somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাস্কর্য নাকি মুর্তি : আসুন জানি প্রকৃত ইতিহাস

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ১১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভাস্কর্য নাকি মুর্তি : আসুন জানি প্রকৃত ইতিহাস


মূর্তি নাকি ভাস্কর্য; ভাস্কর্য নাকি মূর্তি। অনেক হয়েছে সংজ্ঞায়ন। তাই সেদিকে না গিয়ে প্রারম্ভেই আলোকপাত করার ইচ্ছা রাখি, সত্য-মিথ্যার রাস্তা ভাগ হওয়ার ইতিহাস, কিভাবে এল মূর্তি ও মূর্তিপূজা তার বিশদ আলোচনা। তার আগের কাহিনীইবা কি- সে ব্যাপারেও ধারাবাহিক আলোকপাত থাকছে এই নিবন্ধে।

প্রাথমিক পর্যায়ে “তামাছিলা” শব্দটির অর্থ জানব বিভিন্ন অভিধানের আলোকে-

“তামাছিলা” শব্দের অর্থ :

► মূর্তি, প্রতিমা, প্রতিমুর্তি, প্রতিচ্ছবি, আকৃতি (আল মু’জামুল ওয়াফী- পৃষ্ঠা নং-320)
► মুর্তি, প্রতিমুর্তি, ভাস্কর্য (আল আকমুস আল ইসতিহালি- পৃষ্ঠা নং- 194)
► মূর্তি, নকশা, ছবি (আল মুরাদিফ-62 পৃষ্ঠা)
► ভাস্কর্য (বাংলা-ইংজেরী-আরবী ব্যবহারিক অভিধান-পৃষ্ঠা নং-562)
► মুর্তি-(বাংলা-ইংজেরী-আরবী ব্যবহারিক অভিধান-পৃষ্ঠা নং-605)

পুনশ্চ: “তামাছিলা” শব্দটির অর্থ জানব বিভিন্ন কিতাবের আলোকে-
“তামাছিলা” শব্দের অর্থঃ

“তাছ্বাবিরু, তামাছিলু, তাছ্বালিবু”- শব্দত্রয়কে বহুবচন ও এদের একবাচনিক অর্থ যথাক্রমে ছবি, মূর্তি ও ক্রুশযুক্ত ছবি মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে।(ছবি ও মূর্তি : লেখক- মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল গালিব)

“তামাছিলা” শব্দটি “তিমছালুন” এর বহুবচন। অর্থ প্রতিমা, মূর্তি। [তাফসির আহসানুল বয়ান-পৃষ্ঠা নং-748, টীকা-93]

তাফসির ইবন কাসির এর 16 তম খন্ডের 43 নং পৃষ্ঠায় “তামাছিলা” শব্দের অর্থ বলা হয়েছে “ছবি”।

“তামাছিলা” শব্দের অর্থ তামা কিংবা কাঠের তৈরী মূর্তি বা ভাস্বর্য।– [তাফসির ফি যিলালিল কোরআনের 16 তম খণ্ডের 223 পৃষ্ঠায়]

“তামছিল” এর বহুবচন “তামাছিল”। এর অর্থ ভাস্কর্য. মূর্তি, বিগ্রহ, প্রতিমা। আর এখানে ভাস্কর্য বলে বুঝানো হয়েছে পিতল, তামা, সিসা ও মর্মর প্রস্তর নির্মিত মূর্তিকে। [তাফসির মাজহারি নবম খণ্ডের 601 পৃষ্ঠায়]

“তামাছিলা” শব্দটি তামাছিল এর বহুবচন। অর্থ চিত্র, বিগ্রহ। [তাফসির মাআরেফুল ক্বোরআন- (সংক্ষিপ্ত) পৃষ্ঠা নং-1105]

[বি.দ্র.“তামাছিলা” শব্দটি পবিত্র আল-কুরানের 22 তম পারার 34 নং সূরা সা’বা-র 13 নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে।]


মুর্তিপূজার প্রারম্ভ এবং ভাস্কর্যের সাথে এর যোগসূত্র আলোচনার সূচনাতেই জ্ঞাত হওয়া আবশ্যিক মানবজাতির বিভক্তির ইতিহাস। চলুন দেখি-

