মনে পড়ে দীপুদা, সেই যেবার তুমি মির্জাপুর ক্যাডেট থেকে এস এস সি তে সারা বোর্ডে প্রথম হয়ে বাড়ি এলে, তোমাকে নিয়ে বাড়ির সবার সে কি উচ্ছাস! এমনিতেই পুরো বাড়িতে তুমি ছিলে আমাদের আইডল। কেউ পড়ালেখা না করলেই বা অন্য কোনো দুষ্টুমী বা বড়দের চোখে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাওয়া ছেলেবেলার খুব খুব শুদ্ধ কাজগুলোও করে বসলেই সকলেই চোখে আঙ্গুল তুলে উদাহরন দিত তোমারই। দেখ দেখ দীপুকে দেখে শেখ, মানুষ কেমনে হতে হয় বা এই বাড়ির এক ছেলে একদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী হবে আর একজন হবি তুই তার টয়লেট ক্লিনার।
এমন সব বাক্যবাণে আমাদেরকে অহরহই জর্জরিত হতে হত। ছোট থেকে তুমি বা তোমার নাম এই বাড়িতে আমাদের কাছে ছিলো কিছুটা আতংকের নাম। বড়দেরকে খুশি করতে হলে তোমার মত হতে হবে। বিদ্যায়, বুদ্ধিতে এবং চলনে বলনেও তোমার স্মার্টত্ব, তোমার গুনগান শুনতে শুনতে আমাদের কান ঝালাপালা হয়ে যেত। তুমি তো আর থাকতে না তাই জানতে না তবে ছুটি ছাটায়, পালা পার্বনে যখনই বাড়ি আসতে তখন সব চাচা চাচীদের ঘরে ঘরে তোমাকে নিয়ে আদিখ্যেতাও মনে হয় তোমাকে দারুন অহংকারীও করে তুলেছিলো। তাই ওমন গোমড়া হয়ে উঠছিলে তুমি দিনে দিনে।
কিন্তু যতই গোমড়া হও আর অহংকারী হও তুমি। তোমার নাম কিংবা আগমন মানেই আমার কাছে বিশেষ কিছু ছিলো। যে কোনো ছুটি ছাটায় তোমার আগমন ধ্বনিতেই আমি সন্ত্রস্ত হয়ে উঠতাম। নিজেকে সুন্দর করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতাম। লুকিয়ে চুরিয়ে পারুল আপুর কাঁচা হলুদ বাঁটা চুরি করে মুখে ঘষতাম। পারুল আপুর জন্য ভীষন মায়া ছিলো আমার। এত বয়স হয়ে যাবার পরেও তার কিছুতেই বিয়ে হচ্ছিলো না। কৃষ্ণ গাত্রবর্ণের কারণে পাত্রপক্ষের কাছে বারংবার নাকচ হয়ে যাওয়া পারুলআপুর জন্য তাই আমার ছিলো দারুন মায়া। এই মায়াবতী পারুল আপু যার জন্য মানে যার গাত্র বর্ণ উজ্জ্বল করে তোলার জন্য হলুদ, চন্দন বাটা গায়ে মাখা রোজকার নির্দেশ ছিলো তার থেকে চাইলেই হয়তো একটু কাঁচা হলুদ বা চন্দন বাটা জোগাড় করা যেত। কিন্তু লজ্জায় তাকে বলতেই পারতাম না। তাই চুপি চুপি তার হলুদ বা চন্দনের বাটি থেকে একটু হলুদ বা চন্দন লুকিয়ে তুলে নিয়ে আবার আঙ্গুল দিয়ে চেপে চুপে ঠিকঠাক করে রাখতাম। ভাবতেই হাসি পায় ছোটবেলার এই কান্ডগুলো। সেই ভীষন নিরপরাধ চুরিটুকু করতেও বুকের ভেতরে যে কতই হাঁপরের বাড়ি শুনতে পেতাম।
তোমার আগমন উপলক্ষে মিনুভাবীর থেকে চেয়ে নিতাম তার মন মাতাল করা সুগন্ধী শ্যাম্পু। ভাইয়া সৌদি আরাব থাকতেন আর প্রতি মাসেই কাউকে না কাউকে দিয়ে ভাবীকে পাঠাতেন এমন সব উপহার যে আমরা মুগ্ধ হয়ে যেতাম। সবাই মিলে গোল হয়ে বসে দেখতাম নিত্য নতুন নাম না জানা সেসব উপহার সামগ্রী। মিনুভাবী রাজকন্যার মত সুন্দরী ছিলেন। তার মনটাও ছিলো রাজকন্যার মতই। সেসব উপহার তিনি একা একা উপভোগ করতেই পারতেন না যেন। আমাদেরকে ডেকে বিশেষ করে তার চকলেটের বাক্স থেকে সবই বিলিয়ে দিতেন। আর তার ছিলো ছোট্ট একটি ভাই তার জন্য কাঁচের বোতলে করে আলমারীর উপরে তুলে রাখতেন এক বোতল চকলেট। সে চকলেটে হাত দেওয়া মানা। কি ভীষন ভালোবাসতেন তিনি ঐ ছোট্ট রাজকুমারের মত দেখতে ৬/৭ বছরের পিচ্চি ভাইটাকে।
