somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আধুলি

০৯ ই মে, ২০১৪ রাত ১২:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আধুলি/ মনসুর আজিজ


রাফি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি পশ্চিম পাড়ে। পশ্চিম পাড়ে বললে ভুল হবে। পশ্চিম দিকে। লঞ্চটাকে এখনো দেখা যাচ্ছে না। বারোটায় পৌঁছার কথা। এখন দু’টো প্রায়। আড়তের চৌকিতে জোহরের নামাজ শেষ হয়েছে বিশ মিনিট হবে। বহু দূরে কয়েকটি নৌকা দেখা যায়। ছায়ার মতো। কখনো ঢেউয়ের ভেতর ঢুকে যায়। আবার জেগে ওঠে। আহা! লঞ্চটা যদি শুধু ভেসে থাকতো। রাফি তার শার্টের হাতাটা গুটিয়ে কনুইয়ের উপরে রাখলো। বা হাতটাকে কপালের উপর ধরে লঞ্চটাকে দেখার চেষ্টা করছে। না, দেখা নেই। সূর্যের তাপ যেন কপালটাকে পুড়িয়ে ছাড়বে। রাফির কপাল পুড়িয়ে সূর্যের লাভটা কিÑ সে ভেবে পায় না। ওর কপাল তো এমনিতেই পোড়া। না হলে কেনো ঘরছাড়া হবে। কেনো বাড়িঘর নদীতে ভেঙে যাবে। আজ আর লজিং বাড়ি থেকে অবহেলার স্বীকার হবে? পোড়া কপাল নাকি জোড়া লাগে না। তবে ও ভেবে পায় না এখনো ওর কপাল জোড়া লেগে আছে কি করে। রাফি চোখ দু’টো ঘুরিয়ে উত্তর দিকে তাকালো। আস্ত একটা সুপারি বাগান হেঁটে চলে যাচ্ছে দেিণ। শুধু সবুজ পাতাগুলো দেখা যায়। পাতাগুলোকে এক দুরন্ত কিশোরের এলোমেলো চুলের মতোই লাগছে তার কাছে। রাফি তার চুলে আঙুল চালালো। চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ঐ সুপারি বাগানের সাথে মেঘনায় ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে ওর। দখিন হাওয়ায় সুপারি গাছের পাতাগুলো দুলছে। ফুটবল খেলার সময় খোকন ভাইয়ের চুলগুলো যেভাবে ওড়েÑ সেরকম। নীলকমল লঞ্চঘাটটি পার হয়ে সবাইকে অভিবাদন জানাতে জানাতে সুপারি বাগানটি চলে যাচ্ছে ভাটি অঞ্চলে। আহা! গাছগুলো ঘূর্ণিতে পড়ে গেলো! লাটিম ঘুরানোর মতো ঘূর্ণিপাকে ঘুরতে লাগলো গাছগুলো।
রমজান মাসে মা ইছবগুলের ভূষি আর তোকমার দানা ভিজিয়ে কাসার বাটিতে নাড়লে যেরকম ঘুরতো দানাগুলোÑ সুপারি পাতাগুলো এখন সেরকম করে ঘুরছে। আর নেই। সুপারি গাছগুলোর অস্তিত্ব আর নেই। রাফির নজর সুপারি গাছগুলোর মিলিয়ে যাওয়া জায়গাটায়। ঘূর্ণির হা করা মুখটার দিকে। কয়েকটি জেনৌকা ঘূর্ণিটাকে প্রাণপনে এড়িয়ে গুন টেনে সামনে আসতে চাইছে। চারজন তাগড়া জেলে গুন টেনে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে কিন্তু নৌকাটাকে একহাতও আগাতে পারছে না। আরেকটা কাছিছেঁড়া নৌকা স্রোতের তোড়ে ভেসে চলেছে ভাটিতে। ভাগ্য ভালো যে ঘূর্ণিটার কাছে দড়ি ছিঁড়ে যায়নি। তাহলে আর রা ছিলো না। জলকবর হতো নির্ঘাৎ।