মহান আল্লাহ বলেন-“সমস্ত মানুষ ছিল একই উম্মত”..... সূরা বাক্বারা-213 নং আয়াত এর প্রথমাংশ।

“আর সমস্ত মানুষ এক উম্মতই ছিল, অতঃপর তারা মতভেদ সৃষ্টি করল....”। (সূরা ইউনুছ এর 19 নং আয়াতের প্রথমাংশ)
একই বিশ্বাস ও তাওহিদের অনুসারিগণের মধ্যে বিভক্তির পূর্বাপর জেনে নেয়া যাক।

প্রথমেই সূরা বাক্বারার 213 নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরের কিতাবগুলোতে কি লিখেছেন ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হল -

কোন এককালে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ একই মতাদর্শের অন্তর্ভূক্ত ছিল। তারা নিঃসন্দেহে তাওহীদের উপর ছিল। আদম আ. এর আগমনের পরে ও নুহ আ. এর আগমনের মাঝখানে দশ শতাব্দি অতিবাহিত হয়ে যায়। একে দশটি প্রজন্ম বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই দশটি প্রজন্ম হেদায়েতের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এরপর তাদের মধ্যে ইমান, আক্বিদা, বিশ্বাসের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। ফলে মহান আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিন নবী-রাসূলগণকে মানবজাতির হেদায়েতের জন্য প্রেরণ করেন। (কুরআনুল কারিম তাফসির- ডাঃ জাকারিয়া)


আদম আ. থেকে নুহ আ. পর্যন্ত দশ শতাব্দি অবধি যে তাওহিদের শিক্ষা নবিরা দিয়েছেন সেই তাওহীদের উপরই মানুষ প্রতিষ্ঠিত ছিল। এরপর শয়তানের চক্রান্তে তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিল এবং শির্ক ও করবপূজা ব্যাপক হয়ে গেল। (তাফসিরে আহসানুল বয়ান- সূরা বাক্বারার 86 নং টিকার প্রয়োজনীয় অংশ)

শিরকের প্রথম উদ্বোধন শিরেনামে, আল্লাহ সংবাদ দিচ্ছেন যে, এখন লোকদের মধ্যে শিরকের উৎপত্তি ঘটেছে। পূর্বে এর কোন অস্তিত্ব ছিল না কিন্তু এখন হয়েছে। সমস্ত লোক একই দীনের উপর ছিল। আর তা ছিল প্রথম হতেই ইসলাম। ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন যে, আদম আ. ও নুহ আ. এর মধ্যে দশটি শতবর্ষ অতিবাহিত হয়েছে। এসব লোক আদম আ. এর সত্য দীন ইসলামের উপর ছিল। তারপর লোকদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয় এবং তারা মূর্তিপূজা করতে শুরু করে।–(তাফসিরে ইবনে কাসির সূরা ইউনুছ এর 19 নং আয়াতের ব্যাখ্যায়)

ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন, নুহ আ. ও আদমের (আ) এর মধ্যে দশটি যুগ ছিল, ঐ যুগসমূহের লোকেরা সত্য শরিয়াতের অনুসারি ছিল। অতঃপর তাদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়। তখন আল্লাহ তায়ালা নবিগণকে (আ) প্রেরণ করেন। (স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও মতভেদ করা হল দীনকে অস্বীকার করা শিরোনামে তাফসির ইবনে কাসির)

“এ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, কোন এককালে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ একই মতাদর্শ ও ধর্মের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সবাই একই ধরণের বিশ্বাস ও আকিদা পোষণ করত। তা ছিল প্রকৃতির ধর্ম। অত:পর তাদের মধ্যে আকিদা, বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার বিভিন্নতা দেখা দেয়। ফলে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করা বা পরিচয় দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই আল্লাহ তায়ালা সত্য ও সঠিক মতবাদকে প্রকাশ করার জন্য এবং সঠিক পথ দেখাবার লক্ষ্যে নবী ও রাসুলগণকে প্রেরণ করেন। তাদের প্রতি আসমানি কিতাব অবতীর্ণ করেন।” [তাফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন (সংক্ষিপ্ত)-পৃষ্ঠা 106, সূরা বাকারার 213 নং আয়াতের ব্যাখ্যায় ]

এছাড়াও বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে তাফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন এর 107 নং পৃষ্ঠায়। দেখে নেয়া যাক-

