ক্ষমতাসীনদের চারপাশে যখন কৃত্রিম প্রাচীর তৈরি হয়
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
ক্ষমতাসীনদের চারপাশে যখন কৃত্রিম প্রাচীর তৈরি হয়
ফকির ইলিয়াস
=======================================
বাংলাদেশের রাজনীতিতে কথা বলা খুব সহজ কাজ। বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন। আমরা দেখছি গেল চার দশক সময়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনীতিক অনেক বড় বড় বুলি আওড়িয়েছেন। যখনই রাষ্ট্রক্ষমতায় তারা এসেছেন তখন চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো তাদের হাতেই পরাস্ত হয়ে গেছে গণমানুষের স্বপ্ন। তারপর তারা অন্য পক্ষকে দোষারূপ করেছেন। নিজেরা দায় নিতে চাননি।
রাজনীতিতে দায় না নিয়ে রাষ্ট্রের উন্নয়ন করা যায় না। যদি এমন নিয়ম থাকত কেউ দুই টার্মের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, তাহলে অবস্থার কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসত। এমন সাংবিধানিক ব্যবস্থা বাংলাদেশে নেই। ফলে রাজনীতি দলীয় শীর্ষ নেতৃত্বের হাতে সীমিত থাকছে, মুখে গণতন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু দল, রাজনীতি, নীতি-নির্ধারণ সবই চলছে ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছায়।
বর্তমান সরকারের কাছে গণপ্রত্যাশা কিছুটা বেশিই ছিল। থাকার কারণ তারা অনেক অঙ্গীকার করে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু সে প্রত্যাশা যেন ক্রমেই ধূসর হয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিক সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাযজ্ঞের পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কারও বেডরুম পাহারা দেয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশে মানুষের সংখ্যা ১৬ কোটি। হ্যাঁ, সবার অন্দর মহলের খবর সরকার রাখতে পারবে না। তবে জননিরাপত্তা দেয়ার একটা নীতি-নিয়ম আছে। সেই নিয়মনীতি পালিত হলে মানুষ নিরাপত্তা পাবে, দেশে সুশৃঙ্খল সমাজ প্রতিষ্ঠা পাবে- সে প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। কথা হচ্ছে, এসব বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এমন বেফাঁস কথাবার্তা বলবেন কেন? তিনি তো আরও প্রজ্ঞা নিয়ে, আরও দায়িত্ববান হয়ে কথাটি বলতে পারতেন। কেন বলেননি।
সাগর-রুনি হত্যা বিষয়ে সরকারকে দায়ী করেছেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। তিনি লালমনিরহাটে এক জনসভায় বলেছেন, সাগর-রুনি হত্যার পেছনে নাকি সরকার দায়ী। সরকার নাকি খুনিদের বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। খালেদা জিয়া আরও বলেছেন, সরকারের দুর্নীতির আলামত, প্রমাণ সাগর-রুনি জানতেন। আর সেটাই তাদের জন্য কাল হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, খালেদা জিয়া এই জোড়া খুন সম্পর্কে যা বলেছেন, তার প্রমাণ কি তার হাতে আছে? তিনি কি তা প্রমাণ করতে পারবেন? যদি পারেন তবে খালেদা জিয়ার উচিত সে প্রমাণ দেশবাসীর কাছে তুলে ধরা। না হলে তিনি এমন অভিযোগ কেন তুলবেন?
এটা খুবই দুঃখজনক, দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সম্মিলিত প্রয়াস এখন পর্যন্ত সাগর-রুনির খুনিদের রাষ্ট্রের সামনে দাঁড় করাতে পারেনি। কেন পারেনি, এর জবাব রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রকদের দিতে হবে। তা না হলে গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন দেখা দেবে আগামী নির্বাচনে। ক্ষমতাসীনরা এভাবে তাদের জনপ্রিয়তায় ধস নামুক, তা নিশ্চয়ই তারা চাইবেন না।
সাগর-রুনির হত্যাকান্ডের পর নানা কথা প্রতিদিনই কাগজে ছাপা হচ্ছে। এ পর্যন্ত এটা নিশ্চিত বলা যায়, এটা মামুলি কোন হত্যাকা- নয়। সরকারও 'চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা' অভিহিত করে তদন্তের আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু পরিতাপের কথা রাষ্ট্রের সাংবাদিক সমাজ আজ রাজপথে নেমে আসার পরও টনক নড়ছে না সরকারের। বরং বলা হচ্ছে, মানিক সাহা বা অন্যান্য সাংবাদিক যখন নিহত হয়েছিলেন তখন আন্দোলন জোরদার করা হয়নি কেন?
তখন কেন জোরেশোরে আন্দোলন হয়নি, এখন কেন হচ্ছে_ এগুলো অবান্তর প্রশ্ন। রাষ্ট্রের মানুষ যে কোন সময় ঘুরে দাঁড়াতে পারে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দেড় কোটি তরুণ ভোটার কেন মহাজোটকে ভোট দিয়েছিল, আগে কেন দেয়নি-এমন প্রশ্ন যেমন বর্তমান শাসকগোষ্ঠী করতে চাইবে না, তেমনি এখন কেন আন্দোলন হচ্ছে, সে প্রশ্ন তোলাও সমীচীন নয়। বরং সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। দেশের মানুষকে নিরাপত্তা দিতে হবে।
দুই বছর বাকি থাকলেও ভোটের রাজনীতি বাংলাদেশে শুরু হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পটুয়াখালীর জনসভায় জনগণের কাছে ভোট চেয়েছেন। ভোট তারা চাইতেই পারেন। কিন্তু দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর হাল-হকিকত কেমন কিংবা প্রধানমন্ত্রীর নিজের প্রায়োরিটি দেয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বর্তমান অবস্থা কেমন, তা কী প্রধানমন্ত্রী খোঁজ নিয়েছেন? সে খোঁজ প্রধানমন্ত্রীর নেয়া উচিত।
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীকে দেশের প্রকৃত অবস্থা জানতে দেয়া হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন শীর্ষ আসনের চারপাশে মেকি প্রাচীর তৈরি করে রাখা হয়েছে। যাতে প্রধানমন্ত্রী সব কিছু স্বচ্ছভাবে দেখতে, জানতে না পারেন। এ কৃত্রিম প্রাচীর কারা তৈরি করছে? এদেশের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের জন্য তাদের উপদেশ কতটা দরকারি? এমন অনেক প্রশ্ন করা যায়।
নতুন যোগ দেয়া দু'জন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও ওবায়দুল কাদের বলেই দিয়েছেন, তারা 'আখেরি সময়ের মন্ত্রী'। আমরা জানি মন্ত্রী বাছাই করেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। তবে আক্ষেপের কথা হচ্ছে, বর্তমান কেবিনেটে আওয়ামী লীগের আরও যোগ্য, অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্বকে মন্ত্রিত্ব দেয়া যেত। তা দেয়া হয়নি। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের প্রাধান্য দেয়া ভালো তবে তা যেন কোনমতেই রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সীমানা ছাড়িয়ে না যায়।
রাষ্ট্র স্বার্থের বিষয়টি শুধু রাজনীতিকদের নয়, জনগণেরও ভাবনার বিষয় বটে। দিলি্ল সফর করে এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন, সীমান্তে যাতে গুলি না হয়, কোন বাংলাদেশি যাতে আক্রান্ত না হন সে বিষয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে আশ্বস্ত করেছেন। এমন আশ্বস্ত তারা আগেও শুনিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে ভিন্ন ঘটনা। দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থরক্ষায় আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।
মনে রাখা দরকার বর্তমান সরকার বিশেষ কোন 'ভবনের' তাঁবেদার হয়ে কাজ করছে না। কোন ছায়া সরকারও নেপথ্যে থেকে এ সরকারের প্রতি প্রভুত্ব খাটাচ্ছে না। তারপরও ব্যর্থতার তালিকা এত দীর্ঘ হচ্ছে কেন? দল ও সমর্থকগোষ্ঠীর কোন্দল-উপকোন্দলে বারবার রক্ত ঝরছে কেন? 'বড় দলে এমন মতবিরোধ থাকবেই' বলে দায় এড়ানোর কোন সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। বিশ্বের অনেক দেশে বড় বড় রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম আমরা প্রত্যক্ষ করছি।
সাগর-রুনি হত্যা বিষয়ে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন মাননীয় হাইকোর্ট। খালেদা জিয়ার বক্তব্যকেও দায়িত্বহীন বলে মন্তব্য করেছেন মাননীয় আদালত। স্মরণ রাখা দরকার রাজনীতি করা প্রয়োজন সব দায়-দায়িত্ব নিয়েই। কল্পনাপ্রসূত গল্প বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করার মাধ্যমে ভোগান্তি শুধু বাড়ে না, রাজনীতিকের গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
আমরা দেখি, আমাদের দেশের টকশোগুলোতে আমাদের দেশের অনেক 'আলোকিত মানুষ' নানা আপ্তবাক্য আওড়ান। কিন্তু খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের অনেক অনুসারী, নিজেদের আত্মীয়স্বজন বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় লুটপাটের সহযোগী হয়েছে। প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে ভোগবাদী সামন্তবাদ প্রতিষ্ঠার একটি সংঘবদ্ধ দল থাকে। বাংলাদেশে এ দলের দাপট ক্রমেই বাড়ছে। যা শঙ্কার কথা। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ভোগবাদে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকের ঐক্য চোখে পড়ার মতো।
নিউইয়র্ক, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২
--------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ / ঢাকা / ২ মার্চ ২০১২ শুক্রবার প্রকাশিত
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ডোডোগুলো না পারে কোন বিষয়ে লিখতে, না'পারে কমেন্ট করতে।

