বেশ কয়েক বছর আগের কথা, মাঝে মাঝেই আমার বুকের ভেতর একটা হাল্কা ব্যথা হতো। আধা ডাক্তার আমি সারাক্ষন ভয়ে কাবু হয়ে থাকতাম আর ভাবতাম এ নির্ঘাত হৃদযন্ত্রের সমস্যা। আমার ঘরের লোক আমাকে বুঝাতো "শোনো হার্টে সমস্যা হলে তোমার ব্যথা এমন হাল্কা পাৎলা হতো না, তাছাড়াও বাঁ হাত থেকে চোয়াল পর্যন্ত চিন চিন ব্যথা করতো"।
কে শোনে কার কথা, আমার মনে হতে লাগলো আমি আর বেশিদিন বাচবো না, মনের মধ্যে "হরি দিনতো গেল সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে" গানের সুর বেজে বেজে উঠে। আমার অবস্থা দেখে একদিন সে বল্লো "আমি জানি ডাক্তার না দেখানো পর্যন্ত তো তোমার শান্তি নাই, এখন ভালো কার্ডিওলজিষ্ট কে আছে তাঁর খবর নাও"। আমি বাংলাদেশের এক বিখ্যাত ডাক্তারের সাথে এপয়েন্টমেন্ট করলাম। সাড়ে সাতটায় এপয়েন্টমেন্ট তো বিকেলেই রওনা দিলাম। আমি সাধারনত বাইরে গেলে এমনকি হাসপাতাল/ডাক্তারের কাছে গেলেও হাল্কা পাতলা সাজি যে জন্য অনেক সময় সিস্টার বা অন্যান্য রোগীরা জিজ্ঞেস করে পেশেন্ট কে ? যদি বলি 'আমি' তখন তাদের চোখে মুখে একটা হাল্কা বিস্ময়ের চিনহ দেখা যায়। তাদের ভাব দেখে মনে হয় রোগী মাত্রই দিনতো গেল সন্ধ্যা হলো টাইপ।
ডাক্তারের চেম্বারের কাছাকাছি যেতেই প্রচন্ড যানজট, সময়টা অফিস ছুটির। আমরা রাস্তার এপাশে আর ডিভাইডারের ওপাশে চেম্বার । সময় হয়ে আসছে কিন্ত গাড়ি একচুল ও আগাচ্ছে না। অধৈর্য্য আমি ড্রাইভারকে বলছি হর্ন দাও কিন্ত লাভ কি ! সিদ্ধান্ত নিলাম হেটে পার হবো। কিন্ত গাড়ি থেকে নামতেই দেখি রাস্তার এক পাশসহ ডিভাইডার কেটে কুটে কাদা পানিতে অবস্থা শোচনীয় । সেই কাদাপানি মাড়িয়ে অনেক কষ্টে চেম্বারে ঢুকতেই আমার সিরিয়াল। আমরা দুজন ভেতরে ঢুকলে ডাক্তার নাম ধাম অল্প করে কি সমস্যা জেনে নিয়ে আমাকে পাশের বেডে শুয়ে পরতে বল্লো। এরপর উনি উঠে এসে আমার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বল্লো "দেখি আপনার পা টা ? আমি শাড়ীটা অল্প একটু তুলেই নিজের পা দেখে নিজেই অবাক, একি! এই কি আমার পা !! কাদায়, ধুলায় একাকার নোংরা পায়ের পাতা, নখের ভেতর পর্যন্ত ময়লা ঢুকে আছে, মনে হলো আমি বুঝি সারাদিন মাটি কেটে এসেছি। এর কারন সম্পর্কে আগ বাড়িয়ে কিছু বলাও যায় না।
ডাক্তার আমার সেই নোংরা পা আর আঙ্গুল টানাটানি করলো আর আমাকে কি কি জানি জিজ্ঞেস করলো আমার কানে কিছুই গেল না। বিব্রত আমি আচল দিয়ে মুখ ঢেকে রাখলাম। এরপর উনি চেয়ারে বসে আমাকে উঠে আসতে বললেন। প্রেসক্রিপশন লিখলেন আর বললেন এই টেস্টগুলো করে যেন সাতদিন পরে আসি ।
সপ্তম দিন আমি সকাল থেকে পা নিয়ে বসলাম। প্লাস্টিকের বোলের মধ্যে গরম পানি নিয়ে পা চুবিয়ে রাখলাম আধাঘন্টা, এরপর ঝামা দিয়ে ঘসে ঘসে সব মরা চামড়া না থাকায় জেতা চামড়াই ঊঠিয়ে ফেলার অবস্থা, তারপর নেল কাটিং, ফাইলিং,ময়েশ্চারাইজার,নেলপলিশ। গোসল নাই, খাওয়া নাই, দাওয়া নাই সারাদিন ধরে এই পা নিয়ে সে এক হুলুস্থুল অবস্থা। আমার ঘরের লোক পর্যন্ত হতবাক "কি ব্যাপার তুমি কি পায়ে ব্যাথা পাইছো নাকি ? গরম পানির স্যাক দিচ্ছো যে"!
আমি কোন উত্তর দেই না, নিজের পা দেখে নিজেই মুগ্ধ। আজ রিপোর্ট নিয়ে যাবো, বাসা থেকে তাড়াতাড়ি রওনা দিতে হবে। রেডি হোলা্ম, রেডি আর কি কোনরকমে শাড়িটা পরে আবার পায়ের দিকে তাকালাম, মুখটা হাসিতে ভরে উঠলো। মুখে পাউডার স্নো তো দুরের কথা চুলটা পর্যন্ত আচড়াইনি। ঘরের লোক বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বল্লো "একি তোমার চেহারা এই রকম কেন ! চুলগুলো এমন আউলাঝাউলা! আচড়াও নাই নাকি"!
বললাম 'চলো, চলো সময় নাই, বলে হাত দিয়ে কোনরকমে চুলটা একটু পরিপাটি করার চেষ্টা করলাম , মনে মনে হাসি চুল আচড়ে কি হবে !
ড্রাইভারকে বলেছি একেবারে ক্লিনিকের গোড়ায় নিয়ে গাড়ি পার্ক করতে যাতে পায়ে ধুলা না লাগে। কাগজ পত্র নিয়ে সময়মত ডাক্তারের চেম্বারে ডাক আসলো । ডাক্তার প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিয়ে আমাকে বল্লো "শুয়ে পরুন"। আমি শুয়ে শুয়ে পায়ের দিকে তাকালাম বাহ কি সুন্দর ! ডাক্তার উঠে আসলো, আর এসে দাড়ালো আমার মুখের কাছে "হা করেন দেখি , জিহভা বের করেন, চোখটা দেখি, তারপর স্টেথিসকোপ্টা লাগিয়ে বল্লো "জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেন, ঠিক আছে উঠে আসেন" পায়ের দিকে তাকিয়েও দেখলো না। আমি বিস্ময়ে, ক্ষোভে, দুঃখে কোনরকমে উঠে বসতেই আউলা ঝাউলা চুলগুলো আমার সারাদিনের ক্লান্ত বিদ্ধস্ত চোখ মুখের উপর এসে পরলো আর আমি হতভম্বের মত পা ঝুলিয়ে বসেই রইলাম যতক্ষন না আমার ঘরের লোক বলে উঠলো "কি ব্যাপার নামছো না কেন !
ছবি আমার মোবাইলে, মাছের সাহায্যে পেডিকিওর
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৪৩