যখন প্রতিটি মানুষ একই মত ও আদর্শ এবং একই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত ছিল- প্রশ্ন উঠে সে মত ও বিশ্বাসটি কি ছিল? এতে দু’টি সম্ভবনা বিদ্যমান। (1) হয় তখনকার সব মানুষ তাওহিদ ও ইমানের বিশ্বাসে ঐক্যবদ্ধ ছিল। নতুবা (2) সবাই মিথ্যা ও কুফরিতে ঐক্যবদ্ধ ছিল। অধিকাংশ তাফসিরকারকের সমর্থিত মত হচ্ছে, সে আকিদাটি ছিল সঠিক ও যথার্থতা ভিত্তিক। অর্থাৎ তাওহীদ ও ঈমানের ঐক্যমত্য।
এ আয়াতের দ্বারা বোঝা যাচ্ছে যে, ‘এক’ বলতে আকিদা ও তরীকায় একত্ব এবং সত্য-ধর্ম বলে আল্লাহর একত্ববাদ ও ঈমানের ব্যাপারে ঐক্যমত্যের কথাই বলা হয়েছে।

এখন দেখতে হবে, এ সত্য দ্বীন ও ঈমানের উপর সমস্ত মানুষের ঐক্যমত্য কোন যুগে প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তা কোন যুগ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল? তাফসিরকার সাহাবিগণের মধ্যে হযরত ইবান ইবনে কা’ব এবং ইবনে যায়েদ রা. বলেছেন যে, এ ঘটনাটি ‘আলমে-আযল’ বা আত্নার জগতের ব্যাপার। অর্থাৎ সমস্ত মানুষের আত্নাকে সৃষ্টি করে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই? তখন একবাক্যে সকল মানুষ একই আকীদাতে বিশ্বাসী ছিল, যাকে ঈমান ও ইসলাম বলা হয়।– (কুরতুবী)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন যে, এই একত্বের বিশ্বাস তখনকার, যখন হযরত আদম আ. স্বস্ত্রীক দুনিয়াতে আগমন করলেন এবং তাদের সন্তান-সন্ততি জন্মাতে আরম্ভ করল আর মানবগোষ্ঠি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে শুরু করলো। তারা সবাই হযরত আদম আ. এর ধর্ম, তার শিক্ষা ও শরিয়াতের অনুগত ছিল। একমাত্র কাবীল ছাড়া সবাই তাওহীদের সমর্থক ছিলেন।

‘মুসনাদে বাযযার’ গ্রন্থে হযরত ইবনে আব্বাসের উদ্ধৃতির সাথে সাথে একথাও উল্লেখ রয়েছে যে, একত্বের ধারণা হযরত আদম আ. থেকে আরম্ভ করে হযরত ইদরিস আ. পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। সেই সময় সবাই মুসলমান এবং একত্ববাদে বিশ্বাসি ছিলেন। এতদুভয় নবীর মধ্যবর্তী সময় হল দশ ‘করন’। বাহ্যত এক ‘করন’ দ্বারা এক শতাব্দি বোঝা যায়। সুতরাং মোট সময় ছিল এক হাজার বছর।
কেউ কেউ একথাও বলেছেন যে, এই একক বিশ্বাসের যুগ ছিল হযরত নুহ আ. এর তুফান পযর্ন্ত। নুহ আ. এর সাথে যারা নৌকায় আরোহণ করেছিলেন, তারা ব্যতীত সমস্ত বিশ্ববাসী এতে ডুবে মরেছিল। তুফান বন্ধ হওয়ার পর যারা জীবিত ছিলেন, তারা সবাই ছিলেন মুসলমান, সত্য ধর্ম ও একত্ববাদে বিশ্বাসী।

বাস্তবপক্ষে এ তিনটি মতামতের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। তিনটি যুগই এমন ছিল, যেগুলোতে সমস্ত মানুষ একই মতবাদ ও একই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং সত্য ধর্মের উপর কায়েম ছিল। [তাফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন (সংক্ষিপ্ত)-পৃষ্ঠা-107]