রাফির নজর আর পশ্চিমে নেই। দেিণ। কুমারের কলসি বানানোর মতো ঘূর্ণিটার দিকে তার নজর। শিয়াল মুরগির হাড়-গোড় চিবিয়ে খাওয়ার পর যেভাবে হাত পা লেহন করেÑ ঘূর্ণিটার অবস্থা এখন সেরকম।
রাফিকে কে যেন আচমকা একটান দিয়ে পিছনে নিয়ে গেলো তিন হাত। ফিরে তাকানোরও সুযোগ পেলো না রাফি। একটা ধ্রিম শব্দ আর পানির ঝাপটায় শরীরের অর্ধেক ভিজে গেলো। মুখটা মুছে কি ঘটছে দেখার জন্য সামনে তাকালো। ও যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সে জায়গাটা এখন আর নেই। ঘোলাপানিকে আরো ঘোলা করে মিলিয়ে গেলো মেঘনায়। গাজির হোটেলটাও তাড়াতাড়ি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। আর একটা চাকা ভেঙে পড়লেই তার হোটেলটা ছেলেদের পল্টি খাওয়ার মতো গড়িয়ে পড়বে নদীতে।
যে লোকটি রাফিকে পিছনে টান দিয়েছিলো তার মুখের দিকে শুকনো মুখটা তুলে চাইলো।
‘কি ভাবছিলা দইন্যাডার উপর খাড়ায়া? তোমার মুকটা এমন হুগনা ক্যা?’
রাফি কোনো উত্তর দিলো না। একটা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টির বন্ধন মিনিট খানেক রেখে গিটখোলা দড়ির মতো ছেড়ে দিলো পায়ের কাছে।
মোঘল চপ্পলের নীল ফিতাটায় ধুলির আস্তরণ। রাস্তার পাশে ভাটফুলের চ্যাপ্টা পাতাগুলোতে যেরকম ধুলা জমে, সেরকম। ফিতাটার উপর ‘মোঘল চপ্পল’ লেখাটি মোঘল শাসনের মতোই অন্তর্লীন হয়েছে। প্রতœকর্মীরা যদি কখনো আদরের হাত লাগায় তবে আবার লেখাটি স্পষ্ট হবে। পুরনো পাউরুটিতে ছত্রাক যেমন লেপ্টে থাকে পা দু’খানিতেও ধুলি জমেছে সেরূপ।
‘মুখটা এমন হুগনা ক্যা?’ কথাটি শোনার সাথে সাথে রাফির বা হাতটি চলে গেলো প্যান্টের পকেটে। আধুলিটির অস্তিত্ব অমরত্বের স্বাদ পাওয়ার অপো করছে এখনো। রাফি দু’দিনে বুঝেছে এটির কানাকড়িও মূল্য নেই কোনো দোকানির কাছে। মুকুটপুরী লঞ্চটিকে এখনো দেখা যাচ্ছে না। রাফি শুকনো ঠোঁট দু’টি জিহ্বা দিয়ে ভিজাবার চেষ্টা করছে। আশ্বিনের এই তপ্ত রোদে তা আর ভিজতেও পারছে না। গাজির হোটেলের পানি পেটে পড়েছে দু’ঘন্টা আগে। পানি আর কতো! দু’দিন তো চললো। রহমানের মুখটা মনে পড়ায় ‘থু’ বলে থু থু ছিটালো রাফি। কিন্তু তার মুখ থেকে থু থুও আসছে না। গতোকালের নাস্তার সময় কি অপমানই না করলো রহমান। তাও আবার তার মা-বোনদের সামনে। তার ছাত্রীদের সামনে। ওর আট দশ বছরের বোনদের হাসি আর গড়াগড়ির কথা মনে পড়লে মাটির চাকাটির মতো মেঘনায় মিশে যেতে ইচ্ছে করে তার। নাস্তাপর্ব শেষ করে অপমানটা করলেও পারতো। অর্ধেক রুটিও খাওয়া হয়নি তার। ‘আজাইরা ঘোরস আর খাস; কান্দুনি, বুড়ি অংকে ফেল করে কেমনে? সপ্তায় তো একদিনও