সম্প্রতি সারা দেশে বেশ বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হলো শিশু অধিকার সপ্তাহ। ‘সিআরসি’ নামে পরিচিত জাতিসংঘ ঘোষিত চাইল্ড রাইট কনভেনশনে অন্যতম স্বাক্ষরদাতা দেশ হিসাবে বাংলাদেশ বরাবরই শিশু অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে সোচ্চার। প্রকৃতপক্ষে একটি সমাজ শিশুদের জন্য কতটা নিরাপদ, রাষ্ট্র তাদের চাহিদা পুরণে এবং অধিকার রক্ষায় কতটা আন্তরিক এবং অর্থবিত্ত ক্ষমতা ও বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে সেই সমাজের প্রাগসর মানুষ শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে কতটা তৎপর, এ সব মানদণ্ডে বিচার করে সেই রাষ্ট্র বা সেই সমাজ কতটা উন্নত তা সহজেই অনুমান করা যায়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, ‘দেশে একটি শিশুও রাস্তায় থাকবে না।’ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, 'শেখ হাসিনা দ্বর্থ্যহীনভাবে বলেন, গৃহকর্মী নির্যাতন এবং কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশু নিয়োগ সরকার কোনোভাবেই মেনে নেবে না। তিনি বলেন, সরকার কোনো ধরনের শিশু নিপীড়ন বরদাশত করবে না।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য যথার্থই সমাজে শিশুদের অবস্থান সম্পর্কে আমাদের আশা আকাক্সক্ষারই প্রতিফলন। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্র-ব্যবস্থা বোধকরি শিশুবান্ধব একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যে এখনও প্রস্তুত নয়। শিশু অধিকার সপ্তাহে শুধুমাত্র একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি ঘটনার শিরোনামে আমাদের সমাজ বাস্তবতার কিছু চিত্র পাওয়া যেতে পারে।
‘ঝালকাঠিতে পিটিয়ে শিশুর হাত ভেঙে দিল পুলিশ, প্রেম প্রত্যাখ্যান: স্কুলগেটে ছাত্রী খুন, কালিহাতিতে শিশু ধর্ষণের অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার, গাজীপুরের জঙ্গলে বাঁশের সঙ্গে বাঁধা স্কুল ছাত্রীর লাশ, সালথায় বাবা খুন, সন্তানদের অপহরণের হুমকি, ভয়ে স্কুলে যাচ্ছে না দুই মেয়ে, কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা, দুধ খাওয়ায় খুন্তির েছঁকা, এবার কিশোরগঞ্জে স্কুলগেটে ছাত্রীকে কোপাল বখাটে।’ এই শিরোনামগুলোর বাইরেও ঘরে আটকে রেখে গৃহকর্মী নির্যাতন, শিশু ধর্ষণের অভিযুক্তদের সাথে পুলিশের গোপন বৈঠক, শিশু বিবাহ এবং ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশু কিশোরদের নিয়ে সংবাদ এবং প্রতিবেদন ছড়িয়ে আছে পত্রিকার পাতায়। আর সারা দেশে ঘটে যাওয়া এ ধরনের আরো অসংখ্য ঘটনা যা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি, তার পরিসংখ্যান অজানা হলেও নিঃসন্দেহে বলা যায় প্রকাশিত ঘটনার চেয়ে তা অনেক অনেকগুণ বেশি।
পত্রিকার শিরোনামগুলো থেকে অনুমান করা যায় শিশুদের শারীরিকভাবে নির্যাতনের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এ ধরণের অমানবিক নির্যাতন অনেক সময়েই শিশুর মৃত্যু কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। স্কুলে শিক্ষকদেরও যখন শারিরীক নির্যাতন থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তখন শিশুরা পরিবারে, প্রতিবেশিদের দ্বারা, আইন শৃঙ্খলায় নিয়োজিতের হাতে এবং শ্রমিক শিশুরা কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে নির্যাতিত নিগৃহীত হচ্ছে। অন্য দিকে শিশুর অধিকার রক্ষায় আইন প্রয়োগের দিক থেকে যাদের সবচেয়ে তৎপর থাকার কথা, সেই পুলিশই কখনো নির্যাতনকারী, কখনো ধর্ষক এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিপীড়কের নয়, নিপীড়নকারীর সহায়ক শক্তি হিসাবে উপস্থিত। বখাটেদের সামাজিকভাবে প্রতিহত করতে না পারা এবং পুলিশের উদাসীনতার কারণে আবারো বেড়েছে স্কুল ছাত্রী এবং কিশোরীদের উৎতক্ত করার হার। এক সপ্তাহে স্কুলগেটে হত্যা ও ছুরিকাঘাতের একাধিক ঘটনা সেই অশুভ সত্যেরই ইঙ্গিত দেয়।
