somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

The Pianist - একটি কালজয়ী চলচ্চিত্র (যারা অলরেডি মুভিটি দেখেছেন তাদের এই পোস্ট না পড়লেও চলবে)

২৫ শে মে, ২০০৯ বিকাল ৪:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিভিন্ন ধরণের চলচ্চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা আমার বেশি দিনের নয়। অন্তত: ইংরেজি ভাষায় তো নয়ই। হিন্দি ও বাংলা মুভিই বেশি দেখা হয়েছে বরাবর। একটা সময় ছিলো যখন কোলকাতার ডিডি ৭ চ্যানেল প্রতিদিন রাত ১০টায় একটা করে পুরনো দিনের ভালো বাংলা ছবি দেখাতো। উত্তম-সুচিত্রা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুপ্রিয়া দেবী, অনিল চ্যাটার্জি, বিকাশ রায়, পাহাড়ী সান্যাল, গীতা দে, সন্ধ্যা রায়ের মত অসাধারণ সব অভিনেতা আর তাঁদের সেইসব অনবদ্য অভিনয় আর মুভি... আহ... সে কি ভোলা যায়? দেশেও তেমনি- জীবন থেকে নেয়া, মুক্তির গান, শন্খনীল কারাগার, এবং এরকমই আরো অনেক মুভি রয়ে গেছে পছন্দের তালিকায়।

তারপর ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, শুধুমাত্র একটা এলাকার মুভি দেখা কোনো কাজের কথা নয়, দেখার মত করে দেখতে হলে সব দেশীয় মুভিই দেখতে হবে, হলিউডি মুভিও তার মধ্যে একটা। তারই ধারাবাহিকতায় দেখলাম মুভি The Pianist. সত্যি করে বলি, প্রথমবার দেখে খুব ভালো লেগেছিলো কিন্তু ভেবেছিলাম, একবার দেখেছি এই যথেষ্ট, এত কষ্টের মুভি ২য়বার আর দেখবো না।

বড় ক্লান্ত ছিলাম সেদিন। অফিস সেরে, ক্লাস করে, ৬ নম্বর বাসের ধাক্কা খেয়ে বাসায় ফিরে কোনো রকমে স্নান করে খেয়ে আমার তখন মরার মত অবস্থা। মনটাও ভালো ছিলো না। শ্রান্ত অবসন্ন দেহে যখন মুভি ছেড়ে দিয়ে বসলাম তখন নড়াচড়া করার মত শক্তিও নেই আর।

তারপর শুরু হলো মুভি। প্রথমত: এটা ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এবং দ্বিতীয়ত: সত্যঘটনা অবলম্বনে তৈরী। এ ধরণের মুভি দেখতে কিছুটা হলেও মানসিক শক্তি প্রয়োজন। প্রথম ৪০-৪৫ মিনিট দেখে মন খুবই খারাপ হয়ে গেলো। পোল্যান্ড নিবাসী স্পিলম্যান, একজন মেধাবী কিন্তু নিরীহ পিয়ানোবাদক, তার বাবা-মা আর তারা ৪টি ভাইবোন ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় যখন জার্মান নাজি বাহিনী পোল্যান্ড আক্রমণ করে, কারণ একে তো তারা পোলিশ, এবং তারচেয়েও বড় কথা তারা ইহুদী। হাতে নীলরঙা তারা চিহ্নিত এমব্লেম পরে (এভাবে ইহুদীদের কে সনাক্ত করা হতো) শুরু হলো তাদের অনিশ্চিত জীবন। অশেষ বঞ্চনা ও নির্যাতনের এক পর্যায়ে এসে স্পিলম্যান তার মা-বাবা-ভাইবোনের কাছ থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ে কারণ একজন ইহুদী পুলিশ অফিসার তাকে বাঁচিয়ে দেয়, আর বাকি সবাইকে নাজিরা হত্যা করার জন্য এক্সটার্মিনেশন ক্যাম্পে নিয়ে যায়।

বিছিন্ন হয়ে কিছুদিন তাকে কাজ করতে হলো জার্মান ঘেটো ক্যাম্পে। সেখানে অমানুষিক পরিশ্রম আছে, খাবার আছে এবং সেই একই নির্যাতন ও নিপীড়ন, বিনা অপরাধে কুকুরের মত গুলি করে হত্যা। পালিয়ে গিয়ে পুরনো পরিচিতদের কাছে সে আশ্রয় নিলো, তারাও যথাসাধ্য চেষ্টা করলো তাকে থাকার জায়গা দেবার। সেসব জায়গায় কেউ এসে তাকে খাবার দিয়ে যেতো, নইলে না খেয়ে থাকতে হতো। একবার সে ধরা পড়ে গেলো এক প্রতিবেশী জার্মান মহিলার হাতে, তারপর কোনোমতে পালিয়ে বাঁচলো। এভাবে পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতেই সে দেখা পেয়ে গেলো তার সেই পুরনো বান্ধবীর, যে মেয়েটি একসময় চেলো বাজাতো, এখন সে একজন অভিনেতার স্ত্রী এবং অন্তসত্ত্বা। অভিনেতা স্বামীটি খুব ভালো লোক, তারা ২জন মিলে তাকে অন্য একটা অপরিচিত বাসায় আত্মগোপন করে থাকার জায়গা দিলো। এখানেও সেই একই সমস্যা, দিনের পর দিন কেটে যায়, কেউ খাবার দিতে আসে না, সে নিজেও বেরোতে পারে না। ভয়াবহ ক্ষুধায় সে মরোমরো হয়ে রইলো কতদিন, জন্ডিস হয়ে গেলো তার। একেবারে মৃত্যুর আগ মুহুর্তে এসে মেয়েটি তাকে খাবার দিলো, ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করলো। তারপর একসময় যখন রাশিয়ানরা জার্মানদের আক্রমণ করলো তখন বোম্বিং হয়ে সেই বাড়িটাও গেলো ধ্বসে।

