আমি সব কিছু নিজের ভেতরে লুকিয়ে ফেলে হাসিমুখে দিন কাটাই। সব কাজিনরা মিলে ঠিক করে হলুদে কি পরবে, কি গাইবে, কি নাচবে। আমি তাদের সকল উৎসাহ উদ্দীপনার উৎসব মিটিং এ নীরবে উপস্থিত থাকি। আমার ভাগ্যে পড়ে দলীয় বেশ কয়েকটা নাচ। আমি বা আমরা কোনোদিন নাচ শিখিনি। আমাদের বাড়িতে এই সব নাচ গান বা কালচারাল কিছুর তেমন প্রচলন ছিলো না। এমনকি আমাদের বাড়িতে পূর্ব পুরুষদের মাঝেও কোনো লেখক বা কবি সাহিত্যিক বা শিল্পী হবার কারো কোনো নজির নেই। তবুও এই বিয়ে উপলক্ষে আমাদের বাড়ীর বড়রা এই গান নাচ এলাউ করে ফেলে। রোজ বিকালে আমাদের ট্রেইনিং হয়। আমরা অবাক হয়ে দেখি মিলি আপা আমাদের ভেতরে সবচেয়ে সুন্দরী আর কর্ম পটিয়সী এই বড় বোনটি যে কোনো নাচ তুলতেও বিষম পারদর্শী। কোমরে ওড়না জড়িয়ে রাজহংসীর মত মরাল গ্রীবা তুলে নানা ভঙ্গিমায়, নানা ছন্দে নেচে চলে মিলি আপা। তাকে দেখতে কি যে ভালো লাগে। মিলি আপার ফরসা পায়ের পাতায় হেনার কারুকাজ। মিলি আপা খুব সৌখিন আর সুন্দর। এমন মেয়েদেরকেই মনে হয় শঙ্খিনী বলা হয়। মিলি আপার তাড়ায় এই সব সাঁত পাচ স্বপ্ন থেকে ফিরে ফের নাচে মন দেই। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এবং আমাদেরও ঐকন্তিক চেষ্টায় শেষ মেষ আমরা সবগুলো নাচই পারদর্শীতার সাথেই তুলে ফেলি।
মা চাচী ভাবীদের নতুন গহনা গড়ানোর বা বিয়েতে পরার নতুন শাড়ি কেনার ধুম পড়ে। দীপুদার বউকে কি উপহার দেওয়া হবে। যৌথ না একক নাকি পুরো বাড়ির সব ঘরগুলি এক হয়ে কোনো বিশাল কিছু এমনই নানা জল্পনা কল্পনায় মুখর হয়ে থাকে এই বাড়ির প্রতিটি মানুষ। কোন সুদূরে রাজশাহীতে দীপুদার বিয়ের আয়োজন চলছে তার ঢল এসে লাগে বুঝি আমাদের বাড়িতেও। দীপুদা বউ নিয়ে এ বাড়ীতে আসবেন ঘুরতে সেই উপলক্ষে ঘর দূয়ার রং করাও হয়। বিয়ে উপলক্ষে ফুপু আমাদের সবাইকে হলুদের শাড়ী দেন। বৌভাতে পরার শাড়ীও।এই বিবাহ উৎসব নিয়ে মেতে ওঠা বাড়িটিতে সকলের অলখে এক বুক ব্যাথা চেপে সকলের সাথে সামিল হয়ে গিয়েছি আমিও। তবে এই শাড়ী দুটি পাবার পর আমার যে কি হলো। আমি চুপচাপ আমার নিজের ঘরে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে শাড়ী দুটি বুকে চেপে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। সেই কান্নার সঠিক কারণটা কি আমি খুঁজি না বা আমি ঠিক জানার চেষ্টাও করি না। শুধু মনে আছে বুকের ভেতর চাপা কষ্ট। গলার কাছে এক দলা অসহনীয় ব্যাথা! বোবা কান্না যা কাউকে কখনও দেখানো যাবে না।
একদিন ভোরে আমরা সবাই বাস ভাড়া করে রওয়ানা হই রাজশাহীর উদ্দেশ্যে। আমি সকলের সাথে হাসি ঠাট্টা গানে মেতে রইলাম পুরোটা পথই। পুরো গাড়ি জুড়েই আনন্দের ঘনঘটা। বহু দিন এইভাবে এক সাথে কারো কোথাও যাওয়া হয়নি। দীপুদার বিয়ে উপলক্ষে সবার যেন এক মহা মিলনমেলার আয়োজন হলো। টিফিন ক্যারিয়ারে করে পোলাও মাংস থেকে নানা রকম পিঠা পুলি চিপস বিস্কিটে পুরো বাসটাই যেন হয়ে উঠলো এক বনভোজনের মাঠ। কিন্তু ক্ষনে ক্ষনে মনের ভেতরে