ইন্টারনেট-ভিত্তিক সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের জন্য ‘অনলাইন গণমাধ্যম পরিচালনা নীতিমালা ২০১২’ প্রবর্তন করতে যাচ্ছে সরকার। অক্টোবরে এর খসড়া চূড়ান্ত করা হবে_এমন ঘোষণাও এসেছে। নানা অসংগতি ও অস্পষ্টতার কারণে এ খসড়া নীতিমালা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের বাদ-প্রতিবাদ চলছে।
নীতিমালায় আছে
*আবেদনকারীকে আর্নেস্ট মানি বাবদ দুই লাখ টাকা দিতে হবে।
*লাইসেন্স নেওয়ার সময় পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে। লাইসেন্স নবায়ন ফি হিসেবে প্রতিবছর দিতে হবে পঞ্চাশ হাজার টাকা।
*লাইসেন্স পাওয়ার পর বিটিআরসির কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে।
*সব অনলাইন গণমাধ্যমকে বাংলাদেশে স্থাপিত সার্ভারে হোস্টিং করতে হবে। ডিএনএসআই (ডোমেইন নেইম সার্ভার ইন্টারনেট প্রটোকল) সম্পর্কে তথ্য মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে।
*অন্য কোনো দেশি বা বিদেশি গণমাধ্যম লিংক করা যাবে না।
*অনলাইনে প্রকাশিত বিজ্ঞাপন আয়ের ২ শতাংশ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে।
গত ১২ সেপ্টেম্বর তথ্যসচিব অনলাইন গণমাধ্যমের কয়েকজন প্রতিনিধিকে ডেকে প্রস্তাবিত নীতিমালা সরবরাহ করেন এবং এ বিষয়ে ১০ দিনের মধ্যে (২২ সেপ্টেম্বর) তাঁদের মতামত জানাতে বলেন। এ রকম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে যুক্তিযুক্ত আলোচনার সময় না দিয়ে এবং সংশ্লিষ্ট সবার মতামত না নিয়ে নীতিমালা প্রণয়নকে অযৌক্তিক বলছেন অনেকেই। এর লাইসেন্স ফি, নবায়ন ফি, অনুমোদন গ্রহণ, জরিমানা, শাস্তির মতো বিষয়গুলো সমালোচিত হয়েছে বেশি। ‘অনলাইন গণমাধ্যম’ বলতে কী বোঝায়, সে বিষয়েও স্পষ্ট কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি। যদিও তথ্যসচিব জানিয়েছেন, নীতিমালার আওতায় সোশ্যাল মিডিয়া বা ব্লগ নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা সরকারের নেই। তবে তা আশ্বস্ত করতে পারেনি সোশ্যাল মিডিয়া বা ব্লগ ব্যবহারকারীদের।
নীতিমালা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামত
হাসানুল হক ইনু
তথ্যমন্ত্রী
অনলাইন নীতিমালা আলোচনার মাধ্যমেই চূড়ান্ত করা হবে। খসড়া নীতিমালা হয়েছে। এ ব্যাপারে অনেকের সুপারিশ আসছে, আরো আসবে। প্রয়োজনে আইন তৈরিতে সংসদ পর্যন্ত যেতে হতে পারে। সাংবাদিকের তথ্য তো আর পণ্য নয়। তাই নীতিমালা আলোচনার মাধ্যমেই চূড়ান্ত করা হবে। তাড়াহুড়ো করে কিছু করা হবে না।
হেদায়েতুল্লাহ আল-মামুন
তথ্যসচিব
দেশের অনলাইন গণমাধ্যমের উপযোগী একটি সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন করতে প্রধান তথ্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলামকে আহবায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে নীতিমালা চূড়ান্ত করা হবে। নীতিমালার উদ্দেশ্য হবে, দ্রুত বিকাশমান অনলাইন নিউজপোর্টালগুলোকে বিজ্ঞাপন সহায়তার আওতাভুক্ত করা। যেসব অনলাইন গণমাধ্যম সংবাদমাধ্যম হিসেবে কাজ না করে কেবল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে, সেগুলো এর আওতায় পড়বে না।
মোস্তাফা জব্বার
প্রযুক্তিবিদ এবং অনলাইন গণমাধ্যম সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্য
