somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পদাধিকার: তদবির বনাম যোগ্যতা

০৭ ই অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১১:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশ টেলিভিশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মাসে অন্তত এক দু দিন বিকেলের দিকে অফিসে এসে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলতেন, ‘আপার বাসা থেকে লাঞ্চ করে এলাম, খাওয়াটা একটু বেশিই হয়ে গেছে’ অথবা ‘আজ আপার বাসায় ভাত খেয়েছি পাবদা মাছ দিয়ে, এতো বড় পাবদা আমি জীবনে দেখিনি।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে যিনি এক েটবিলে দুপুরের খাবার খেতে বসেন সঙ্গত কারণেই তাঁকে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করে ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের শক্তি বা সাহস কারোরই ছিল না। ফলে তিনি একাধিকবার তাঁর চুক্তিভিত্তিক চাকুরির মেয়াদ বাড়িয়েছেন, নূন্যতম যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও উপরের পদ দখল করেছেন এবং টেলিভিশনের পদ ও পর্দাকে নিজের প্রয়োজনে যথেচ্ছ ব্যবহার করার পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও কাজে লাগিয়েছেন। শেষ বিচারে টেলিভিশনের কোনো উন্নতি না হলেও তিনি তাঁর নিজের আখের যতটা সম্ভব গুছিয়ে নিয়েছেন।

আমাদের দেশে যে কোনো পদে সমাসীন হবার ক্ষেত্রে অযোগ্যতা ও অক্ষমতার ঘাটতিটুকু ক্ষমতাবানদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও যোগাযোগ, দলীয় আনুগত্য এবং সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মহলে তদবির তাগাদার মাধ্যমে পুষিয়ে নেয়া হয়। তাই সকল অপমান সয়ে, যাবতীয় দুর্নীতি ও অযোগ্যতার অভিযোগ মাথায় নিয়ে এবং প্রতিষ্ঠানের সর্বনাশ করে হলেও শুধুমাত্র ব্যক্তিগত লাভালাভের জন্যে এই সব অযোগ্য লোক পদ আঁকড়ে বসে থাকেন। তিনি যদি জানেন তাঁর উপরে ক্ষমতাবানদের আশীর্বাদ রয়েছে, তাহলে সহকর্মীদের অসহযোগিতা এবং ঘৃণা এরা গায়ে মাখেন না। প্রতিষ্ঠানের ক্ষয়ক্ষতিও তাদের বিচার্য বিষয় নয়। অন্যদিকে যোগ্য ও দক্ষ প্রজ্ঞাবান মানুষ একটি পদ দখলের জন্য যেমন জনসংযোগ বা সুপারিশের আশায় ক্ষমতাবানদের দরজায় ঘোরাঘুরি করেন না, তেমনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণেও তার ভেতরে কোনো দ্বিধা কাজ করে না। যোগ্য মানুষ জানেন তাঁর অধিকার করে রাখা পদের চেয়ে বাইরের পৃথিবী অনেক বড়। তিনি চাইলে সেখানে নিশ্চয়ই কাজের পাশাপাশি সম্মান ও মর্যাদার কোনো অভাব হবে না।

উন্নত বিশ্বে বড় রকমের কোনো রেল বা সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে এর নৈতিক দায় দায়িত্ব স্বীকার করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা এমন কি মন্ত্রী পদত্যাগ করেন। আমাদের দেশে দুর্ঘটনা ঘটানো ড্রাইভারকেও তার চালকের আসন থেকে নামানো যায় না। তিনি জানেন তাকে সাহস যোগাবার জন্যে পেছনে আছে পরিবহন শ্রমিকেদের সংগ?ন, তাকে শক্তি যোগবার জন্যে আছে রাজনৈতিক দল এবং সর্বোপরি তাকে বাঁচাবার জন্যে আছে আমাদের বিচারহীনতার সংস্কৃতি। অতএব পদ আঁকড়ে বসে থাকাটাই তার জন্যে সর্বোত্তম পন্থা। তাই এ দেশে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে পাড়া মহল্লার ক্লাব, সাংস্কৃতিক সংগ?ন, ফ্লাট মালিক সমিতি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলের ছোট বড় সাংগঠনিক কমিটি, ব্যবসায়ী সমিতি এবং পেশাজীবীদের সংগঠনসহ সর্বত্রই চেয়ার দখলের অশোভন প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। পদটি যদি অর্থ-বিত্ত এবং প্রভাব প্রতিপত্তির দিক থেকে লাভজনক হয় সেক্ষেত্রে ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা মাঝে মধ্যেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপান্তরিত হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার প্রত্যেকেই তাদের এই দখলদারি চরিত্রকে জনসেবার মহান উদ্দেশে নিবেদিত বলে প্রচার করে থাকেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্?ানের প্রধান, সরকারি আধাসরকারি বা সায়ত্বশাসত সংস্থার বা ব্যাংক বীমা জাতীয় প্রতিষষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা মহাপরিচালক পদে নিঃসন্দেহে অসংখ্য যোগ্য ও মেধাবী মানুষ নিষ্ঠ ও দক্ষতার সাথে প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। কিন্তু তার পাশাপাশি তদবির ও চাটুকারিতার শক্তিতে যারা তাদের যোগ্যতার চেয়ে বড় আসনটি দখল করে বসেন, তারা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করার সাথে সাথে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করেন। যোগ্য ও দেশ প্রেমিক মানুষের কর্মস্পৃহা এতে ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হয় এবং সামগ্রিক বিচারে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেই তারা ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। এ েক্ষত্রে সবচেয়ে অযোগ্য লোকটিও নানা তথ্য উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন তিনিই সেই প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে কর্মঠ কুশলী দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তি। তার অবর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি েয রসাতলে যাবে সে ব্যাপারে উর্ধ্বতনদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে দৌড় ঝাঁপ করার কাজে তিনি সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকেন, ফলে প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কাজকর্মও ব্যহত হয়। আরও উপরের পদ দখলের আশায় তারা তাদের উপরের এবং সমপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের কাছে বিষোদগার, পত্র পত্রিকায় বিরূপ রিপোর্ট ছাপানো, এবং নামে বেনামে দুদকে বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠিপত্র পাঠিয়ে নিজের ভবিষ্যতের আসন সুরক্ষিত রাখতে চান।

