কিছুদিন আগে অফিসের সবাইকে ইমেইল করে ডেকেছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা। বিরাট ইস্যু। ভোটার না হওয়া স্বত্বেও গেলাম আলোচনা শুনতে।
যেকোন ইস্যুতে একটা নিরপেক্ষ (পড়ুন সুবিধাবাদী) অবস্থান নেওয়ার এক অসাধারণ ও মারাত্মক গুণ নিয়ে বাঙ্গালি জাতির প্রতিটা মানুষ ভূ-ভাগে জন্মগ্রহণ করে। দিনের আলোর মত সত্য আর রাতের নিকষ কালো অন্ধকারের মত মিথ্যার ঠিক মাঝামাঝি একটা জায়গা বাঙ্গালি বের করবেই। এরপরেই আত্মপ্রচার করতে থাকবে, "এই দেখ আমি কত নিরপেক্ষ"! নিরপেক্ষ হওয়ার এই ডিলারশিপ ইউরোপবাসীর নেই। এ অঞ্চলের তরুণদের তো নেইই।
অফিসের গ্রুপ মিটিং এ স্যুট টাই পরা কেতাদুরস্ত কর্তা কাটাকাটা ইংরেজিতে তাই সকল ভোটারদের যা অনুরোধ করলেন তার সারমর্ম হল এই- বহুত্ববাদীতা (Diversity) হল ইউরোপের সৌন্দর্য, এখানে সব মতের মানুষ আছে, কঠিন ধার্মিক আছে, ধর্মের কঠোর সমালোচক আছে, এখানে কালো সাদা বাদামি সব রঙয়ের মানুষ আছে, এখানে আছে সমকামী, এখানে সুবিধাবঞ্চিত আছে আবার আছে বিত্তশালী, এখানে বিশুদ্ধ গণতন্ত্রের পাশাপাশি আছে ঘৃণার রাজনীতি। এখন আমাদের এমন নেতৃত্ব বেছে নিতে হবে যারা শুধু সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের স্বার্থ নিয়ে কথা বলে না, বরং সমাজের সকল স্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে, যারা বিশেষ মতাদর্শের প্রতি পক্ষাপাতিত্ব না করে বরং সকল মত প্রকাশের সমান সুযোগ তৈরি করে, যারা সংখ্যাগরিষ্টদের সন্তুষ্ট করতে সংখ্যায় অল্প জনসংখ্যাকে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে ঠেলে দেয় না, যারা মানুষের মতপ্রকাশ ও লৈঙ্গিক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, যারা নারীদের সম্মান করে। যারা মানুষের মাঝে বিভেদের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়, ধর্মের নামে বা বিত্তের গরিমায়, যারা বিভিন্ন মতাদর্শের সমালোচনার গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকার করে না, যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস না করার মত হঠকারিতা দেখায় তাদের ভোট না দিতে অনুরোধ জানালেন। তিনি গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করলেন পৃথিবীতে একটি সমাজ আজও তৈরি হয়নি যেটি ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশ ছাড়া শান্তিশিখরে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে।
একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক (Inclusive) সমাজব্যবস্থার ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়া মানবজীবনের আর কোন সাধনাই সাধনা নয়। সম্প্রতি ভারতের নির্বাচনে এই ধারণা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। এটি হয়েছে জনমানুষের সমর্থনেই। এর পেছনে আছে স্বার্থপর চিন্তাচেতনা। এই বিপদগামী চেতনা নিজ গোত্রের স্বার্থ বুঝে এরা দেশে দেশে সরকার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের শাসনকে সমর্থন করে। এই চেতনায় বিশ্বাসীরা বাংলাদেশে চায় একটি ধর্মবাদী সরকার, নিদেনপক্ষে এমন একটি সরকার ইসলামের প্রতি যাদের প্রেম আছে। অথচ এই এরাই আমেরিকায় চেয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষ হিলারিকে, এরা তুরষ্কে চায় ধর্মভিত্তিক এরদোগানের সরকার, মিশরে চায় জামাতির মত ব্রাদারহুড, সৌদিতে শরিয়া সরকার, মুসলিম সংখ্যালঘু ইউরোপের দেশগুলোতে আবার ধর্মনিরপেক্ষ সরকার। অথচ শুভবাদী, নীতিবাদী অসাম্প্রদায়িক সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্বাসীরা বর্ণে-লিঙ্গে-ধনী-দরিদ্রে-ধর্মে-অধর্মে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে পুঙ্খানু সমতা, বৈষম্যহীনতায় বিশ্বাস করে তারা কামনা করে পৃথিবীর সর্বত্র ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা চালু হোক। হোক তা মুসলিম সংখাগরিষ্ঠ, হোক তা খ্রিষ্টান ইহুদী বা হিন্দু মানুষের দেশ।
বিভাজন আর ঘৃণার মতাদর্শকে বুকে লালন করে, একটি প্রীতিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষাকে আহত করে এই পৃথিবী নামক নীল গ্রহের বেদনাকে আরও বাড়িয়ে আমরা একদিন বিদায় নিব। টিকে থাকবে শুধু ঘৃণা বিস্তারের রাজনীতি।
**সমাপ্ত**
জাহিদ কবির হিমন
২৫ মে ২০১৯
বার্লিন
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১৯ ভোর ৪:১৪