উঁকি দিচ্ছিলো হাজারও প্রশ্ন। দীপুদার সাথে অনেকগুলো বছর দেখা নেই আমার। কেমন হয়েছে সে দেখতে? তার সাথে দেখা হবার পর বা আমাকে দেখার পর তার কি মনে পড়বে সেই ফেলে আসা বিকেলের কথা? তার কি একটু দুঃখ হবে নাকি লজ্জা পাবে? মেজো ফুপুর পছন্দের এই মেয়েটিকে বিয়ের কথা হবার সময় দীপুদার কি একটাবারও মনে পড়েনি সেই শীত বিকেলের স্মৃতি? তবে কি দীপুদার সেই বিকেলটা কোনো মুহুর্ত ভুলের বিকেল ছিলো? কেমন দেখতে সেই নতুন বউটা? আমার থেকেও নিশ্চয় অনেক বেশি সুন্দরী। শুনেছি মেয়েটা নাকি মেডিকেলে পড়ছে। ডাক্তারনী বউ হবে দীপুদার। কত শত প্রশ্ন খেলে যায় আমার মনে।
হই হই করে আমরা গিয়ে পৌছাই দীপুদাদের বাড়িতে। মেজোফুপুর উষ্ণ অভ্যর্থনা ও বিয়ে বাড়ির সাজ সাজ রবে মিশে যাই কিছুক্ষনের মাঝেই। দীপুদার সাথেও দেখা হয় আমাদের। সে তো চিরদিনের গুরু গম্ভীর যেমনটা আগেও ছিলো এখনও রয়ে গেছে। তবে তার চেহারা চলনে বলনে অনেক খানি বদলে গেছে । আরও আরও বেশি স্মার্ট আরও আরও বেশি চৌকস যেন কথায় বার্তায় এবং আরও আরও অনেক বেশি কাঠিন্যে ঘেরা তার চোয়াল! সেই এস এস সি এর পরের দীপুদার সাথে আজকের দীপুদার বড় বেশি অমিল। তবুও দীর্ঘশ্বাস! আমাদের এতজনের মাঝে আমাকে ঠিক আলাদা করে দীপুদার চোখেও পড়লোনা মনে হয়। আমিও একটু আবডালই খুঁজছিলাম তবুও আমার তীক্ষ্ণ চোখে দীপুদাকে খুঁটিয়ে দেখতে ভুল করিনি আমি। সারাবাড়ি ফুলে ফুলে সেঁজে উঠেছে। হলুদ মেহেদী, হলুদের ডালা কূলা নিয়ে বসে যাই আমরা। নানা ভাবে নানা সাজে ফুটিয়ে তুলি নতুন বউ এর জন্য হলুদের সরঞ্জামগুলি। এসব নিয়ে কাজ করতে করতে আমি বার বার হারিয়ে যাই একটি বহু কাঙ্খিত কিন্তু এখন যা একবারেই অবাস্তব এমন একটি স্বপ্নে। চলচিত্রের মত বার বার চোখে ভাসে হলুদের সাজে এসব ডালা কুলার সাজ নিয়ে হলুদের বউ সাজে বসে আছি আমিই।
খুব ধুমধাম করে দীপুদার হলুদ হলো।একরাশ গোলাপ গাঁদার মাঝে হলুদের সুসজ্জিত স্টেজটার উপর গরদের পাঞ্জাবী আর পায়জামাতে দীপুদাকে আজ দেখাচ্ছিলো যেন সত্যিকারের রাজকুমার। আমরা সবাই সাজগোজ করে নাচলাম, গাইলাম শুধু আমি দীপুদার কপালে হলুদ ছোঁয়াতে পারলাম না। সবাই যখন একে একে তাকে হলুদ ছুঁইয়ে দিচ্ছিলো, মিষ্টি মুখ করাচ্ছিলো। আমি সবার অলক্ষ্যে চুপচাপ উঠে এসেছিলাম ছাঁদে। ছাঁদ আমার খুব প্রিয়। আমার প্রিয় বন্ধু। আকাশের বিশালতা যেন এই ছাঁদেই দাঁড়ি্যে থাকে। আকাশের এই নির্মল, নির্বাক ও নির্লিপ্ততার মাঝেও সেও যেন আমার মনের সকল কথা বুঝে নেবার একজন প্রিয় বন্ধুই হয়ে থাকে। সেই সন্ধ্যায় যখন ওদের ছাঁদে উঠে এলাম। পুরো বাড়িতেই তখন উৎসবের আনন্দ। বাসাটা ফ্লাট বাসা ছিলো। ৬টি ফ্যামিলীর বসবাস ঐ বাড়িতে। তবুও মফস্বলের শহর হওয়ায় এক বাড়িতে অনুষ্ঠান মানে পুরো পাড়ারই সেখানে জমজমাট উপস্থিতি। ঐ ৬ ফ্লাটের কোনো বাসিন্দাই মনে হয়না সেদিন সেখানে ছাড়া আর কোথাও ছিলো।