প্রস্তাবিত নীতিমালায় অনেক কিছুই স্বাধীন গণমাধ্যম নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। নীতিমালায় বলা হয়েছে, অনলাইন গণমাধ্যম স্থাপনের জন্য আবেদনকারীকে বাংলাদেশের নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই বাংলাদেশি হতে হবে। এখানে আবেদনকারীকে কেন প্রতিষ্ঠান হতে হবে, তা বোধগম্য নয়। বলা আছে, সরকার কর্তৃক নির্বাচিত আবেদনকারীদের অনুকূলে লাইসেন্স প্রদানের পর বিটিআরসির কাছ থেকে অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে। গণমাধ্যমের লাইসেন্সের জন্য বিটিআরসির কাছে কেন যেতে হবে, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। এর কোনো প্রয়োজন আছে বলেও আমি মনে করি না। নীতিমালায় বলা হয়েছে, লাইসেন্স ফি পাঁচ লাখ টাকা, আর্নেস্ট মানি দুই লাখ টাকা, প্রতিবছর লাইসেন্স নবায়ন ফি ৫০ হাজার টাকা, বিলম্বে নবায়নের জন্য জরিমানা। দেখা যাচ্ছে, বিভিন্নভাবে আয়ের উপায় হিসেবে একে দেখছে সরকার। যা হোক, ‘অনলাইন গণমাধ্যম সহায়ক নীতিমালা’ প্রণয়নের জন্য ২৬ সেপ্টেম্বর একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার। কমিটি অনলাইন-বান্ধব একটি নীতিমালা করতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আশা করি, সরকার এমন কোনো নীতিমালা করবে না, যা জনগণের মত প্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করে।’
আফসান চৌধুরী
নির্বাহী সম্পাদক, বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম
এ নীতিমালা সুশাসন ও গণতন্ত্রের আন্দোলনকে বরং কয়েক ধাপ পিছিয়ে দেবে। অন্যান্য দেশ যখন তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন ও মানুষের মত প্রকাশের অধিকার চর্চাকে নিশ্চিত করছে, সেখানে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার উপায় নেই। আইন ও নীতিমালার চেয়ে ব্যক্তি ও সমাজের সাংস্কৃতিক ও নৈতিক রুচি ও শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
মনজুরুল আহসান বুলবুল
প্রধান নির্বাহী, বৈশাখী টেলিভিশন
প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তার ওপর সংবিধানে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ নম্বর ধারায় সুস্পষ্টভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশে লক্ষাধিক নীতিমালা, বিধি ও আইন থাকলেও এসবের প্রয়োগ খুব কমই হয় এবং এসব আইনের সঙ্গে সব সময় জনগণের কোনো যোগাযোগ থাকে না। প্রস্তাবিত অনলাইন নীতিমালা নিয়ন্ত্রণমূলক, ইন্টারনেটে মত প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে। তবে ইন্টারনেট স্বাধীনতার কারণে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যাতে অযথা হয়রানির শিকার না হন সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস’-এর ২০১১-১২ সালের প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো নয়। মত প্রকাশের এই নাজুক অবস্থার মধ্যেও যদি নতুন করে বাক্স্বাধীনতা রোখার নীতিমালা করা হয়, তাহলে অনলাইন-নির্ভর সংবাদ এজেন্সি ও সাইটগুলো এ নীতিমালার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত ও বৈষম্যের শিকার হবে।
তাহমিনা রহমান
আর্টিকল-১৯-এর দক্ষিণ এশীয় প্রতিনিধি
ন্যায়, শান্তি, সমতা ও মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনে ও জনগণকে সংগঠিত করতে ইন্টারনেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশেও ইন্টারনেটের মুক্ত ব্যবহার একটি সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের ১৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষের মত ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। ইন্টারনেট এই অধিকার বাস্তবায়নে একধাপ এগিয়ে রয়েছে। অনলাইন-বিষয়ক কোনো নীতিমালা করতে গেলে, ইন্টারনেট যাঁরা ব্যবহার করেন তাঁদের নিয়েই করা উচিত।
মুনির হাসান
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ওপেনসোর্স নেটওয়ার্ক
