somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রামায়ণের শোলক সন্ধান: বাল্মিকী কি ভিল জাতির মানুষ?

২৫ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ২:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পৌলস্ত্য বধ কাব্য নামে বাল্মিকীর হাতে যখন রামায়ণের আদি পুস্তকটা রচিত হয় তখন এর শত্রু-মিত্র-নায়ক সকলেই আছিল রক্ত মাংসের মানুষ। কালে কালে এর নায়ক রাম যতই অবতার হইতে থাকেন ততই তার মিত্ররা হইতে থাকে নখ-ল্যাঞ্জা-লোমওয়ালা জন্তু জানোয়ার আর শত্রুপক্ষ পরিণত হয় রাক্ষস খোক্কস কিংবা ভূতুমের রূপকথায়। আর পৌলস্ত্য বধ থাইকা পুস্তকখান রামায়ণ হইবার পথে রাম-রাবণ-বামুন-বান্দর সকলেই হইয়া উঠেন বেসুমার অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী; শুধু একজন মাত্র থাইকা যায় রক্ত-মাংস-আবেগের মৌলিক মানুষ। সেইটা হইল বাপে ফালায়া দেওয়া- শত্রুতে টাইনা নেওয়া- স্বামীতে খেদাইয়া দেওয়া সীতা...

হয়ত শুধু নারী হইবার কারণে রাম-রাবণ-বান্দর-বৈষ্ণব কেউই তারে স্বতন্ত্র মানুষ না ভাবায় একমাত্র এই চরিত্রখানই এখন পর্যন্ত টিকা আছে আদি বাল্মিকীর মানবিক মানুষ হিসাবে। যদিও রাম অবতার পদ পাইবার পর রামের সম্মান বাঁচাইতে গিয়া রামায়ণে আস্ত একটা নতুন কাণ্ড যোগ কইরা সীতারে যেমন সতীত্বের পরীক্ষা পাশ করাইছেন ভক্তকূল তেমনি বহুত অলৌকিক হিজাব-বোরখাও পরাইছেন অবতারের বৌয়ের ইজ্জত ঢাকার লাইগা। মূলত এগারো-বারো শতকের তামিল কবি কম্বনের হাতে রাম পাইছেন অর্ধদেবত্ব আর ১৬ শতকের তুলসিদাসের হাতে পাইছেন পূর্ণ দেবত্ব কিংবা ভগবানত্ব। এর ধারাবাহিকতায় তামিল কবি কম্বন তার রামকথাই আখ্যানে তন্ত্রমন্ত্র জুইড়া দিয়া বুঝাইতে চাইছেন কান্ধে তুইলা নহে; আস্ত কুঁড়েঘরশুদ্ধা সীতারে তুইলা নিয়া গেছে রাবণ; মানে অবতার রামের বৌরে ছুঁইতেও পারে নাই ব্যাটা। আর এর থাইকা আরেকধাপ আগাইয়া ভক্ত তুলসি দাস তার রাম চরিত মানস-এ আবিষ্কার করছেন মায়া সীতার উপাখ্যান; যেই উপাখ্যান অনুয়ায়ী সীতারে নিতেই পারে নাই রাবণ; নিয়া গেছে ভগবানের বৌয়ের ছায়ামূর্তি মাত্র। অথচ বাল্মিকী রামায়ণে সীতারে নিবার সময় রীতিমতো কুস্তাকুস্তি কইরা নিয়া যায় রাবণ...

এই সকল কারিগরিই হইছে ভগবান রামের ঘরের ইজ্জত রক্ষার লাইগা; সীতার লাইগা না। অথচ রাবণের আগে রাম-লক্ষ্মণের সামনেই একবার বিরাধ রাক্ষস সীতারে কোলে তুইলা দৌড় দিছিল। ঘটনাখান ছোট বইলা যেহেতু মানুষ মনে রাখে না; হয়ত সেই কারণেই কম্বন বা তুলসি দাস কেউই বিরাধ রাক্ষসের ছোঁয়া থাইকা ভগবানের বৌয়ের ইজ্জত রক্ষার দরকার মনে করেন নাই। কথাটা সইত্য; যারা ভক্তি ভইরা রামায়ণ নিয়া জীবন পার কইরা দেন তাগোরেও যদি জিগান- কওতো বাপ বিরাধ কিডা? তারা আকাশের দিকে তাকাইয়া কন- বিরাধ নামে আমার পরিচিত যে কেউ নাই। অথচ সীতার প্রথম অপহরণ ঘটনা ঘটে এই বিরাধেরই হাতে...