পড়াস না। চউরা আর জাউরা Ñ এক সমান’। রাফি আর এক মুহূর্তও স্থির থাকতে পারেনি। নাস্তার প্লেটটি চাকতি নিেেপর মতো ছুঁড়ে মারলো। টিনের বেড়ার সাথে বাড়ি খেয়ে ঝনঝন শব্দ করে স্থির হলো মেঝেতে। যেভাবে নাস্তার টেবিলে বসেছিলো, সেভাবেই বের হয়ে পড়েছে রাস্তায়। মসজিদের বাঁধানো ঘাটলাটায় বসেছিলো দুপুরের আজান পর্যন্ত। একবার ভাবছিলো পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহূতি দেয়। কিন্তু এই ছোট্টো পুকুরে ঝাঁপ দেয়া আর না দেয়া সমান। ‘আমি কি অভাবে পড়ে তোদের বাড়ি আছি। নদীতে বাড়ি ভেঙেছে বলে তোদের বাড়িতে লজিং মাস্টার। আমাদের বাড়িতে থেকে কতোজন লেখাপড়া করে গেলো। কই আমার বাবা মা কিংবা বড়ো ভাইয়ারা তো কখনো কারো সাথে দুর্ব্যবহার করেনি। তারাতো আমাদের পরিবারের সদস্যের মতোই ছিলো। এসএসসির পরই তো চলে যাবো ঢাকা। ছোট ফুফুর বাড়িতে। হেডস্যারকে আব্বাও অনেক বলেছেন একটা হোস্টেল চালু করতে, তাহলে এই অপমান সইতে হতো না।’ নিজের মনেই আেেপর কথা বলে রাফি।
গতোকালও রাফির পকেট ভরা টাকা ছিলো। সেকেন্ড টার্ম পরীা শেষ হয়েছে বলে সবাই মজা করে গেলো সিনেমা দেখতে। রহমানের সিনেমার টিকেট পর্যন্ত করে দিয়েছে সে। রেস্টুরেন্টের বিল দিয়ে পকেটে ছিলো পাঁচ টাকা। আধা দিস্তা কাগজ কিনে পঞ্চাশ পয়সার একটা আধুলি পকেটে পুরে বাড়ি ফিরলো দু’জন। কাল ওবায়েদ আসবে। আব্বা ওর কাছে টাকা পাঠাবেন। কালই কাল হলো।
মসজিদের ঘাটলা থেকে লঞ্চঘাটে ছিলো বিকেল পর্যন্ত। লঞ্চ আসেনি। তিন নম্বর বিপদ সংকেত। আজ আর লঞ্চ আসবে না। কাল আসবে। শরীর আর চলে না রাফির। এখানে ওখানে ঘুরে রাত দশটায় হাজির হলো জহিরের লজিং বাড়িতে। জহিরের বাবা তিন নং ওয়ার্ডের মেম্বার। বাড়ি ভাঙার কারণে সেও লজিং থাকে মিজিবাড়িতে। জহির হারিকেনটা ডিম করে মশারির ভেতর ঢুকতে যাবে, এমন সময় দরজায় টোকা দিলো রাফি।
‘কিরে এতো রাতে! আয় ভিতরে আয়।’
রাফি তার মলিন মুখটি আর জহিরকে দেখাতে চাইলো না। সোজা ঢুকে গেলো মশারির ভিতর। জহির রাফিকে বোঝে। তাই কোনোকিছু আর জিজ্ঞেস করলো না ওকে। রাফির চোখ দু’টি ঝিনুকের মতো বন্ধ। ডান চোখের ভিতরের মণিটি এখন আধুলির মতোই উজ্জ্বল মনে হচ্ছে তার কাছে। কিন্তু বা'চোখের মণিটাকে মনে হচ্ছে ঘরের পিছনে ছাইয়ের পাগাড়ে পড়ে থাকা একটা কালো মার্বেলের মতো। জহির ঘুমিয়ে পড়েছে। রাফির চোখে ঘুম নেই। পকেট থেকে আধুলিটা বের করলো। হারিকেনের মৃদু আলোয় আধুলিটা মেলে ধরলো চোখের সামনে। একটা সার্কেলের ভিতর কতো সুন্দর করে লেখা বাংলাদেশ, ১৯৮০, কথায় ও সংখ্যায় ৫০ পয়সা। আরেকটি বৃত্তের ভিতর মাছ, মোরগ, আনারস, কলা!