২০১৬ সাল থেকে আজ অবধি ১০০০ বারের বেশী আমাকে কমেন্টব্যান করেছে সামু। সামুটিমে যারা ছিলেন ও ব্লগিং করতেন, তাদের ১ জনও ব্লগার হিসেবে ভালো করেননি; অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের উপর... ...বাকিটুকু পড়ুন
হতেই হবে- 'হুজুরের মতে অমত কার'!

এনসিপির ভোট কিভাবে বাড়ানো যায়?

একটি নিরপেক্ষ সংস্থার জরিপ অনুযায়ী এখন বিএনপির ভোট ১৯% (প্রায়), জামায়াতের ভোট ১৬% (প্রায়), আওয়ামী লীগের ভোট ৯% (প্রায়), এনসিপির ভোট ৩% (প্রায়) সিদ্ধান্তহীন ভোট ৩০% (প্রায়), ভোট... ...বাকিটুকু পড়ুন
সৈয়দা গুলশান ফেরদৌস জানা কেমন আছেন?

আমি আশা করছি, তিনি ভালো আছেন! কেহ কি জানেন উনি শারীরিকভাবে কেমন আছেন বর্তমানে? সর্বশেষ জেনেছিলাম (বছর খানেক আগে ) যে, উনি ভালো আছেন, চিকিৎসা চলছিলো। এরপর আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন
যাপিত জীবনঃ আমি আফগান হতে চাই।
আজকে একটা পোস্ট চোখে পড়ল আফগানদের নিয়ে। সেখানে আফগানদের প্রশংসা করা করা হয়েছে। আফগানদের নিয়ে প্রশংসায় আমার কোন আপত্তি নেই তবে বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের একটা নির্দিষ্ট অংশ যে মনস্তত্বের কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।