আবার শুরু হলো বেঁচে থাকার তাড়না, পালিয়ে বেড়ানো জীবন। চারিদিকে তখন শুধু ধ্বংসস্তুপ আর লাশ। একমুখ দাড়ি-গোঁফ নিয়ে ভগ্নপ্রায় শরীরে একটা বাড়িতে ঢুকে বহুকষ্টে একটা খাবারের ক্যান খোলার চেষ্টা করতে গিয়ে সে অনুভব করলো, তার ঠিক সামনে একজন জলজ্যান্ত জার্মান সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে।

জার্মান সৈন্যটি কিন্তু চাইলেই তাকে বিনাবাক্য ব্যয়ে হত্যা করতে পারতো। কিন্তু তা সে করেনি। সে পিয়ানোবাদক জেনে সৈন্যটি কেবল তাকে একটু পিয়ানো বাজিয়ে শোনাতে বলেছিলো। তার হাতের অসাধারণ বাজনা শুনে সৈন্যটি তাকে অনেকদিন পর্যন্ত সেখানেই থাকার আশ্রয় দেয়, খাবার এনে দেয়, চলে যাবার সময় তার গায়ের গরম কোটটি পর্যন্ত খুলে দেয়। তারপর যুদ্ধশেষে এই বেচারা পিয়ানোবাদক স্পিলম্যান স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে, আবার আগের মত পোলিশ রেডিওতে পিয়ানো বাজানো শুরু করে, আর সেই সৈন্যটি, যে তাকে জীবন ভিক্ষা দিয়েছিলো, সেই হতভাগ্য কয়েক বছর পর একটা সোভিয়েত ক্যাম্পে বন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। রাশিয়ানদের হাতে ধরা পড়ার পর সে একজন পোলিশ লোকের কাছে নায়কের নাম করে তার সাহায্য চেয়েছিলো, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে............

চলচ্চিত্র মাত্রেই সময়ের কথা বলে। এই মুভিটিও তার ব্যতিক্রম নয়। দেখার বিষয় কেবল একটাই, তা হলো, এই কথাটা কিভাবে বলা হচ্ছে, সাধারণ মানুষের কাছে তা পৌঁছানো যাচ্ছে কিনা বা তারা সেটা অনুধাবন করতে পারছে কিনা। মেকিং, পরিচালনা এবং অভিনয়ের কারণে ছবিটি দেখার সময় আপনার একবারও মনে হবে না যে আপনি বর্তমান সময়ে আছেন, ছবিটি নিজ গুণেই আপনাকে সেই সময়ে টেনে নিয়ে যাবে। জীবনের কাছে মানুষ যে কতটা জিম্মি, যুদ্ধ যে মানুষের জীবনকে কতদুর বিপর্যস্ত করতে পারে এবং যুদ্ধ যে মানবতার বিরূদ্ধে কতবড় অভিশাপ, এই মুভিটি না দেখলে তা বোঝা সম্ভব নয়। একদিকে মানুষের অসহায়ত্ব, অন্যদিকে মানুষের নিষ্ঠুরতা যেমন আপনাকে কাঁদাবে, মানুষের মহত্ত্ব তেমনি আপনার মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলবে।

আমি বোধহয় প্রথমবার দেখে বুঝতে পারিনি যে মুভিটি আমার ঠিক কতখানি ভালো লেগেছে, তাই বোকার মত ভেবেছিলাম আর দেখবো না। অথচ পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে হলো, রোমান পোলানস্কির মুভি, এত ভালো মুভি মাত্র একবার দেখলাম? নাহ... আবার দেখতে হবে, বারবার দেখতে হবে, ১০০ বার দেখতে হবে.............

যতই দেখি, ততই প্রেমে পড়ে যাই। :)


....................................................................................

[অতিরিক্ত দীর্ঘ লেখার জন্য খুবই আন্তরিকভাবে দু:খ প্রকাশ করছি। এই ব্লগে অনেক বড় বড় মুভি বোদ্ধা আছেন, আমার দেখার এবং জানার পরিধি তাদের তুলনায় অত্যন্তই সীমিত।]
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০০৯ বিকাল ৫:৪২
৫২টি মন্তব্য ৪৭টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×