মূল পুস্তকে লঙ্কা যুদ্ধের শেষে রাম নিজের মুখে সীতারে জানাইয়া দেন- তোমার লাইগা যুদ্ধ করি নাই আমি। আমি যুদ্ধ করছি আমার বাহাদুরি দেখাইতে আর বংশগৌরব রাখতে। কিন্তু এখন তোমারে ঘরে নিলে নিজের বংশের মুখে চুনকালি পড়ব আমার। তাই যেইখানে ইচ্ছা সেইখানে তুমি যাইতে পারো। লক্ষ্মণ- ভরত-শত্রুঘ্ন-সুগ্রীব বা বিভীষণ যারে ইচ্ছা তারে তুমি নতুন স্বামী বইলা গ্রহণ করতে পারো। তোমারে আমার আর প্রয়োজন নাই। ...মানে রামে-রাবণে-বান্দরে কোথাও সীতার কোনো আলাদা অস্তিত্ব নাই। রামে তারে বিয়া করায় সে রামের বৌ হইলেও রাক্ষসের ভাইয়ের বৌ কিংবা বান্দরবধূ হইতেও তার কোনো অসুবিধা নাই। কারণ নারীর জাত তার স্বামীর জাতেই নির্ধারিত হয়; বামুনে বিয়া করলে বামনি; চাষায় করলে কিষাণী আর চাড়ালে করলে চণ্ডালিকা...

সীতারে ভরতের কাছে দান কইরা দিতেও আমার আপত্তি নাই; কথায় কথায় রামের মুখে এই রকম কথা দিয়া রামায়ণে সীতার যে জীবনী শুরু হয় সেইটা গিয়া শেষ হয় সীতারে কুত্তায় চাটা ঘি কইয়া। আদি পুস্তকের পরতে পরতে সীতার এইরকম গঞ্জনা-অপমান গ্রন্থিত করলেও বাল্মিকী অন্তত সীতার আত্মসম্মানরে এক চুল পরিমাণও নীচে নামান নাই। এই কামটা করছেন মূলত অবতারবাদী ভক্তের দল। তিনারা রাবণের ছোঁয়া থাইকা রামের স্ত্রীর ইজ্জত বাঁচাইতে গিয়া রীতিমতো নরক ঢাইলা দিছেন সীতার আত্মমর্যাদার উপর। বাল্মিকী রামায়ণে যোগ হওয়া উত্তরকাণ্ড নামের বেহুদা পুস্তকটায় এইসব ভক্ত লেখকদের মূল কর্মকাণ্ডখান কেন্দ্রীভূত আছিল ইনাইয়া বিনাইয়া রামের রামগিরি রক্ষা। রামেরে ভগবান বানাইবার ক্ষেত্রে ভক্তগণের সব থিকা বড়ো সম্যা আছিল রাবণের ঘরে সীতার দীর্ঘ বসবাস। যেইটারে স্বয়ং রামই সন্দেহ করছেন। পরিষ্কার কইয়া দিছেন- তোমার মতো মাইয়ারে বচ্ছরব্যাপী ঘরে পাইয়াও রাবণ কিছু করে নাই; সেইটা অন্তত আমি বিশ্বাস করতে পারি না...