কানছেদা বাবুলের ফাঁকা দাঁতের বাঁকা হাসিটির কথা মনে পড়লো রাফির। আটআনার মুড়ি অয়? এক টাকা দে! রাগে আধুলিটি পকেটে পুরে কানছেদা বাবুলের দোকান থেকে আবার বের হয়েছে রাস্তায়। গাজির দোকানে একটি বাবুল বিস্কুট চেয়েছিলো বিকালে। তারও একই উত্তর।
‘কোন শালা ডিজাইন করেছে এই আধুলির? ফুটানির আর সীমা নাই। শায়েস্তা খানের আমল পাইছে। পঞ্চাশ পয়সায় জামাই আদরে মাছ মুরগী আর ফলমূল খাওয়াবে।’ মনের ভিতর জমে থাকা ােভটা মনের ভিতরই আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত করলো। পেটের ভিতর ুধায় রগগুলো লাফাতে লাগলো। মেঘনার ঘূর্ণিটার মতোই অবস্থা তার পেটটার।
জহির নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। রাফির চোখে ঘুম নেই। কাল দুপুর পর্যন্ত অপো করতে হবে। রাফির অপর চোখটা মার্বেলের মতোই শক্ত হলো। পেটের ভিতর হাত বুলিয়ে মনে করলো ওর কোনো ুধা নেই। অবচেতনে প্যান্টের বা পকেটে হাতটা চলে গেলো। রেখে দিলো আধুলিটি। কতোণ পর আবার বের করে আধুলির অপর পিঠটি মেলে ধরলো চোখের সামনে। মৃদু ঢেউয়ের উপর ছয়টি পাপড়ির শাপলাটাকেই বাস্তব বলে মনে হলো ওর কাছে। বিলের ধারে, পুকুরে অবহেলায় অযতনে ফুটে থাকা জাতীয় ফুল শাপলার যেমন কোনো মূল্য নেই; আধুলিটিরও তেমনই। একটি সরল ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে রাফি তার কান্ত, অনাহারকিষ্ট দেহটি ছেড়ে দিলো ঘুমের দেশে।

ফজরের আজানের পর বিড়ালের মতো পা ফেলে রাফি শব্দহীন ছিটকানিটা খুলে বের হয়ে আসলো জহিরের লজিং বাড়ি থেকে। সকালের মৃদু বাতাসে তার ুধা কিছুটা দূর হয়ে গেলো। শরীরে ব্যথা আর কান্তিটা রাতের মতো নেই। কিছুটা ঝরঝরে। আজকের আকাশটা কালকের চেয়ে পরিচ্ছন্ন। পুবদিকটা গতোকালের চাইতে অনেকটা উজ্জ্বল। তালুকদারের মসজিদের টিউবওয়েল থেকে পেট ভরে পানি খেলো রাফি। তারপর লঞ্চঘাটে গেলো আবার। ঢাকার লঞ্চের যাত্রীদের নিয়ে মনের সুখে রিক্সা ছুটছে আলগী বাজার, ভৈরবী আর হায়দারগঞ্জের দিকে। দু’পয়সা বকশিসের লোভে জোরে জোরে প্যাডেল মারছে রিক্সাওয়ালারা। কুলিরা মালামাল নামিয়ে কোচড় ভর্তি পয়সা নিয়ে গাজির দোকানে পারাটা ভাজি দিয়ে নাস্তা করছে। ওদিকে তাকিয়ে রাফির পেটের ুধা আবার চাউর দিয়ে উঠলো। গাজি চুলায় পাম্প করতে গিয়ে চাইলো রাফির দিকে। ‘কি ও সরদারের পো পরোডা খাইবা নি, আহ! বহো।’
রাফি লজ্জায় মাথা নাড়িয়ে চলে আসলো দণি দিকটায়। ছি! ছি! আমি ভিুকের মতো ওভাবে তাকাতে গেলাম কেনো! নিজেকে নিজে ধিক্কার দিতে লাগলো রাফি।