প্রস্তাবিত নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে তা মত প্রকাশের অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করবে এবং গুটিকয়েক মুনাফালোভী করপোরেট বাণিজ্যের কাছে মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা বিক্রি হয়ে যাবে। দেশব্যাপী যেসব তরুণ উদ্যোক্তা বেশ কিছু নিউজ ও ভিউজ সাইট চালাচ্ছেন, তাঁদের সাইটগুলো এই নীতিমালার কারণে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। প্রস্তাবিত নীতিমালা যদি বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে তা মত প্রকাশের বাধা হিসেবেই দাঁড়াবে। নীতিমালায় অনলাইন গণমাধ্যমের কোনো সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। কী কী বৈশিষ্ট্য থাকলে অনলাইন গণমাধ্যম হিসেবে ধরা হবে তাও পরিষ্কার নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শুধু গণমাধ্যমগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই এ নীতিমালার খসড়া তৈরি করেছে।
রোবায়েত ফেরদৌস
সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনলাইন গণমাধ্যমের রেজিস্ট্রেশনের প্রস্তাব পৃথিবীর কোথাও দেওয়া হয়েছে বলে জানা নেই। এ নীতিমালা অনুসারে সরকার বাংলাদেশে সম্প্রচারিত সব গণমাধ্যমের ওপর চাঁদা বসাতে পারে। সেটাই কি তারা করতে যাচ্ছে? বাংলাদেশের বাইরে যদি কোনো অবাংলাদেশি বাংলা সাইট বা বাংলাদেশ বিষয়ে ইংরেজি সাইট পরিচালনা করেন, তবে সরকার কী করবে? কোনো প্রবাসী যদি কানাডা, লন্ডন বা নিউ ইয়র্কে বসে সাইট চালান, তবে সরকার তাঁর কাছ থেকে টাকা কিভাবে আদায় করবে? এ নীতিমালা প্রণয়ন করা হলে বিদেশ থেকে পরিচালিত বাংলা সাইটগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা প্রকারান্তরে বাড়বে। এমনকি ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট ও ছোট নিউজ সাইটের বদলে বড় করপোরেট ব্লগগুলোর ওপর নির্ভর করতে হবে।
আহমেদ স্বপন মাহমুদ
উন্নয়ন গবেষণা সংগঠন ‘ভয়েস’-এর নির্বাহী পরিচালক
বিশ্বে অনলাইন সাংবাদিকতার ক্ষেত্র যেমন বাড়ছে, তেমনি এর প্রকৃতিও পাল্টাচ্ছে। বাংলাদেশে এখন প্রতিষ্ঠিত সব সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণ আছে। কয়েকটি অনলাইন-ভিত্তিক পত্রিকা বেশ নাম করেছে। সিটিজেন সাংবাদিকতা যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার পূর্বশর্ত, তার বেশ কিছুটা পূরণ করছে এই নিউজ সাইটগুলো। কিন্তু খসড়া নীতিমালায় অনলাইন সাংবাদিকতাকে প্রণোদনা দেওয়ার পরিবর্তে উচ্চ অঙ্কের লাইসেন্স ফি, নবায়ন ফি এবং জামানত ধার্য করে এর বিকাশের পথ রুদ্ধ করার আয়োজন করা হয়েছে।
নিয়ন্ত্রণের কঠোরতা ফুটে ওঠে এ নীতিমালার ৯(ঘ) ধারায়। এখানে বলা হয়েছে, ‘সরকারের অন্য কোনো নির্দেশ প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে সরকার লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে।’ তা ছাড়া ১৪(ঘ) ও (ঙ) ধারায় লেখা হিংসাত্মক, সন্ত্রাসী ও অশ্লীল কর্মকাণ্ডের কোনো ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়নি। এসব অস্পষ্টতা ব্যবহার করে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ যেকোনো প্রচারিত বা প্রকাশিত বিষয়কে নিজের স্বার্থে সংজ্ঞায়িত করে সেন্সর আরোপ করতে পারবে।
অনলাইন পাঠকের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সংশ্লিষ্ট বিষয়ের দেশি-বিদেশি লিংক। নীতিমালা মানলে বিদেশি লিংক ব্যবহার করা যাবে না। নিউজ সাইটে সংশ্লিষ্ট দেশি বা বিদেশি লিংক দেওয়া না হলে অনলাইন গণমাধ্যম এর গুরুত্ব হারাবে। অনলাইন গণমাধ্যম যেখানে যেকোনো দেশ থেকে প্রকাশ করা সম্ভব; সেখানে ভৌগোলিকভাবে সীমাবদ্ধ এই নীতিমালার অনেকাংশ কার্যকর করাই অসম্ভব।
লেখাটি এইখান হতে নেয়া
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ৯:৪০