ভগবান না হয় বিশ্বাস করতে পারেন যে তার স্ত্রী ধর্ষিত হইতে পারেন। কিন্তু ধর্ষিতা নারীর স্বামীরে ভগবান বানানো তো ভক্তের লাইগা কঠিন। তাই ভক্তরা পয়লা রাবণের উপর রম্ভা কাহিনি চাপাইয়া ব্রহ্মার অভিশাপ যোগ কইরা বুঝাইতে চাইলেন যে নিজের জানের ডরেই রাবণ সীতারে ছুঁইতে পারে নাই। তারপর যোগ করলেন অশোকবনে সীতার ব্রতর কথা। কিন্তু অতসবের পরেও যখন স্বয়ং রাম সীতারে কুত্তায় চাটা ঘি কইয়া ফালইয়া দিলেন। তখন ইনারা দায়িত্ব নিলেন সীতারে অগ্নী পরীক্ষায় পাশ করাইয়া রামের ঘরে ফিরাইয়া দিবার মিশনে...

উত্তরকাণ্ডের কারণে অবতারের বৌয়ের হয়ত সতীত্ব প্রমাণ হইছে। কিন্তু শূন্যের কোঠায় নাইমা আসছে সীতার আত্মসম্মান। সতীত্ব ছাড়া নারীর সম্পদ নাই; স্বামী ছাড়া নারীর গতি নাই; এই কনেসেপ্টে বিশ্বাসী সকলেই সীতার মাথা নত করাইয়া তারে নিয়া তুলছেন একটার পর একটা পরীক্ষায়। ব্যক্তি সীতার দিকে কেউই তাকায় নাই একমাত্র বাল্মিকী ছাড়া। রামে রাবণে বান্দরে ব্রাহ্মণে সকলেই যখন সীতারে অপবিত্র কইতে আছেন তখন একটা মাত্র মানুষ হুঙ্কার দিয়া উঠে- সীতা যদি অপবিত্র হয় তবে আমার সমস্ত ঋষিত্বের পূণ্য যেন শূন্য হইয়া যায়...

মানুষটা অনার্য বংশজাত মহাকবি বাল্মিকী। কিন্তু এই অনার্যপুত্ররে ঋষি হিসাবে মাইনা নিলেও তার সমস্ত পূণ্য বাজিতেও ভরসা করতে পারে না কেউ...

কিন্তু এই তথাকথিত বাল্মিকী মূলত কে? ইনি কি ভার্গব বংশজাত স্বয়ং বাল্মিকী চ্যাবন; যিনি নিজের মায়ের কাহিনি দিয়া বানাইছেন সীতার চরিত্রখান?

রামায়ণ রচয়িতা বাল্মিকীরে তথাকথিত না বইলা উপায় নাই। কারণ তিনার সম্পর্কে ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক তথ্য প্রায় নাই। যদিও বাঙাল কৃত্তিবাস বাল্মিকী সম্পর্কে একখান গাঞ্জাগপ্প জুইড়া দিছেন তিনারে দস্যু রত্নাকর বানাইয়া। অবশ্য বাল্মিকীর রত্নাকর নাম ভিল রামায়ণেও আছে। কিন্তু কৃত্তিবাস মূলত নিজাম ডাকাইতের নিজামউদ্দিন আউলিয়া হইবার গল্পটারে ভারতীয় পুরাণের চেহারা দিয়া রত্নাকর দস্যু থাইকা ঋষি বাল্মিকী হইবার কাহিনি ঝাইড়া দিছেন। লগে আবার যোগ কইরা দিছেন যে পাপী রত্নাকর মরা মরা জপতে জপতে উল্টা উচ্চারণে রাম নাম জপ করা শিখছেন। কিন্তু বাংলা ভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষাতেই; বিশেষত সংস্কৃতে ‘মরা’ শব্দ উচ্চারণ করতে করতে মইরা গেলেও সেইটা উল্টাইয়া রাম হইবার কোনো সুযোগ নাই। আর বিন্ধ্য অঞ্চলের বাল্মিকী অন্য যেই জাতের মানুষই হন না কেন; অন্তত রাম নাম কইবার লাইগা যে বাঙাল হইতে আসেন নাই সেইটাতো নিশ্চিত...