বেলা বাড়ছে। লঞ্চ আসতে এখনো দু’ঘন্টা বাকি। মজিবল নানার বাড়িতে যাওয়া যেতে পারে। নানির হাতে নাস্তা খেয়ে আসতে পারবে হয়তো। নানি দুপুরের রান্নায় ব্যস্ত। তার পাঁচ ছয়টি ছেলে মেয়ের খাবারের আয়োজনে সারাদিনই তাকে রান্নায় ব্যস্ত থাকতে হয়। মজিবল নানা থাকেন বরিশালে। মাসে আসেন একবার। রাফির নানার মামাতো ভাই। একসময় রাফির নানাবাড়িতে থেকেই মানুষ হয়েছে।
‘কি রে ভাই। কখন এলি। আয় এদিকে আয়। মোড়াটা টান দিয়া বস। রহমানদের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া দেয় ঠিক মতোন?’
রাফি কোনোমতে হা না এর মাঝামাঝি একটা উত্তর দিলো।
‘সকালে নাস্তা করছো? রাফি কোনোমতে মাথাটা নাড়ালো। তার উত্তর না-ও না, হা- ও না। তবে হা এর দিকেই ঝোঁক বেশি। একবারও বলতে পারেনি নানি আমি কাল থেকে না খাওয়া। আমি তোমার কাছে খাওয়ার জন্যেই এসেছি। নাস্তার প্রসঙ্গটি ঢাকনা দিয়ে এবার লেখাপড়ার ডেকচিটি নাড়া দিলেন নানি। পড়া শোনা সংক্রান্ত নাতিদীর্ঘ বক্তব্য আর লাউয়ের ডগা থেকে আঁশ ছাড়ানোÑ দু’টোই একসাথে করছেন তিনি। এর ফাঁকে চুলায় লাকড়ি গুঁজে দেয়া, ভাতের হাঁড়িতে চামচ নাড়ানোÑ মোট কথা দুর্গাদেবীর দশ হাতের কাজ করছেন দু’হাতে। ভালো করে রাফির মুখের দিকে একবারও তাকাননি।
রাফি মা’কে ছাড়া আর কারো কাছে আজ পর্যন্ত খাবার চায়নি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো বারোটা বাজতে আর বেশি বাকি নেই। নানির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার ছুটলো লঞ্চঘাটে। আধুলিটা পকেট থেকে বের করে দেখছে আর হাঁটছে। পথের টঙ দোকানির বুড়ো বয়সের ছোট ছেলে রানা। রাফি ওকে দেখে আনন্দিত হলো। আধুলিটি ওর হাতে দিয়ে বললোÑ কিছু দে তো। ছেলেটি আধুলিটা হাতে নিয়ে অবাক বিস্ময়ে রাফির দিকে তাকিয়ে হি হি করে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললোÑ আট আনার আধুলি! এ্যা দিয়া কিচ্ছুই পাইবেন না।’ রাফির ইচ্ছে করছিলো ওর গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়। অতি কষ্টে রাগ সংবরণ করে উল্কাগতিতে ছুটলো লঞ্চঘাটের দিকে।

ওই যে লঞ্চ! ওই যে লঞ্চ! চিৎকার আর হাততালিতে লঞ্চঘাটটা সরব হয়ে উঠলো। রাফি কল্পনাপুর থেকে ফিরে এলো লঞ্চঘাটে। দু’দিনের রোজনামচায় আড়তের ভাঙা চকিটা থেকে উঠে দাঁড়ালো। উৎসুক মানুষের সাথে সেও ল করার চেষ্টা করছে লঞ্চটার অবস্থান। হা, বহুদূরে আবছা একটা কিছু দেখা যায়। একটা আস্থার দুলুুনি রাফির মনে। স্রোতের কারণে উত্তর-পূর্ব কৌণিক বেগে এগিয়ে আসছে লঞ্চটি। লঞ্চের অস্তিত্বের