গুনে গুনে পাক্কা ২৫ মিনিট পেড়িয়ে গেছে, তবু আবু মিয়ার কোনো খোজ খবর নেই, অথচ তাকে বলা হয়েছে খিদায় পেটে ছুচো ডাকছে, ডাল ভাত যা ই আছে যেন তাই এক্ষুনি দিয়ে দেয়া হয়। আবু মিয়া বলে গিয়েছিল একটু বসেন ভাইজান, অক্ষুনি নিয়া আইতেসি। বলে উধাও। উধাও বলতে একেবারে তার কোনোরকম জোড়াতালি দেয়া খাবারের দোকান থেকেই উধাউ। দোকানে কর্মচারি তিন জন। একজন বাবুর্চি ( প্রায় ৪০-৪২ বয়স), একজন থালাবাটি ধোয়া মুছা করে আরেকজন খাবার পরিবেশন করে ( পিচ্চি, নাম বুলেট)
বুলেট কে বললাম,
- আবু মিয়া কই, খাবার দিচ্ছিস না কেন?
উত্তরে, -ওস্তাদ কই গেসে, জানিনা। আপ্নের খাওন দিতে না কইরা গেসে।
মেজাজ খারাপ হচ্ছে হোসেনের।
আবু মিয়ার ভাতের হোটেলে কালেভদ্রে যাওয়া হয়, বেশির ভাগ সময়ে মাসের শেষের দিকে। যখন ই যাওয়া হয়, তখনি সে আমার জন্য নিজের ঘরে আলাদা রান্না করে, নিজের ঘরে বসিয়ে খাওয়ায়। প্রতিবারই কোনভাবেই আমার না সে শোনে না, আজ খুব ক্ষুধা লেগেছে, অনুরোধ করেছিলাম, ওই আয়োজন যেন না করে, নিজের কাছেও কেমন কেমন জানি লাগে। কিন্তু আবু মিয়া ঠিকই উধাও। হোটেল থেকে আবু মিয়ার বাসা কয়েক কদম দূর৷ হোটেলের যাবতীয় কাজ কর্ম বাসা থেকেই হয়।
টিনের চাল দেয়া, কোনোরকম বেড়া দিয়ে ঘর তোলা হয়েছে। মূল ঘর থেকে একটু আলাদা করে ছোট খুপরি করে আরো একটি ঘর। ওখানে আবু মিয়ার বৃদ্ধ বাবা থাকেন, বয়স প্রায় ৭০ এর মতন, একদম সাদা দাড়ি আর জলজলে দু চোখ। কথা কম বলেন।আবু মিয়া, তার বউ আর এক স্কুল পড়ুয়া ছোট্ট মেয়ে নিয়ে মূল ঘরে আবু মিয়ার ছোট্ট সংসার।
পাক্কা ৩৫ মিনিট পর আবু মিয়া হাজির, হোসেন প্রায় বের হয়েই যাচ্ছিল, আবু মিয়া এসে খপ করে ধরল,
-আরে ভাইজান, মেজাজ খারাপ করসেন? আসেন খাওন রেডি
- আবু, তুমি খুব বাড়াবাড়ি কর, বললাম আজ বাদ দাও
- কি যে কন, কই বেসি বেসি করি, আসেন না, বেসি কিচ্চু করি নাই ত ভাইজান, বুজচি খিদা লাগসে বেসি, হইয়া গেসে ত, আসেন ঘরে আসে।
মুখ ভর্তি হাসি মাখা মুখ নিয়ে এমন আবেদন উপেক্ষা করার শক্তি হোসেনের নেই। এগিয়ে চলল আবু মিয়ার ঘরের দিকে।
আয়োজন বেশি কিছু না, খিচুরি মুরগীর তরকারি, মরিচ এই। ঘি এর গন্ধ। হোসেন আসলেই এই বাড়িতে একটু ভাল রান্না হয়। আবু মিয়ার মেয়ে পরিপাটি হয়ে বসে অপেক্ষা করছে, খুব খিদা তার ও লেগেছে। হোসেন দেরী করল না। হাত মুখ ধুয়ে এসেই বসে পড়ল। আবু মিয়া এখন খাবে না। আবু না বসলে, তার বউ ও বসবে না। সুতরাং খাবারের সাথি হোসেন আর আবুর মেয়ে। আবুর বাবা দড়জার বাইরে বসা।
টেবিল ফ্যান টা ঘড় ঘড় করে চলছে, আবুর মেয়ের মুখে হাসির ঝিলিক, আবুর মুখে আত্ন তৃপ্তি। খাবার নেবার আগেই মন ভরে গেছে তাদের, হোসেন দেখছে, ভালো লাগছে।
গোগ্রাসে খেল হোসেন, বেশ খুদা লেগেছিল, মাসের শেষ, টাকা পয়সা একদম কম, আবু জানে। গ্লাসে পানি ঢেলে দিতে দিতে আবুর বউ বলল
- ভাইজান আরেকটু নেন
-উহু আর সম্ভব না।
পানির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল হোসেন, সেই সময়েই
বাবা, খাইসেন ঠিক মত?
আবুর বাবার কন্ঠটা তীক্ষ্ণ হয়ে কানে বাজল হোসেনের।
আহ, বাবা ডাক। কতদিন পর।
-জি খেয়েছি।
গামছা এগিয়ে দিতে দিতে আবু বলল
-ভাইজান বেসি কিসু করবার পারি নাই
- যথেষ্ট করেছ আবু, আমি শুধু তোমাকে ভেজালে ফেলি
- না, ভাইজান,কথা এইডা সত্য না।
- তাহলে সত্যি কি? বলতো আবু
- ভাইজান, আমাগো হয়ত অনেক কিছুই নাই, কিন্তু আমরা এক সাতে আসি, ভাল মন্দ মিলাইয়া, ভাগযোগ কইরা সান্তিতেই আসি, এক লগে কোন কিসুই ভেজাল না।
-হুম, আসি আবু, ভালো থেকো
হোসেন বের হয়ে আসতে আসতে আবুর বাবার দিকে তাকায় একবার, মনে পড়তে থাকে আবছা কিছু স্মৃতি,
বাসের জানালার বাইরে দিকে মুখ বের করে, কাচা পাকা দাড়ি নিয়ে একটা মানুষ খুব করে বলে যাচ্ছে........
ভালো থাকিস বাবা, আই এম সরি বাবা, ভালো থাকিস।
হোসেনের চোখ আবছা, হয়ত হোটেলের রান্নার ঝাজের কারণে অথবা অসংগত, অযথা ভাবনার অন্য কোন কারনে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০২০ রাত ১১:১৩