দীপাবলী দুটি আলাদা খন্ডে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে একমলাটে আনা হয়। উপন্যাসের কাহিনী একটি মেয়েকে নিয়ে এগিয়েছে। তার নাম দীপাবলী। শিলিগুড়ির কাহিনী। আসলে শিলিগুড়ির প্রতি আকর্ষণও তৈরি হয় দীপাবলীর জন্য। দীপাবলীকে দেখতে শিলিগুড়ি গেলে একটি মজার ঘটনা ঘটে। শিলিগুড়ি বাস স্ট্যাশনে নেমেই আমার দীপাবলীর কথাই মনে পড়ে। সামনে বড় একটি সাইনবোর্ডে দেখি একটি লবনের বিজ্ঞাপন। দীপাবলী লবন! খুব ভাল লেগেছিল। দীপাবলীকে ভালবেসেই একটি রাত থেকেছিলাম শিলিগুড়িতে। ‘সাতকাহন’ এর প্রথম পর্ব পরে- অসম্পূর্ণ মনে হয়েছিল। একটি তীব্র আকাঙক্ষা এবং অতৃপ্তি ছিল, এরপর দীপাবলীর কি হল? পাঠকদের অতৃপ্তি ঘোচাতে লেখক সাতকাহনের দ্বিতীয় খন্ড বের করেন। এতে পাঠক প্রথম পর্বের আকর্ষণীয় দিপাবলীকে আর খুঁজে পায়নি। একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্বপালনরত সাধারণে নেমে আসা এমন দীপাবলীকেতো দেখতে চাইনি।
উপন্যাসের শুরুতেই শিলিগুড়ির চাবাগান আর বানডাকা নদীর ধারের কুসংস্কার আর নারী-বন্দিত্বের সময়ে বছর দশেকের এক কিশোরী দুরন্ত দীপাবলীর জীবন সংগ্রামের কথাই তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। বইটি পড়েছিলাম উচ্চ-মাধ্যমিকে পড়ার সময়। এখনো মনে হয় চোখের সামনে দিয়ে ফ্রকপরা দশ বছরের দীপাবলী চা-বাগান দিয়ে দৌড়াচ্ছে। ওর মেধার স্ফূরণ এখনো মুগ্ধ করে। মনের জোর একটি মেয়েকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে আসলো। কতটা বিরুদ্ধে থাকা জীবনকে কতটা সাফল্যমণ্ডিত করা যায় তারই উদাহরণ- দীপাবলী। হয়তো একারণেই দীপাবলী মানে দীপাবলীর সাতকাহন এতো জনপ্রিয় হয়েছিল। শুধু নারীরা নয় অসংখ্য পুরুষেরও প্রিয় চরিত্র হয়ে উঠেছে দীপাবলী। জলপাইগুড়ি আর দীপাবলী অভিন্ন হয়ে দাঁড়ায়। আমার মতো অনেকেই জয়পাইগুড়ি গিয়ে হয়তো খুঁজে দীপাবলীকে, চা-বাগানে হয়তো দেখতে পায় ১০ বছরে এক উচ্ছ্বল দীপাবলী দৌড়াচ্ছে। কিন্তু কেউ জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে যদি কাউকে মনে করতে চায় তবে সে নিশ্চিত হয়ে উঠবে পৃথু ঘোষ!
মাধুকরী উপন্যাসের পৃথু ঘোষ চেয়েছিলেন বড় বাঘের মতো বেঁচে থাকতে। সেটা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। বড় বাঘের যেমন হতে হয় না কারও উপর নির্ভরশীল- না নারী, না সংসার, না গৃহ, না সমাজ সেভাবেই বাঁচবে সে, স্বরাট, স্বয়ম্ভর হয়ে। তার বন্ধু ছিল তথাকথিত সমাজের অপাংতেয়রা। পৃথু উপন্যাসের মাঝপথেই পা হারায়। সমাজের অপাংতেয় কয়েকজনের নিকট নায়ক হলেও নিজ পরিবারেই সে ছিল অপাংতেয়। পৃথু ঘোষ বিশ্বাস করতো, এই পৃথিবীতে এক নতুন ধর্মের দিন সমাসন্ন, সে ধর্মে সমান মান-মর্যাদা এবং সুখ-স্বাধীনতা পাবে প্রতিটি নারী-পুরুষ। মধ্যপ্রদেশের জংগলই এই উপন্যাসের উপজীব্য। বন্য জীবন, শিকার, অপরাধ, ডাকাত, প্রতারণা, ভালবাসা আর উপেক্ষার গল্প। কিভাবে বন-মোরগ ধরতে হয়? কিভাবে শিকার করতে হয় নীলগাই? জঙ্গলের এক অনন্য উপাখ্যান। মনে হয়েছিল জংগল আর পৃথু অবিচ্ছেদ্য। উপন্যাসের শেষে তাকে সেই