রাত প্রায় ৪টা। কয়েক ঘন্টা পরই সীমার প্লেন ল্যান্ড করবে ঢাকায়।
উত্তেজনায় ঘুম আসছে না খালেদের। একটু পর পরই ওয়েবসাইটে ঢু মারছে সে। প্লেনটা ঠিক কোথায় আছে সেটা জানার জন্যই এই কাজ। সীমা আর খালেদের বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় ৩ বছর। বিয়ে হয়েছে ঠিকই কিন্তু একসাথে আর থাকা হয় নি। বিয়ের ১ বছরের মাথায় সীমা চলে গেল কানাডা, পড়াশোনা শেষ করতে। এরপর প্রতিবছরই মাত্র ১৫-২০ দিনের জন্য সীমা আসে বাংলাদেশে। এই ১৫-২০ দিন যেন ঈদ ওদের কাছে। দুজন মিলে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি আরও কত কি।
খালেদের ঘুম নেই। সারাদিন ধরে ঘর, বাথরুম পরিষ্কার করেছে। তাও চোখে ঘুম নেই। কিন্তু ঘুমানো তো দরকার, না হলে কাল সীমা আসবে, আর খালেদ সারা দিন ঝিমাবে। সীমার অবশ্য কোন ক্লান্তি থাকে না। সে ২০ ঘন্টা প্লেন জার্নি শেষ করার পরও হাসিমুখে সবার সাথে কথা বলবে, এদিক-সেদিক ফোন করবে, চিৎকার করে ঘর মাথায় তুলবে।
এ সব কিছুই গত কয়েক বছর ধরে খালেদদের বাসা থেকে অনুপস্থিত। সমস্ত বাসাটা যেন সাদামাটা একটা আবরনে ঢেকে থাকে। খালেদ শুয়ে শুয়ে ভাবে, কিভাবে কেটে গেল কয়েকটা বছর। এইতো সেদিনের কথাইতো - সীমা কত কান্না করল, সে কিছুতেই কানাডা যাবে না। কিছুতেই না। খালেদ শেষ পর্যন্ত বকা দিয়েই ওকে রাজী করাল। বোঝাল বাইরে পড়াশোনা করে ডিগ্রী নিয়ে দেশে কত ভাল ভবিয্যৎ গড়তে পারবে। সীমা কত কাদল, তারপরও কত কাদল।
মনটাই খারাপ হয়ে যায় খালেদের। হুম মেয়েটাকে জোর করে কানাডা পাঠানো হলো। এখন বছরে ২ সপ্তাহের বেশি তো দেখা হয় না। সেটা তো ভালো হচ্ছে না। সে নিজেই কানাডা যেত, পড়াশোনা করতে, কিন্তু তাদের অবস্থা এতটাও শৌখিন ছিল না যে বিদেশে পড়াশোনার খরচ সে বহন করতে পারত। সীমার বাবা পড়াশোনার সব খরচ দিয়েছেন বলেই তো আজ সীমা কানাডায় পড়াশোনা করতে পারছে।
খালেদ আবার ওয়েবসাইট টা গুতিয়ে দেখে। হ্যা প্লেন ঢাকায় ল্যান্ড করবে এক ঘন্টার মধ্যেই। ঐ ব্যাটা ড্রাইভার এখনও গাড়ী নিয়ে আসেনি। এয়ারপোর্ট যেতে দেরী হয়ে যাবে তো। কিন্তু কিছু বলার নেই। খালেদ দের নিজেদের কোন গাড়ী নেই। খালেদের বড় খালার গাড়ী চাওয়া হয়েছে। যেহেতু আরেকজনের গাড়ী - তাই ফোন করে ড্রাইভার কে গুতানোও যাচ্ছে না।
খালেদ শার্ট-প্যান্ট পড়ে রেডী। একটু পর তার বাবাও এসে দরজায় টোকা দিলেন। গাড়ী চলে এসেছে। যাক, একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল ও। হয়ত ওদের নিজেদের গাড়ী থাকলে, সীমাকে কানাডা যেতে দিত না খালেদ। হয়ত বলত "ঠিক আছে, তোমার কানাডা যাওয়া লাগবে না, আমাদের গাড়ী আছে। আমরা সারাদিন গাড়ীতে ঘুরে বেড়াব"।