চাইতে ওবায়েদের অস্তিত্বটিই এখন ওর কাছে বড়ো। ওবায়েদ এক ইয়ার সিনিয়র বন্ধু। তবে বয়সে সিনিয়র আরো বেশি। ড্রপ দিয়েছে দুবার। পার্টি করে। সিগারেট খায়। তবে দিলখোলা মানুষ। রাফি পড়–য়া ছেলে। কাসের ফার্স্ট বয়। তবে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া, ভাটার সময় নদীর তটে বালিতে হাঁটা আর সিনেমা দেখা তার শখ। তবে গল্প-কবিতার বই পেলে সব বাদ। নিমজ্জিত লঞ্চের মতো ডুবে থাকে বইয়ে। হামজা ও রুস্তমের মতো কোনো উদ্ধারকারী বন্ধু এলে কদাচিৎ তাকে তুলতে পারে বইয়ের নদী থেকে।
লঞ্চটা এবার আরো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। স্রোতের কারণে ক্রমেই দেিণ চলে যাচ্ছে লঞ্চটি। প্রচন্ড ঢেউ আর বাতাসে এদিক ওদিক দুলছে। একবার মনে হয় ডুবে গেলো। আবার ভেসে ওঠে লঞ্চটা। পানির ঝাপটা দোতলা পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। নিচতলা পুরোটা ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। ওবায়েদকে দেখা যাচ্ছে! বহু প্রতীতি ওবায়েদ! দোতলার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। লঞ্চটির অবস্থান ঘাট থেকে বেশ দেিণ। পাড়ের মানুষ গামছা দিয়ে ঘূর্ণিটাকে এড়িয়ে আসার জন্য সারেঙের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করছে। সারেঙ এদের ভাষা বুঝতে পারে। যথাসম্ভব ঘূর্ণিটাকে এড়িয়ে মৃদু গতিতে এগিয়ে আসছে স্টেশনের দিকে। স্রোতের কারণে এগুতে পারছে না খুব একটা। এবার স্পিড আরেক দফা বাড়িয়ে দিলো। কালো ধোঁয়া মেঘের মতো বের হচ্ছে চিমনি দিয়ে। কিন্তু গতি আগের চেয়ে সামান্য একটু বাড়লো। রাফি হাত ইশারায় ওবায়েদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। ওবায়েদ এবার রাফিকে দেখতে পেয়েছে। সেও হাত নাড়লো। অল্প সময়ের মধ্যে লঞ্চটি এসে ঘাটে ভিড়লো। ওবায়েদ সিঁড়ি বেয়ে পাড়ে নেমে এলো। সার্ট-প্যান্ট ভিজে একাকার। চুলও আংশিক ভিজা। সফরের ভয় আর কান্তি রাফির মুখের দিকে তাকিয়ে উবে গেলো। দুর্ভি কবলিত কিশোরের মতোই লাগছে রাফিকে।
‘কিরে! তোর এ অবস্থা এমন কেনো!’ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-ভালোবাসায় ভরা ওবায়েদের কণ্ঠটি।
‘তোর অবস্থা তো শালিক ভেজা।’ রাফি জোর করে কিছুটা হাসার চেষ্টা করলো।
ওবায়েদ ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একটা রিক্সা ডেকে উঠে পড়লো।
ওবায়েদ জানে রাফির কাছে টাকা নেই। ও কারো কাছে মরে গেলেও কিচ্ছু চাইবে না।
‘রহমানের সাথে কোনো সমস্যা হয়েছে?’