বিগত কয়েক বছরে আমাদের দেশে শূন্য েথকে পাঁচ বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর হার কমেছে, শিশুদের স্বাস্থ্য সেবায় যুক্ত হয়েছে নতুন সুযোগ সুবিধা, বেড়েছে শিশুশিক্ষার হার। কিন্তু এইসব ইতিবাচক অর্জনের পাশাপাশি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে শিশুর প্রতি সহিংসতা। শিশু নির্যাতন ও শিশুর প্রতি ক্রমবর্ধমান আক্রমণাত্মক আচরণ সমাজের অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটায়। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যখন অকারণে কিংবা সামান্য কারণে আগ্নেয়াস্ত্র বের করে একজন শিশুকে গুলি ছুঁড়ে আহত করেন, তখন তা সামাজিক অস্থিরতার সাথে ক্ষমতাবানদের ক্ষমতার দম্ভ ও সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের অবজ্ঞার স্বরূপ তুলে ধরে। অন্যদিকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত সাধারণ মানুষের প্রীতি ভালোবাসায় অভিসিক্ত মানুষও যখন তার গৃহকর্মী শিশুটির প্রতি মানবিক আচরণ দেখাতে ব্যর্থ হয় তখন প্রশ্ন জাগে, শিল্প সাহিত্য, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি জগতের যে মানুষগুলো তাদের কৃতকর্মের মধ্যদিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনাচরণ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে তাদের এই মানবিক দীনতার কারণ কী?
একজন স্বনামধন্য ক্রীড়াবিদ কিংবা জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক নেতারই যখন সামান্য উত্তেজনায় বুদ্ধি বিলোপ ঘটে তখন শিশুর ‘অপরাধের শাস্তি’ হিসাবে একজন ওয়ার্কশপ মালিক, প্রবাসী শ্রমিক, গ্রামের চৌকিদার, মোটর সাইকেল মেকানিক অথবা সাধারণ কোনো গৃহবধুর কাছ থেকে মানবিক আচরণ আশা করাটাই হয়তো অন্যায়। শিশুটি যদি অসহায় দরিদ্র কারো সন্তান হয়ে থাকে তাহলে তার অসহায়ত্ব নির্যাতনকারীকে উৎসাহিত করে, তাই অগ্রপশ্চাত বিবেচনার কোনো ধার ধারেন না নিপীড়ক ক্ষমতাবান মানুষটি। সেক্ষেত্রে লঘুপাপে গুরুদণ্ড দেবার দায়িত্বটিও তিনি নিজের হাতেই তুলে নেন। কিন্তু শিশুটি যদি নিজেই ক্ষমতাবান পরিবারের সদস্য হয় সেক্ষেত্রে বড় ধরনের অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়া তার জন্যে কঠিন নয়। সম্প্রতি জনৈক প্রাক্তন সাংসদের অপ্রাপ্তবয়স্ক ভাতুষ্পুত্র গাড়ি চাপা দিয়ে কয়েকজনকে গুরুতর আহত করেও নির্বিঘ্ন সরে পড়েছে। আরো স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় আইন শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশই তাকে ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে এবং বিষয়টিকে নেহায়েতই গুরুত্বহীন সামান্য দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে।
শিশু অধিকার সপ্তাহের নানা নেতিবাচক খবরের পাশাপাশি কয়েকটি আশাব্যঞ্জক খবরও প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকার পাতায়। এই সপ্তাহেই শিশু সৌরভকে গুলি করায় অভিযুক্ত সাংসদ লিটন গ্রেফতার হয়েছেন, রাজন হত্যা মামলার প্রধার আসামী কামরুলকে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে, গৃহকর্মী মাহফুজা আক্তার হ্যাপিকে নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত ক্রিকেটার শাহাদত হোসেন ও তার স্ত্রীর নিত্যর জামিনের আবেদন আদালতে নাকচ হয়ে গেছে এবং খুলনায় শিশু রাকিব হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়েছে। এরপর বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে অশ্রুপাত না করে যদি প্রকৃত অপরাধীর যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে শিশু বান্ধব সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে যেতে পারবো আরো এক ধাপ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১০:০৭