কৃত্তিবাসের এই গপ্পরে উড়াইয়া দিতে দিতে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি কন- খাড়াও। রামায়ণ রচয়িতা ছাড়াও কিন্তু আরেকজন বাল্মিকী আছেন। তিনি ভৃগুপুত্র চ্যাবন। ভারতীয় পুরাণ অনুযায়ী চ্যাবনই হইলেন আদি বাল্মিকী। আর অনেকেই কন যে রামায়ণ গ্রন্থের রচনা নাকি শুরু হইছিল সেই আদি বাল্মিকী চ্যাবন মুনির হাতেই। এই যুক্তির লগে তিনি জোড়া দেন অশ্বঘোষের রেফারেন্স। অশ্বঘোষের মতে রামায়ণের বাল্মিকী হইলেন সরাসরি চ্যাবন অথবা চ্যাবনপুত্র অথবা চ্যাবন বংশজাত ভার্গব...

চ্যাবন যে বাল্মিকী আছিলেন; মানে উই পোকার ঢিবি বা বল্মিক আকৃতির মাটির ঘরে বাস করতেন সেই কাহিনি কিন্তু আরো বহুত জায়গায় পাওয়া যায়। আর এই কারণেই সেই চ্যাবন ঋষি নাকি বাল্মিকী নামে পরিচিত আছিলেন। আরেকটা সূত্রমতে আজকের বলখ অঞ্চল; ইংরেজিতে যেইটারে কয় প্রাচীন শহর ব্যাকট্রা; বৈদিক সাহিত্যে সেই জায়গাটারে ডাকা হইত বহ্লীক। এই বহ্লীক জায়গাটা আবার দাবি করা হয় জরথ্রুস্টের জন্মস্থান হিসাবে। এবং বংশগতভাবে জরথ্রুস্ট আছিলেন পশুরজন বা পার্শিয়ানগো মাঝে স্পিতামা গোত্রের মানুষ। অন্যদিকে অথর্ব বেদের ভার্গব সংহিতামতে ভার্গব বামুনেরা; মানে ঋষি ভৃগুর সন্তান শুক্রচার্য আছিলেন স্পিতামাগোত্রের মানুষ। আর চ্যাবন মুনি ভৃগুর বড়ো পোলা; শুক্রাচার্যের ভাই। সেই হিসাবে হইলেও হইতে পারে বলখ-ব্যাকট্রা বা বহ্লীক অঞ্চলের মানুষ বইলা চ্যাবন মুনিরে মানুষ উচ্চারণ ভেদে বাল্মিকী কইয়া ডাকত; যেমনভাবে চ্যাবনের ভাই ঋচিকের নাতি রাম বর্তমানের পেশোয়ার বা বৈদিক পরশুপুরী অঞ্চলের মানুষ আছিলেন দেইখা সকলেই তিনারে পরশুরাম কইয়া চিনে...

নৃসিংহপ্রসাদ ভাঁদুড়ী বামুনবাদী মানুষ। তিনি বাল্মিকীর শৈশব আর যৌবন বনে বাদাড়ে নিম্নবর্গের মানুষগো লগে কাটছে কইয়া বাল্মিকীরে ভার্গব বামুন প্রমাণ কইরা থাইমা যান। কোনোভাবেই তিনি কইতে রাজি না যে বাল্মিকী স্বয়ং এক আদিবাসী বংশজাত বনবাসী মানুষ...

ব্রাহ্মণগো সম্মান সুরক্ষা কইরা নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি যেইখানে থামেন সেইখান থাইকা যদি ভারতের ভিল উপজাতির আখ্যানে যাওয়া যায় তাইলে কিন্তু বাল্মিকী বিষয়ে আরেকটা অধ্যায় পাওয়া যায়। ভিলগো একটা নিজস্ব রামায়ণ আছে। সেই রামায়ণে বাল্মিকীর নাম রত্নাকর ভালিও। সেইটা বড়ো কথা না। বড়ো কথা হইল ভিলরা দাবি করে তারা মহাকবি বাল্মিকীর বংশধর। মানে বাল্মিকী আছিলেন ভিল গোত্রজাত মানুষ...