প্রিয় জংগলময় এলাকাই ছাড়তে হয়। এই উপন্যাসের জংগল যেমন আকর্ষণ আর জংগলের আকর্ষণ পৃথু ঘোষ। বাংলা সাহিত্যের এক অসাধারণ চরিত্র। কলেজে পড়ার সময় এক বন্ধু বুদ্ধদেব গুহর ‘বাবলি’ উপন্যাসের খোঁজ দিল। পড়ে বিরক্ত হলাম। যৌনতাই প্রধান। তবে জঙ্গল কেন্দ্রিক কয়েকটি উপন্যাস পড়ে কিছুটা ভাল লাগলো। এর মধ্যেই একদিন হাতে আসলো ‘মাধুকরী’ উপন্যাস। এটি বাংলাভাষায় লেখা একটি বড় ক্যানভাসের বৃহৎ উপন্যাস। জঙ্গল আপনাকে আকর্ষণ করুক আর না করুক- পৃথু ঘোষ আপনাকে ঠিকই আকর্ষণ করবে। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরে বইটি পড়ার সুযোগ হয়। কোন বন্ধুর কাছ থেকে হাওলাত নিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই, ফেরতও দিয়েছিলাম ঠিকই কিন' বই পড়ার সেই মুগ্ধতা আজো কাটেনি, কাটার নয়।
আজই এক আড্ডায় উচ্চ শিক্ষিত পুরুষদের চাকরি না করার মানসিকতা গড়ে উঠা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। বগুড়ায় কোন বিলাত ফেরত ব্যারিস্টার কোর্টে প্রাকটিস না করে বেছে নিয়েছেন গরুর খামার। একজন চাকরিজীবী নারী জানালেন, তার উচ্চপদে থাকা চাকরিজীবী স্বামীও সাতক্ষীরায় গিয়ে চিংড়ি চাষ করতে চান। চাকরিতে থেকে চাকর চাকর মনোভাব দূর করতে চান! পৃথু ঘোষও বিলাত ফেরত ইঞ্জিনিয়ার। যারা জীবনের মানে খুঁজতে চান তারাও দেখতে পারেন পৃথু ঘোষের বিচিত্র জীবন। বিতৃষ্ণাকে ঝেড়ে ফেলে জীবনের প্রতি আসক্তি আনার চ্যালেঞ্জ রয়েছে এই জীবনে। উচ্চ শিক্ষা পৃথু ঘোষকে তার জীবনকে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে। পৃথুর কি মধুকরের মত বৃত্তি? তার স্ত্রী ছাড়াও আরো দুই নারীর দ্বারে দেখেছি কিন্তু তিনি মধুকরের মতোই বহু ঘাট হতে সংগ্রহ করেছেন জীবনের অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতাই তাকে জানিয়েছে জীবনের মস্তবড় অর্থ রয়েছে। তাই ঘরে সুন্দরী স্ত্রী কারখানার চাকরি তাকে বেঁধে রাখতে পারে না সে হয়ে যায় ঘর ছাড়া পথিক। জীবনের জন্য আনন্দ খুঁজে বেড়ানোই তার কাজ। পৃথু প্রথা ভাঙ্গতে পারে, শ্রেণিহীন হতে পারে; তখন কমরেড হয়ে উঠে। বইটি প্রকাশের তিন যুগ পরে এসে আমরা প্রথা ভাঙ্গতে চাওয়া কিছু তরুণকে দেখতে পাই।
দীপাবলীর সাথে বৈপরীত্য। দীপাবলী বেড়ে উঠেছে প্রতিবন্ধকতার মধ্যে। শত প্রতিকূলতা ঠেলে সে উঠে এসেছে উচ্চস্থানে- একটি গুরুত্বপূর্ণ চাকরিতে। আর পৃথু ঘোষ উচ্চ স্থান থেকে নেমেছে ব্রাত্যজন হয়েছে সব থাকা সত্ত্বেও। এতো বিপরীত দুটি চরিত্র বহু পাঠকদের মুগ্ধ করে রেখেছে। এই বৈপরত্যের মধ্যে কাকে ধরে নিয়ে সঠিক পথ। সিংহভাগই মুখে যাই বলুক তারা পৃথু ঘোষ হতে চাইবে না, তারা থিতু হতে চাইবে দীপাবলীতেই। কিন' শেষ পর্যন্ত আকর্ষণীয় চরিত্র হিসেবে পৃথু ঘোষ মাথা উঁচু করেই দাঁড়িয়ে থাকবে। আর উচ্চ চাকরিতে গিয়ে কেমন পানশে হয়ে গেল আকর্ষণীয় দীপাবলী! বাংলা সাহিত্যের দুটি আকর্ষণীয় চরিত্রই সৃষ্টি করেছেন সমরেশ মজুমদার আর বুদ্ধদেব গুহ। একসাথে দুজনকেই পেতে চাই। কাউকেই ছেড়ে দেয়া যায় না।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১০:০৩