কি সব ভাবছে ও! বাবা মা তৈরী। বাসায় তালা দিয়ে সিড়ি দিয়ে নামল ওরা। বাইরে মাত্র আলো ফুটে উঠেছে। রাস্তা প্রায় খালি। এয়ারপোর্ট পৌছতে ১০ মিনিটও লাগল না। টার্মিনালে মানুষের সংখ্যাও কম। মনিটরে দেখাচ্ছে সীমার প্লেন রানওয়েতে নেমেছে। এখন শুধু ওর বের হওয়ার পালা।
প্রতিটা মিনিট যেন ঘন্টার মত কাটছে। প্রায় ২০ মিনিট পর দেখা গেল সীমার অবয়ব। ছোটখাট একটা মানুষ, গায়ে মেরুন রংয়ের শাল জড়ানো। ইমিগ্রেশনের কাচের মাঝ দিয়ে খালেদ সীমাকে দেখতে পাচ্ছে। একবার হাত নাড়ল সীমা। খালেদ অনড়। ওর মা বলে উঠলেন "ঐ যে সীমা, আমি দেখছি। ঐ যে, ঐটা সীমা না? "। খালেদ বলল "হু"। খালেদের বাবা কোনভাবেই ঐ ভীড়ে সীমাকে খুজে পেলেন না। বয়স হয়েছে বাবার।
একটু পরই সীমা ট্রলী ঠেলতে ঠেলতে বের হয়ে এল। এসেই একান-ওকান হাসি। বাবা-মা কে সালাম করল, এরপর খালেদকে বলল "কেমন আছ?" খালেদ এমন ভাবে 'ভাল' বলল, যেন সে খুবই উদাস।
বাসায় ফেরার পথে, সীমার কত প্রশ্ন "আরে এই বিল্ডিং টা কবে তৈরী হলো, ঢাকা তো একদম গরম না" - আরও কত কি! সব প্রশ্নের উত্তর বাবাই দিচ্ছেন। খালেদ বাইরে তাকিয়ে সকালের ঠান্ডা বাতাস খাচ্ছে। সীমা একটু পর পর খোচা দিচ্ছে - খালেদের হাসি চেপে রাখতে একটু কষ্টই হচ্ছে।
বাসায় এসেই সীমা ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ল। কত গল্প ওর। সারা জার্নিতে কি হয়েছে, কে কি বলেছে আরোও কত কি! এদিকে খালেদ বসে বসে ঝিমাচ্ছে।
এরপরের ১৫ দিন যেন উড়ে উড়ে গেল। এ কদিন বলতে গেলে শুধু আত্মীয়-স্বজনের বাসার দাওয়াত খেয়েই কাটানো হয়েছে। আর রিকশায় ঘোরাঘুরি। সীমা বলে, কানাডায় গিয়ে একটা জিনিস নাকি ও খুব মিস করত, সেটা হচ্ছে খালেদের সাথে রিকশায় ঘোরা। ওখানে তো আর রিকশা নেই। আবার সীমা বায়না ধরেছে স্টুডিও তে গিয়ে ছবি তুলবে। খালেদ আবার দেয় বকা - কি সব ছেলেমানুষি কারবার। কিন্তু সীমা যাবেই, না হলে আবার কবে?
কাল রাতেই তো ফ্লাইট সীমার। আবার সেই কানাডা, আবার ফেসবুক আর স্কাইপে রাত জেগে জেগে কথোপকথন। রাত হয়ে গেলেও খালেদ ছবি তোলার জন্য স্টুডিওতে নিয়ে গেলো সীমাকে। রিকশা থেকে নেমে রাস্তা পার হবে, গাড়ী গুলো চলে গেলেই।
হঠাৎ সীমা চুপিচুপি খালেদের কানে কানে বলল "আচ্ছা আমি চলে গেলে কি আমাকে খুব মিস করবে?"।
বুকের ভেতর কোথায় যেন কি একটা মোচড় দিয়ে উঠল। খালেদ কোন উত্তর দেয় না। একমনে তাকিয়ে থাকে রাস্তাটার দিকে। দূরে একটা গাড়ী আসছে, এখনই সুযোগ রাস্তা পেরিয়ে যাবার। না হয় পরে আবার আটকে যাওয়া লাগবে।
গাড়ীটার আলো এসে পড়ল ওদের গায়ে। সে সীমার হাত শক্ত করে ধরল।
রাস্তাটা খালেদকে পার হতেই হবে।
*হুট করে লেখা, দোষ-ভূলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ৮:২২