কিন্তু সকলের থেকে পালিয়ে ছাঁদে কিছুক্ষন একা থাকতে আসলেও পুরোপুরি একা হতে পারলাম না। ছাঁদের এক কোনে একটি ছেলে একা একা দাঁড়িয়ে ভোস ভোস সিগারেট ফুঁকছিলো। সে আমাকে হঠাৎ এমন সময়ে ছাঁদে দেখেই হয়ত ফিরে তাকালো । আমাকে ঐ হলুদবাড়ির সাজে একা একা ছাঁদে দেখে মনে হয় একটু অবাকও হলো। তবে এক পলক তাকিয়েই আবার নিজের মনে অন্য দিকে ফিরেই সিগারেট টানতে লাগলো। কিন্তু আমার মাঝে একটা অস্বোয়াস্তি কাজ করছিলো। এমন ভর সন্ধ্যায় একাকী আমি ছাঁদে একই ছাঁদে আরেকজন অপরিচিত যুবক। দুজন মাত্র মানুষ এই ভর সন্ধ্যায় একাকী ছাদে। ব্যাপারটা আমাকে স্বস্তি দিচ্ছিলো না। তবুও আমি তাকে পুরোপুরি ভুলে গিয়েই নিজের মাঝে নিজে আত্মস্ত হতে চাইছিলাম। কিন্তু আমার অজান্তেই আমার চোখ দিয়ে যে কখন অবিরল প্রস্রবন ধারা তা বুঝি আমি নিজেও জানতাম না। অপ্রতিরোধ্য কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছিলাম আমি।
হঠাৎ শুনতে পেলাম একটি কন্ঠস্বর, আমার খুব কাছাকাছি।
- আপনাকে আমি একটা জোক শুনাতে চাই..
চমকে উঠলাম আমি। মনে পড়লো আমি ছাড়াও ছাদে আরেকজন রয়েছে তবে মনে পড়ায় বা হঠাৎ কন্ঠস্বরে যত না চমকেছি তার থেকেও বেশি চমকালাম তার কথা শুনে। বলে কি এই লোক! জানা নেই, চেনা নেই আমার কি হয়েছে সে সম্পর্কে কোনো প্রশ্নও নেই, আমার এমন পরিস্থিতিতে তার মাথায় জোকস আসে কি করে? আমি বিস্ফারিত নেত্রে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ছেলেটা বললো,
- ভাববেন না আমি ফ্লার্ট করছি। আপনার চোখ দুইটা খুব সুন্দর জানেন?
এই কথায় আমার চোখ মনে হয় আরও বিস্ফারিত হয়ে গেলো। মনে মনে ভাবলাম, এটাই জোক নাকি? আমার ভাবনাটা বুঝি সে বুঝে ফেললো। সে বললো,
- এটা জোক নয়। আমি অন্য জোকসের কথা বলছি।
আমাকে নিরুত্তর দেখে ফের বললো,
-ঠিক আছে একটা ম্যাজিক দেখেন ....
আমি কিছু বলার আগেই সে আমার আঁচলের এক কোনা টেনে নিয়ে তার হাতের লাইটার দিয়ে ফস করে আগুন জ্বালিয়ে ফেললো। আমি চিৎকার করে উঠতে যাবার আগেই সে সেই আগুন মুঠোবন্দী করে পিষে মেরে ফেললো। তারপর আঁচলের কোনাটা মেলে ধরে দেখালো অক্ষত কারুকার্য্যময় আঁচল.....
আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমার কান্না কোথায় উড়ে গিয়েছিলো জানিনা আমি। সে বললো,
- ঠিক এই আগুনটার মতই সব দুঃখ কষ্ট বেদনাকে জীবন থেকে পিষে ফেলুন। এই ঝকঝকে তকতকে কারুকার্য্যময় আঁচলটির মত বুনে তুলুন নিজের জীবনটাকে। এই দায়ভার শুধু আপনার হাতে আর কারো হাতে নয়। আপনার জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলবার কারিগর একমাত্র আপনি..... গুডলাক....
ছেলেটা নেমে গেলো। হাতের তর্জনীতে তার লাইটারের রিংটি ঘুরাতে ঘুরাতে। একবারও পেছন ফিরে চাইলো না। ঠিক যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনো দেবদূতের মতই সে আমার কানে কিছু সঞ্জীবনী বাণী দিয়ে গেলো। সেই সঞ্জীবনী সুধার পরশে আমি নতুন আমি হয়ে উঠলাম.....
এবার থেকে শুধুই আমি ......আমার হবো....
চলবে...
আমার দীপুদা- ২
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১০:৫৯