‘সে কথা পরে বলা যাবে।’

হাজির হোটেলে ঢুকে খাবারের অর্ডার দিলো ওবায়েদ। রাফির আর তর সইছে না। ভাতের বোলটা সামনে আসার সাথে সাথেই ওটাতে হামলে পড়লো সে। তার পাকস্থলি এখন মেঘনার ঘূর্ণিটার মতোই উত্তাল। ওবায়েদ বেসিনের গ্লাসে তা ল করে মুচকি হাসলো। ওরা দু’জন ছাড়া শেষ দুপুরে দোকানে কোনো কাস্টমার নেই। দুর্গত মানুষ ত্রাণের উপর যেভাবে হামলে পড়ে রাফি ঠিক সেভাবে হামলে পড়ছে খাবারের উপর। ওবায়েদ বুঝতে পেরেছে হয়তো সারাদিন কিছুই খায়নি রাফি। ইলিশের বড়ো দু’টি পিস ওবায়েদ তুলে দিলো রাফির পাতে। দু’প্লেট খেয়ে এবার তাকালো ওবায়েদ এর দিকে। ওবায়েদ সবজি ডাল ভর্তা দিয়েই খাচ্ছে। লঞ্চের ঢেউয়ে মাথা ঝিমুনির কারণে ুধা থাকার পরও তার খেতে তেমন একটা ইচ্ছে হচ্ছে না। গরুর গোস্তের বাকি অংশটাও ওবায়েদ ঢেলে দিলো রাফির প্লেটে। সুপারি বাগানটি গিলে খাওয়ার পর ঘূর্ণিটা যেরকম একটু শান্ত হয়েছিলো রাফির অবস্থা এখন সেরকম।
‘আর কিছু নিবি?’
রাফি হোটেল বয়টার দিকে তাকালো।
‘মুরগী আন একটা।’
ওবায়েদ জানে রাফি মুরগী খুব একটা পছন্দ করে না। তারপরও অর্ডার দিলো। মুরগীর মাংসটা পরম তৃপ্তিতে কুটুর কুটুর করে খাচ্ছে রাফি।
ওবায়েদ ততোণে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। রাফি বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে মনে পড়লো হাত না ধুয়েই সে খেতে বসেছে। নিজে নিজেই লজ্জা পেলো। এটাকেই কি বলে ুধা!
‘নে, চা নে। এবার বল কি হইছে।’ স্বভাবসুলভ জানতে চায় ওবায়েদ।
রাফি বললো
‘আমার খাওয়া শেষ হয়নি। এই দিকে আয়।’ রেস্টুরেন্টের ছেলেটাকে ডেকে বললো
‘একটা কলা দে।’
‘কলা খাবি?’ ওবায়েদের বিস্ময় ভরা জানতে চাওয়া।
রাফি শুধু মাথা নাড়লো।
হোটেলের ছেলেটি বললো
‘কলা নাই।’
রাফি বললো
‘অন্য দোকান থেকে আন।’
কলা খাওয়া শেষ হলে ওবায়েদ বললো
‘তোর চা ঠান্ডা হইয়া যাচ্ছে।’
‘আমার খাওয়া এখনও শেষ হয় নাই।’
‘আর কি খাবি? মিষ্টি? এই দুইটা রসগোল্লা দে তো।’
‘না না, মিষ্টি লাগবে না, একটা আনারস নিয়া আয়।’
‘আনারস!’