অবশ্য অযোগ্য লোক শেষপর্যন্ত পদ আঁকড়ে বসে থাকলে তাকে টেনে নামাবার কাহিনিও আমাদের দেশে কম নেই। ১৯৯০ সালের গণ অন্দোলনে স্বৈরাচারি এরশাদের পদচ্যুতি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সে সময়ের একটি ঘটনা থেকে আমাদের পদ ও পরিচিতি লাভের নির্লজ্জ আকাঙ্ক্ষার সামান্য পরিচয় পাওয়া যেতে পারে।

মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন একজন উঠতি বুদ্ধিজীবী সে বছর নভেম্বর মাসের শেষ দিকে ১০ই ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে প্রচারের জন্য একটি পাণ্ডুলিপি জমা দিয়েছিলেন। পাণ্ডুলিপিতে এরশাদকে মানবাধিকারের একজন মহান প্রবক্তা হিসাবে চিহ্নিত করে প্রচুর গুণকীর্তণ করা হয়েছিল। ৬ই ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতন হলে দুদিন পরে ‘বিশ্ব মানবাধিকার দিবস’ অনুষ্ঠানের পরিকল্পক বুদ্ধিজীবীটি যথা নিয়মে এসে উপস্থিত। একটু রসিকতা করে তাঁকে বললাম, ‘আপনার মানবাধিরের ঝাণ্ডাধারী এরশাদ সাহেব তে চিৎপটাং- এখন অনুষ্ঠানের কী হবে?’ তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে নতুন একটি পাণ্ডুলিপি হাতে দিয়ে বললেন, ‘স্ক্রিপ্ট তথকে এরশাদের নাম বাদ দিয়ে সব জায়গায় বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের নাম বসিয়ে দিয়েছি।’ কোনো ধরণের নীতিজ্ঞান বিবর্জিত এই চাটুকার চামচা েশ্রণীর সুযোগ সন্ধানী লোকের ভোল পাল্টাবার ক্ষমতা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। এ সব করিৎকর্মা মানুষ তাদের পদ ও পদবীর লোভে, ক্ষমতায় অধিষ্টিত থাকার প্রয়োজনে যে কোনো ধরণের কৌশল অবলম্বনে দ্বিধা করে না। বিশেষ করে যারা একবার একটি পদ অধিকার করে চর্ব- চোষ্য- লেহ্য- পেয়সহ ক্ষমতার সকল আস্বাদ গ্রহণ করেছেন, তারা পদ বঞ্চিত হলে সেই পদ পুনোরুদ্ধারের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। ফলে তারা তাদের পরিচয়ে রাজনৈতিক দলের আইকন ও শ্লোগান নির্বিচারে ব্যবহার করেন, পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে নেতা নেত্রীদের সাথে সম্পর্কের প্রমাণ হাজির করেন, ক্ষমতাসীনদের সাথে তোলা পুরোনো ছবি ছাপিয়ে নতুন করে পদ দখলের পাঁয়তারা করেন।

যার যা প্রাপ্য তার চেয়ে বড় মাপের চেয়ারে বসার জন্য নির্লজ্জ চাটুকারিতা এবং এই দুরাকাক্সক্ষায় ক্ষমতাবানদের নীতিহীন প্রশ্রয় যদি তার জন্য সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়, তবে তা আমাদের দ্রুত অগ্রসরমান সমাজ প্রগতি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে প্রবল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে তাতে সন্দেহ নেই। একটি ন্যায় ভিত্তিক সমাজে তদবির ও চাটুকারিতা কখনো যোগ্যতা ও নিষ্ঠার বিকল্প হতে পারে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১১:৩৫
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×