বারযার তার মসনদে, হাকেম তার মুসতাদরাকে এবং ইবনে জারির, ইবনে আবি হাতেম ও ইবনে মুনজির তাদের তাফসিরে বিশুদ্ধসূত্রে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের উক্তি উদ্বৃত করেছেন এই রকম-হযরত আদম ও হযরত নুহ এর মধ্যে দশটি যুগের ব্যবধান ছিল। ঐসকল যুগের লোকেরা ছিল সঠিক ধর্মের অনুসারী। পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে অনৈক্যের সৃষ্টি হয়। হযরত কাতাদা থেকে হযরত ইবনে আবি হাতেম বলেছেন দশটি যুগের ব্যবধানেই ছিলেন হযরত আদম ও হযরত নুহ। তাদের মধ্যবর্তী লোকেরা ছিলেন বিদ্বান ও পথপ্রাপ্ত। পরে তাদের একতা বিনষ্ট হয়। তখন হযরত নুহ আ. কে আল্লাহপাক নবী হিসেবে প্রেরণ করলেন। তিনি্ই ছিলেন প্রথম প্রেরিত রসুল। আতা ও হাসান বলেছেন, হযরত আদমের মহাপ্রস্থানের পর থেকে হযরত নুহ আ. এর আবির্ভাবের মধ্যবর্তী সময়ে মানুষেরা ছিল চতুষ্পদ জন্তুর মতো অবিশ্বাসী। আল্লাহপাক তখন হযরত নুহ আ.কে প্রেরণ করেন। (তাফসির মাজহারি-প্রথম খন্ড)

বি.দ্র- উপরে উল্লেখিত তাফসিরের বিভিন্ন কিতাবাদির বর্ণনায় হযরত আদম আ. হতে হযরত নুহ আ. এর সময়কাল সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য জানা গেল। পাশাপাশি এও প্রকাশ্য হলো যে, আদম আ. হতে হযরত নুহ আ. এর মধ্যবর্তী সময়েও রাসুলগণের আগমন ঘটেছিল এবং তারা আল্লাহর বাণী প্রচার করেছিলেন। পাশাপাশি এই তথ্যও মানসপটে পরিস্কার হয়ে গেল যে, আমাদের তর্কিত সমস্যা অর্থাৎ ভাস্কর্য ও মুর্তি বিষয়ক আলোচনার আদি প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল হযরত নুহ আ. এর আগমনের পূর্বকালীন সময়ে এবং উক্ত প্রেক্ষাপটেই নুহ আ. দ্বিনী তাবলিগ করেন।

কি ঘটেছিল নুহ আ. এর আগমণের পূর্বে তা জানতে ধৈর্য সহকারে পড়তে থাকুন।

মহান নবী হযরত নুহ আলাইহিসসালাম ও তার পূর্বপুরুষগণের পরিক্রমা জানাটা জরুরী কেননা আদম আ. ও নুহ আ. এর মধ্যবর্তী সময়েই রোপিত হয়েছিল শিরকের ভয়াবহ বীজ।
নুহ ইবন মালাক ইবন মুতাওশশালিখ ইবন খানুম। আর খানুম হলেন ইদরিস ইবন য়ায়দ ইবন মাহলাইন ইবন কীনন ইবন আনূশ ইবন শীচ ইবন আবুল বাশার আদম আলাইহিসসালাম। আদম আলা. এর ওফাতের একশত ছাব্বিশ বছর পর তার জন্ম। আহলে কিতাবদের প্রাচীন ইতিহাস মতে, নুহ আ. এর জন্ম ও আদম আ. এর ওফাতের একশ ছেচল্লিশ বছরের ব্যবধান ছিল। দুজনের মধ্যে ছিল দশ করন (যুগ) এর ব্যবধান। রাসুল স. কে এক ব্যক্তি জানতে চান, হযরত আদম আ. নবী ছিলেন কিনা? জবাবে রাসুল স. বলেন- হ্যা, আল্লাহ তার সাথে কথা বলেছেন। লোকটি আবার জানতে চাইল- তার ও নুহ আ. এর মাঝে ব্যবধান ছিল কত কালের? রাসুল স. উত্তরে বললেন- দশ যুগের।
সাধারণ্যে প্রচলিত- এক করণ বা এক যুগ বলা হয়-একশ বছর সময়কে। সেই হিসাবে উভয় নবির মধ্যে ব্যবধান ছিল এক হাজার বছরের। দুজনের মধ্যবর্তী সময়ে এমন কিছু যুগ অতিবাহিত হয়েছে যখন লোকজন ইসলামের অনুসারি ছিল না।
পক্ষান্তরে, যদি করন দ্বারা প্রজন্ম বুঝানো হয়ে থাকে- আল্লাহ তায়ালা বলেন-
“নুহের পর আমি কত প্রজন্মকে ধ্বংস করেছি।”- (17:17)
“তারপর তাদের পরে আমি বহু প্রজন্ম সৃষ্টি করেছি।”- (23:42)
“ তাদের অন্তবর্তী কালের বহু প্রজন্মকেও।” – (25:38)
“ তাদের পূর্বে কত প্রজন্মকে আমি বিনাশ করেছি।” (19:74)
নুহ আ. এর পূর্বে বহু প্রজন্ম দীর্ঘকাল বসবাস করেছিল। এ হিসাবে আদম আ. ও নুহ আ. এর মধ্যে ব্যবধান দাঁড়ায় কয়েক হাজার বছরের। আল্লাহই সবজ্ঞ।