ওবায়েদ রাফির কথা শুনে হো হো করে হাসতে লাগলো। হাসছে হোটেলের ছেলেটিও।
‘আনারস খাবি! এখন?’
রাফি পকেট থেকে আধুলিটি বের করলো। দু’আঙুলে আধুলিটি ধরে তুলে ধরলো ওবায়েদের চোখের সামনে। ওর চোখ থেকে অশ্রুর ফোঁটা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে চিবুকে। গতো দু’দিনের অব্যক্ত কথাগুলো অশ্রুর প্রতিটি ফোঁটার ভিতর চিকচিক করে ভাসতে লাগলো।
ওবায়েদের চোখ ফিরে এলো আধুলিটিতে। একপাশে মাছ একপাশে কলা, মোরগের পিঠের উপর আনারসটির উপর স্থির হলো দৃষ্টি। আনারসের ঝাঁঝরা বুক আর কাঁটা কাঁটা পাতাগুলো থেকে দৃষ্টি সরালো রাফির দিকে। কপর্দকহীন রাফির অভিমানি হৃদয়টি আনারসের বুকের মতোই ঝাঁঝরা হয়ে গেছে দু’দিনে। অশ্রুর ফোঁটাগুলো অগুনতি আধুলি হয়ে বৃষ্টির ফোঁটার মতো বয়ে চলেছে প্রবাহমান নদীর দিকে। কান্নার সাথে রাফির ছোট্ট শরীরের দুলুনি লঞ্চের দুলুনির চাইতেও ভয়াবহ মনে হলো ওবায়েদের কাছে। চিরচেনা বন্ধুর কষ্ট আধুলির পৃষ্ঠার মতো উন্মোচিত হলো তার কাছে।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আব্বাসীয় কুরাইশ বেশি যোগ্য

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৫




সূরাঃ ২ বাকারা, ১২৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
১২৪। আর যখন তোমার প্রতিপালক ইব্রাহীমকে কয়েকটি বাক্য (কালিমাত) দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন, পরে সে তা পূর্ণ করেছিল; তিনি বললেন নিশ্চয়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলমানদের বিভিন্ন রকম ফতোয়া দিতেছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩


আপন খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুফাতো বোনের বা ছেলের, মেয়েকে বিবাহ করা যায়, এ সম্পর্কে আমি জানতে ইউটিউবে সার্চ দিলাম, দেখলাম শায়খ আব্দুল্লাহ, তারপর এই মামুনুল হক ( জেল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জুমার নামাজে এক অভূতপূর্ব ঘটনা

লিখেছেন সাব্বির আহমেদ সাকিল, ১০ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০



মসজিদের ভেতর জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বাহিরে বিছিয়ে দেয়া চটে বসে আছি । রোদের প্রখরতা বেশ কড়া । গা ঘেমে ভিজে ওঠার অবস্থা । মুয়াজ্জিন ইকামাত দিলেন, নামাজ শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। হরিন কিনবেন ??

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৯



শখ করে বন্য প্রাণী পুষতে পছন্দ করেন অনেকেই। সেসকল পশু-পাখি প্রেমী সৌখিন মানুষদের শখ পূরণে বিশেষ আরো এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এবার মাত্র ৫০ হাজার টাকাতেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধখানা ভ্রমন গল্প!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৩৯


২০০২ সাল বান্দারবানের রিগ্রিখ্যাং-এর এই রিসোর্ট আজ সকালেই আমরা আবিস্কার করলাম! পাহাড়ের এত উপরে এই মোড়টাতে একেবারে প্রকৃতির মাঝে এমন একটা রিসোর্ট থাকতে পারে তা আমরা সপ্নেও কল্পনা করিনি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×