রিকাতে পাওয়া যায়, এবং কাছিম আফ্রিকা এবং আমেরিকাতে পাওয়া যায়। কাছিম মূলত গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং আধা-গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুতে পাওয়া যায় কারণ দেহের সঠিক উষ্ণতা বজায় রাখতে তাদের উষ্ণ বাহ্যিক তাপমাত্রা প্রয়োজন। তবে কিছু কিছু কাছিম সাধারণত নদীর তীরে শীতকালে হাইবারনেটিংয়ের জন্য পরিচিত। কচ্ছপগুলি হাইবারনেটিংয়ের জন্য পরিচিত নয়, কারণ তাদের আবাসস্থলগুলি প্রায় পুরোপুরি উষ্ণ, যদিও কিছু প্রজাতি অল্প পরিমাণে খাদ্য ও জলের মধ্যেই তাদের বিপাক ক্রিয়া কে সীমাবদ্ধ করতে পারে।
তথ্যসূত্র:
১। Turtle:New World Encyclopedia
২। All about sea turtles
৩। Tortoise:New World Encyclopedia
৪। Turtle Vs Tortoise
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০২২ দুপুর ১২:৫১