ভিলগো দাবি অনুযায়ী রামায়ণের আরেক চরিত্র শবরীও ভিল নারী; গণ্ড উপজাতিও দাবি করে তারা শবরীর বংশধর। তবে এতে বেশি কিছু প্রমাণ হয় না। কিন্তু রামায়ণী দক্ষিণ কোশল বা বর্তমান মধ্য প্রদেশ এর ছত্রিশগড়ের যে অঞ্চলে বাল্মিকীর আশ্রম আছিল বইলা দাবি করা হয়; সেই অঞ্চলটারেই ঐতিহাসিকেরা রামের পদচারণা অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত করেন; আর এই এলাকাটাই মূলত ভিল জাতির আদি বাসস্থান বিন্ধ্য পার্বত্য অঞ্চল। আর রমিলা থাপারসহ অনেকেই বলেন যে- রামায়ণের রাম-রাবণের যুদ্ধের মূল কাহিনিটা আসছে বিন্ধ্য পর্বতমালা অঞ্চলের কোনো দুইটা গোষ্ঠির লাড়াইর ইতিহাস থাইকা। লঙ্কাফঙ্কা কিংবা সমুদ্রজয় এইগুলা বহু পরের ক্রিয়টিভ ইনজেকশন। মূলত রামায়ণ রচনার সময় পর্যন্ত আর্যরা সমুদ্র দেখেই নাই; জয় করা তো বহুত দূর...

এইবার এইটার লগে আরো দুয়েকটা আদিবাসী দাবি মিলাইয়া নিলে কিন্তু একটা সমীকরণ খাড়ায়া যায়। রামায়ণ উত্তরাধিকার নিয়া মুণ্ডা উপজাতির দাবি দুইটা। তাগো পয়লা দাবি হইল তারা হনুমানের বংশধর। রামায়ণে হনুমানের যে ল্যাঞ্জা সেইটা বায়োলজিক্যাল ল্যাঞ্জা না বরং ধুতি বা নেংটির বাড়তি খুঁট; কথাটা বেকুব ভক্তের দল ছাড়া সকলেই স্বীকার করেন। আর মুণ্ডাদের দিকে তাকাইলে দেখা যায় ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে এখনো তারা উৎসবে অনুষ্ঠানে সেই ল্যাঞ্জা বাইর করা ধুতিই পরিধান করে...

মুণ্ডাগো দ্বিতীয় দাবি হইল তারা রাবণেরও বংশধর। তার মানে এই দাবি অনুযায়ী রাবণ আর হনুমান মূলত একই গোত্রের মানুষ। এবং রমিলা থাপার বা অতুল সুরের হিসাবমতো সেই বিন্ধ্য অঞ্চলেরই মানুষ। যাদের একদল বনে বাস করত বলে বন-নর বা বানর নামে পরিচিত আর আরেকদল গর্জনশীল ঝর্ণা বা সরব নদী মোহনার কাছে বা কিংবা দ্বীপে থাকত বলে বলে রাবণ...

ভিল উপজাতির মানুষেরা মরা পুরুষরে তোলে চিতায় আর মরা নারী বা শিশুদের দেয় কব্বর। রামায়ণের কাহিনি অনুযায়ী সীতার পাতাল প্রবেশ যতই রঙিন হউক না কেন; সেইটা যে মূলত মাটির নিচে কবরে যাওয়া তা বুঝতে কোনো অসুবিধা হইবার কথা না কারো। তবে কি বাল্মিকী নিজে ভিল আছিলেন বইলা ভিলগো রীতি অনুযায়ীই তার পালিতা কন্যা সীতারে কবর দেন?

একটা কথা মোটামুটি নিশ্চিত যে রামায়ণ কাহিনিটা বাল্মিকী বানাইয়া লিখেন নাই। শোনা ঘটনাই লিখছেন তিনি। কিন্তু কথা হইল কার মুখে তিনি ঘটনাটা শুনছেন? আন্ধা ভক্তিটক্তি না থাকলে রামের কাহিনি তিনি নারদের মুখে শুনছেন এইটা বিশ্বাস করবে না কেউ। আবার সীতার মুখ থাইকা শুইনা লিখলে এর নিশ্চিত কিছু চিহ্নসূত্র থাইকা যাইত কাব্যের পাতায়; সেইটা কিন্তু নাই। সীতা বহুত মুখরা নারী হইলেও দরকারি কথায় কিন্তু সীতা নির্বোধের মতো নিশ্চুপ। তবে বাল্মিকী কোথায় শুনছেন এমন কাহিনি; যেইটারে জোড়া দিয়া তিনি পৌলস্ত্য বধ কাব্যখান বানাইছেন? এমন তো হয় নাই যে পৌলস্ত্য বধ বা রামায়ণের মূল কাহিটা আসলে বাল্মিকীর নিজের মায়ের কিংবা ঠাকুমারই কাহিনি; সীতার মধ্য দিয়া যেইটাতে প্রাণ সঞ্চারিত হইছে বাল্মিকীর কাব্যে ও মেধায়?

