সাহসের সীমা আছে, কিন্তু অন্তঃস্থ্য যে আলো আমাকে পথ দেখায়, তার ব্যাপ্তির কোন সীমা নেই, তা আমি জানি। সে আলো অনন্ত, অসীম! সে আলোয় আমি অনেকটা দূর পথ দেখতে পাচ্ছিলাম। গাড়ী জ্যাম ঠেলে ধীর গতিতে এগিয়ে চলছিল, আর প্রত্যেকটা সিগন্যাল পয়েন্টে লাল বাতিতে আটকা পড়ছিল। প্রথমবারে বিমানবন্দরের কাছাকাছি এসে আমাদের গাড়ীটা মাত্র একটা সিগন্যাল পয়েন্টে আটকা পড়েছিল। সিগন্যালে যতই লালবাতি দেখাক, তার পরেও দূরে কোথায় যেন একটা সবুজ বাতির ইশারা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। গাড়ীতে পিন পতন নিস্তব্ধতা, ড্রাইভারও শেষ কথা বলে দিয়ে চুপ হয়ে গিয়েছে- না মুমকিন! আমি মনে মনে সম্ভাব্য সকল পসিবিলিটিজ নিয়ে হিসেব কষতে থাকলাম। অবশেষে দুটো সহজ সমীকরণে পৌঁছাতে পারলাম। এক, যদি সাথে সাথে সেই হলুদ জার্সি পরা ছেলেটাকে সামনে পাওয়া যায়, যার সম্ভাবনা খুবই কম, তবে ব্যাগটা খুঁজে পাওয়া সহজতর এবং দ্রুততর হবে। সেটার সম্ভাবনা শতকরা ২৫%। আর যদি ব্যাগটা সিকিউরিটির লোকজন নিয়ে গিয়ে থাকে, এবং সেটা তখনও জমা না দিয়ে থাকে, তবে তাদের সাথে দেন দরবার করে ব্যাগটা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা ১০% এর বেশী নয়। আর সিকিউরিটির লোকজন যদি ব্যাগটা ওদের আন-এ্যাকোম্পানীড লাগেজ কোয়ারেনটাইনে জমা দিয়ে থাকে, তবে কিছুতেই দুই দিনের আগে সে ব্যাগ ফেরত পাওয়া সম্ভব নয়। বোম্ব ডিসপোজাল টীম ক্লীয়ারেন্স দিলেই তবে সেটা ছাড়া পাবে। ব্যাগটাকে কোয়ারেনটাইনে জমা দেবার সম্ভাবনা বেশী ছিল, কারণ সেটা তালাবদ্ধ ছিল। এসব হিসেব করতে করতে আমি কাশ্মীরের কথা ভুলে আগামী চার পাঁচটা দিন কোথায় কী করবো, তা নিয়ে ভাবা শুরু করলাম।
ঘড়ির দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছিল না, কারো মুখের দিকেও না। ইচ্ছে করছিলো সেই সবুজ বাতির ইশারাটাকে আবার খুঁজে বেড়াতে। তবে সহজে তার নাগাল পাচ্ছিলাম না। এভাবেই এক সময় আবারও সেই টার্মিনাল-২ এর সাইন পোস্ট চোখে পড়লো। তখনো অনেকটা পথ বাকী, অন্ততঃ আরো দুটো ক্রসিং। রাস্তা পার হচ্ছিলাম আর মনে মনে স্মরণ করছিলাম এর আগের বারে পার হবার সময় পথের কোন অংশটা কেমন ছিল। দূর থেকে খুঁজে ফিরছিলাম একটি হলুদ জার্সি পরা ফর্সা মুখ। গাড়ী টার্মিনাল-২ এ ঢুকছে, আর আমি উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছি একটি কালো ব্যাগের নয়, একটি ফর্সা মুখের সন্ধানে। কেন যেন মনে হচ্ছিল, ঐ মুখটাকে পাওয়া গেলে ব্যাগটাকেও পাওয়া যাবে, নতুবা অসম্ভব।
আগেরবার চার নম্বর গেইটে ছেলেটিকে পেয়েছিলাম। এবারে দুই নম্বর গেইটের কাছেই ওকে দেখতে পেয়ে ড্রাইভারকে আচমকা গাড়ী থামাবার নির্দেশ দিলাম। দেখি ছেলেটা টার্মিনালের ভেতরে প্রবেশের জন্য অগ্রসর হচ্ছে। আমি তারস্বরে চিৎকার করে তাকে ডাকলাম। সে পেছন ফিরে তাকিয়ে আমাকে দেখে কাছে এসে বললো, ‘স্যার, আপকা ব্যাগ আভি সিকিউরিটি লোগো মে লে গিয়া’। সে একজনকে দেখিয়ে বললো, তার কাছে গিয়ে অনুরোধ করে দেখতে, ব্যাগটা তখনো জমা না হলে পাওয়া যেতেও পারে। আমি তাই করলাম। লোকটা হাজারো প্রশ্ন শুরু করলো। কোথায় যাচ্ছি, কেন এসেছি, ব্যাগের ভেতরে কি কি ছিল, ইত্যাদি ইত্যাদি। যেহেতু আমার ব্যাগ আমিই গোছাই, আমি পুঙ্খানুপুঙ্খ বয়ান করলাম ব্যাগের ভেতরে কি কি আছে। শুধু আমি যখন তার প্রশ্নের উত্তরে এক পর্যায়ে বলছিলাম যে ‘সাইড পকেটমে মেডিক্যাল ডকুমেন্টস কা ফটোকপি হ্যায়’, তখন সে বোধহয় ‘ফটোকপি’ কথাটা বুঝতে পারেনি। সে আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘কোই ডকুমেন্টস কা যেরক্স থা?’ আমি বুঝতে পারলাম যে সে সহজ কথা ‘ফটোকপি’ বুঝতে অক্ষম, কিন্তু কঠিন কথা ‘যেরক্স’ বুঝতে পারঙ্গম। যে দেশে যেই বুলি! আমি সাথে সাথে বলে উঠলাম, হাঁ হাঁ, যরুর থা। তখন সে আমার পাসপোর্ট দেখতে চাইলো। পাসপোর্ট বের করে দেখালাম, সে তার সেলফোনে একটি ছবি তুলে ওয়াকি টকিতে কাকে যেন কি বললো। আমাকে অপেক্ষা করতে বলে সে টার্মিনালের ভেতরে প্রবেশ করলো। এতক্ষণ ধরে সে নিরন্তর জেরা করে যাওয়াতেও খারাপ লাগেনি, কারণ সে প্রশ্ন করে যাচ্ছিল, আমি উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম এবারে সে ভেতরে চলে যাওয়াতে আরেক নিরন্তর অপেক্ষার পালা শুরু হলো। এদিকে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে টিক, টিক, টিক!!! প্রতিটি চলমান মুহূর্ত বুকের মাঝে কিক করে যাচ্ছিল, তবুও মনের মাঝে একটা আশার বাণী বলে চলেছিল, ব্যাগটা আমি পেয়ে যাব ঠিক, ঠিক, ঠিক!
চলবে....
ঢাকা
১১ মে ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০১৯ সকাল ১১:৪০