সে যাইহোক, চাচাত ফুফাতো ভাইবোন মিলিয়ে আমাদের বিশাল টিম ছিলো। তাই ঈদ বা নানা রকম পালা পার্বন উপলক্ষে দেশের ভেতর ও বাইরের নানাস্থান থেকে যখন সকলে জড়ো হত তখন উৎসব মুখরতায় গম গম করে উঠতো যেন চারিদিক। বাড়ির পিছের আমবাগানে চুড়ুইভাঁতি থেকে শুরু করে বউচি, গোল্লাছুট, ফুলটোক্কা বা ব্যাডমিন্টন খেলায় মুখর হয়ে উঠতাম আমরা। খুব মনে আছে ভেতর বাড়ির বারান্দাতে বিকাল হলেই মা চাঁচীরা বসতেন গোল হয়ে। কেউ কেউ কুরশি কাঁটায় অপূর্ব মায়াজালের নক্সায় নানা রকম ঢাকনী বুনতেন। কেউ কেউ নিয়ে বসতেন লুডু বা তাস। আমাদের চাচা ফুফাদের মত আমাদের চাচী ফুপুরাও কেউ কেউ তাস খেলাতেও দারুণ পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন।
আর চুড়ুইভাতির কথা যখন মনে পড়ে সেসব দিনগুলোতে ফের ফিরে যেতে ইচ্ছে করে আমার।সকাল সকাল উঠে চাচা ফুপু ভাই ভাবীদের ঘর ঘর হতে চাল ডাল ডিম যোগাড় করা। কারো কারো থেকে আলু, পিয়াজ মসলা চেয়ে নিয়ে সেসব দিয়ে মাঠের মাঝে চুলা কোঁদাল দিয়ে কুপিয়ে, ইট বসিয়ে সে কি রান্নার ধুম। সেই উনুন জ্বালানোর জন্য কুঁড়িয়ে আনা হত নানা রকম গাছের শুকনো ডাল। এই চুলা কাটা বা ডাল কুড়ানোর কাজটা ছিলো ছেলেদের উপর। আর মিলি আপার রান্না ছাড়া কোনো রান্নাই জমতো না। তারপর সবাই মিলে ভেজা ভেজা মানে ধুয়ে আনা কলাপাতার পাত্রে খাওয়া আর এরপর নাচ গান কবিতার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সত্যি আমাদের সেই সব ছেলেবেলা এখনকার বাচ্চারা কি আর ভাবতে পারে?
আমার খুব মনে আছে তুমি যেবার ক্লাস সিক্সে ক্যাডেটে চলে গেলে আমি তখন বেশ ছোট, তবুও তোমার সেই ক্যাডেটে চান্স পাওয়াটা বা তাই নিয়ে বাড়িতে সবার হইচই সেই স্মৃতিটাকে জ্বলজ্বলে করে রেখেছে। খুব পড়ুয়া ছিলে তুমি তেমনি খেলাধুলাতেও তুখোড়। তবে যতদূর মনে পড়ে বরাবরই মুখ গোমড়া অহংকারী ভাবটা ছিলোই তোমার। অন্যান্য চাচাতো ফুফাতো ভাইবোনের মত তোমার সাথে তেমন সখ্যতা হয়নি আমার সেই ছেলেবেলাতেও। প্রতি ছুটিতেই আসতে তুমি। কি স্মার্ট ইংলিশে কথা বলা বা পোষাকে আশাকে একটা ঝকঝকে তকতকে ভাব আমাদেরকে যেন ম্রীয়মানই করে তুলতো। সকলের চোখই তোমার দিকে কিন্তু তোমার তেমন কারো দিকে তাকাবার প্রয়োজন নেই। আমাকে তো তোমার চোখেও পড়তোনা বুঝি মানে পাত্তাই দিতে না। কিন্তু তুমি বা কেউই জানতো না আমার কিশোরীকাল থেকেই তুমি হয়ে উঠেছিলে আমার স্বপ্ন পূরুষ। প্রতিটা ছুটি বা উৎসবেই আমি অপেক্ষা করতাম মনে মনে তোমারই জন্য। কিন্তু ভয়ে কখনও কাছা কাছি যাবার সাহস পেতাম না বা মনের কথা বলারও। ব্যাডমিন্টন খেলাটাই তোমার বিশেষ প্রিয় ছিলো। আর দাবা খেলাতেও তুমি প্রায়ই হারাতে বড় চাচুকে।
সেবার ঈদের ছুটিতে যখন তুমি এলে তুমি মনে হয় সেবার এস এস সি দিয়েছো। রেজাল্টের অপেক্ষায় আছো আর আমি সদ্য ক্লাস নাইনে উঠেছি। এক বিকেলে আমরা ছোট বড় সবাই মিলে লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠলাম। কে যেন বুড়ি হয়েছিলো ঠিক মনে নেই। তবে এক দুই গোনা শুরু হতেই আমি এক ছুটে পালিয়ে এলাম বাগানের এক ধারে পুরোনো বট আর অশত্থ যেখানে জড়াজড়ি করে এক বিশাল আড়াল দিয়েছে সেখানটাতেই। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই হঠাৎ পিঠের উপর কিসের যেন গরম নিশ্বাস! আমি ভীষণ ভয় পেয়ে চোখ বুজেই চিৎকার দিতে গিয়েছিলাম। এমন সময় তুমি আমার মুখ চেপে ধরলে। ঠোঁটের উপর আঙ্গুল চেপে আমাকে ইশারা করলে চুপ থাকতে। ঘটনার আকস্মিকতায় আর তোমার আলিঙ্গনের মাঝে আমি তখন কম্পমান তরাস লতা। অবষন্নতা আর হ্তবিহ্বলতায় এলিয়ে পড়ার প্রাক্কালে দেখতে পেলাম তোমার পাতলা ফিনফিনে সরু গোফের নীচের লালচে ওষ্ঠদ্বয়।
দীপুদা সেই শুরু.....
তোমাকে দেবতা ভেবে নেবার সেই শুরু আমার ......
আমার দীপুদা- ২
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:২৬