ভারতীয় পুরাণে পয়লা যে বিবাহিত নারী অপহরণ এবং অপহরণের পরে স্বামীর ঘরে ফিরা আসার কাহিনি পাওয়া যায় সেইটা স্বয়ং চ্যাবন জননী পুলমার কাহিনি। বৃহস্পতির শিষ্য চন্দ্রের লগে তার স্ত্রী তারার চইলা যাওয়ারে অনেকে অপহরণ কইয়া চালাইতে চাইলেও সেইটা মূলত আছিল প্রেমিকের হাত ধইরা ঘর ছাড়ার ঘটনা; অপহরণ না। নিখাদ অপহরণের পয়লা ঘটনাটা পুলমার। অদ্ভুত বিষয় হইল যেই লোক বা রাক্ষস চ্যাবনের মা বা ভৃগুর স্ত্রী পুলমারে হরণ করছে তার নামও কিন্তু আছিল পুলমা। এই নামের মিল দেইখা মনে হয় পুলমা ব্যক্তির নাম না; গোত্র বা বংশনাম। ভৃগুপত্নী পুলমা আছিলেন অপহরণকারী পুলমার বাগদত্তা। কিন্তু কইন্যা পুলমার বাপ বিখ্যাত পাত্র পাইয়া পুরানা সম্বন্ধ ভাইঙা মাইয়ারে ভৃগুর লগে বিবাহ দিয়া দেন। অপহরণকারী পুলমার লগে চ্যাবন জননী পুলমার সামাজিক বিবাহ সাব্যস্ত হইবার কাহিনি থাইকা অন্তত এইটা অনুমান করা যায় যে তারা একই গোত্রের বা জাতের মানুষ...

পুলমা কাহিনীর লগে সীতা কাহিনির অদ্ভুত অনেকগুলা মিল আছে। পুলমা অপহৃত হইবার পর কিন্তু পুলমার মহাঋষি আর মহাবীর স্বামী ভৃগু; যারে দাবি করা হয় তীর ধনুকের আবিষ্কারক হিসাবে; তিনি কিন্তু কিছুই করেন না প্রায়। তিনি খালি ঘটনার সাক্ষী বা পুলমার পাহারাদার অগ্নির উপর হম্বিতম্বি করেন। রামায়ণে সীতা হরণের সময় অগ্নির মতো ধমকডান্ডা সাক্ষী হইল জটায়ু। অপহরণকারীরে মাইরা পুলমারে উদ্ধার করে তার গর্ভের সন্তান চ্যাবন। পুলমা কতকাল সেই রাক্ষস পুলমার ঘরে ছিলেন তার বর্ণনা নাই; কিন্তু পুলমার সন্তান চ্যাবনের জন্ম হয় ভৃগু পরিবারের বাইরে। ঠিক রামায়ণের লব আর কুশের জন্মের মতো। পুলমা ঘরে ফিরা আসার পর কিন্তু ভৃগু তারে গ্রহণ করেন না; রামায়ণে যেমন সীতারে গ্রহণ করেন না রাম...

অপহরণের পর কিংবা স্বামীর প্রত্যাখ্যানের পর পুলমার দুঃখের বিশদ কোনো বর্ণনা কোথাও না থাকলেও অতি সংক্ষিপ্ত একটা কথায় তার দুঃখের পরিমাণ অনুমান করা যায়। সেই অতি সংক্ষিপ্ত কাহিনি অনুযায়ী দুঃখিনি পুলমার চোখের পানিতে তৈয়ারি হয় বধূসরা নদী। পুরাণমতে স্বয়ং ভৃগুপিতা ব্রহ্মা পুলমারে সম্মানের সহিত স্বামীর ঘরে ফিরাইয়া দিবার লাইগা উকালতি করেন; রামায়ণে সীতারে রামের ঘরে ফিরাইয়া দিবার লাইগা আমরা পিতৃস্থানীয় বাল্মিকীরেও দেখি ব্যর্থ উকালতি করতে। পুলমা কাহিনিতে ব্রহ্মা পুত্রবধূ পুলমার চোখের পানি দেইখাই একখান নদীর নামকরণ করেন বধূসরা; পুরাণ কাহিনিমতে যা তৈরি হইছে স্বয়ং পুলমার চোক্ষের জলে...

তো পুলমাপুত্র চ্যাবন কিংবা চ্যাবনবংশজাত কেউ সেই পুলমার চোখের জলে নদী হইবার কাহিনটারেই সীতা আখ্যানে রূপান্তর করে নাই তো? যেখানে আদি পুলমারে উদ্ধার করছিল তার পুত্র চ্যাবন আর এইখানে আমরা দেখি সীতার কাহিনি বয়ান করতে আছে তার পুত্র লব আর কুশ? পুলমা কাহিনিতে পুলমা স্বামীর কাছে আশ্রয় না পাইলেও প্রশ্রয় পায় পিতৃস্থানীয় ব্রহ্মার কাছে আর সীতা আশ্রয় পায় পিতা বাল্মিকীর কাছে...

আরেকটা কথা। রামায়ণের আদি পুস্তকখানের নাম পৌলস্ত্যবধ কাব্য। পুরাণমতে পুলস্ত মুনির বংশধর বইলা রাবণের নাম পৌলস্ত্য। আর দেখেন চ্যাবনের মায়েরে যে রাক্ষস অপহরণ করে তার নাম পুলমা; চ্যাবনের মায়ের নামও পুলমা। আমি এই বিষয়ে কোথাও কোনো সূত্র পাই নাই; কিন্তু কেন যেন মনে হয় পুলমা-পুলমা কাহিনির লগে পুলস্তের জাতিগত একটা সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। হইলে হইতে পারে নিজের মায়ের অপহরণের প্রতিশোধ নিতে গিয়া চ্যাবনের হাতে যে পুলমা বধ ঘটছিল; কবি হইবার পর সেই ঘটনারেই তিনি কাব্যরূপ দিছেন পৌলস্ত্য বধ নামে; আর সেইটারেই আইজ আমরা রামায়ণ নামে জানি...

২০১৬. ০৯. ০২ শুক্রবার

তথ্যসমর্থন:
কাহিনিসূত্র: প্রচলিত বাল্মিকী-প্রাদেশিক-আঞ্চলিক এবং উপজাতি রামায়ণ আখ্যান। কালীপ্রসন্ন মহাভারত। রাজশেখর বসুর সংক্ষিপ্ত মহাভারত ও রামায়ণ। প্রচলিত বেদ উপনিষদ এবং পুরাণ সংগ্রহ;
যুক্তিসূত্র: রামায়ণের সমাজ- কেদারনাথ মজুমদার। ভারতবর্ষের ইতিহাস-রোমিলা থাপার। বাল্মিকীর রাম ও রামায়ণ-নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী। বাল্মিকী রামায়ণে রাম আদিবাসী রামায়ণে রাম- বিপ্লব মাজি। ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, মহাভারত ও সিন্ধু সভ্যতা, ভারতের বিবাহের ইতিহাস- অতুল সুর। প্রবন্ধ সংগ্রহ- সুকুমারী ভট্টাচার্য। ধর্মের উৎস সন্ধানে- ভবানীপ্রসাদ সাহু। কৃষ্ণ চরিত্র, শ্রীমদভগবদগীতা- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। মহাভারতের কথা- বুদ্ধদেব বসু। মহাভারতের মূল কাহিনি ও বিবিধ প্রসঙ্গ- শিশির কুমার সেন। ধর্ম ও প্রগতি- জয়ন্তানুজ বন্দোপাধ্যায়
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ২:৩৪
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×