যখন মুর্তি ও দেব-দেবীর পূজা শুরু হয় এবং মানুষ বিভ্রান্তি ও কুফরিতে নিমজ্জিত হতে শুরু করে, তখন মানুষের জন্য রহমত স্বরুপ আল্লাহতায়ালা নুহ আ.-কে প্রেরণ করেন। [এই কয়েকটি তথ্য আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইসলামের ইহিতাস : আদি-অন্ত) 1ম খন্ড 230 পৃষ্ঠায় নুহ আ. এর কাহিনী থেকে নেয়া হয়েছে ]


নুহ আ. এর পূর্বের নবিগণ-
হযরত ইদরিস আ.

একজন নবি। হযরত আদম আ. এর অধনস্ত সপ্তম পুরুষ এবং হযরত নুহ আ. এর অষ্টম প্রপিতামহ এবং তিনি 365 বছর বয়স লাভ করিয়াছিলেন। তার উপর 30 টি সহিফা নাযিল করা হয়। লিখন পদ্ধতি, জ্যোতি বিজ্ঞান ও অংকশাস্ত্র তার উদ্ভাবন। আরবি লেখকদের বরাত দ্বারা তাকে চিকিৎসা, জ্যোতিবিদ্যা, চিত্রকলার প্রতিষ্ঠাতা এবং সর্বপ্রথম পুস্তক পাঠ দানকারী ও কাপড় সেলাই করে পরিধানকারী বলা হয়েছে। (ইসলামী বিশ্বকোষ পার্ট-3 এর – পৃষ্ঠা নং- 772-74 হতে হযরত ইদরিস আ. সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনাস্থল থেকে কয়েকটি বাক্যবিশেষ)
আদম আ. ও শীছ আ. এর পরে হযরত ইদরীস আ. সর্বপ্রথম আদম সন্তান যাকে নবুওয়াত দান করা হয়েছিল। ইনিই সর্বপ্রথম কলম দ্বারা লেখা আবিষ্কার করেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইসলামের ইহিতাস : আদি-অন্ত) 1ম খন্ড 228 পৃষ্ঠা হতে)

হযরত ইদরিস আ. আদম আ. এর পর প্রথম নবী ছিলেন এবং নুহ আ. বা তার পিতার দাদা ছিলেন।সর্বপ্রথম তিনিই কাপড় সিলাই শুরু করেন। (তাফসির আহসানুল বয়ানে 56 নং আয়াতের ব্যাখ্যায় 89 নং টীকা)

হযরত শীছ আ.

শীছ অর্থ আল্লাহর দান। হাবিলের নিহত হওয়ার পরে এই সন্তান লাভ করেছিলেন বলে আদম আ. ও হাওয়া আ. এর নাম শীছ রাখেন। হযরত শীছ আ. এর উপর 100 খানা সহিফা নাজিল করা হয়।

আদম আ. এর বংশ পরম্পরা সম্পর্কে যা জানা যায়- শীছের যেদিন জন্ম হয় সেদিন আদম আ. এর বয়স একশ ত্রিশ বছর। এরপর তিনি আরো আটশো বছর বেঁচেছিলেন। শীছের ঔরশে আনুশ এর জন্ম হয়। আনুশ এর জন্মের দিন শীছ এর বয়স ছিল একশত পয়ষট্টি বছর। এরপর তিনি আরো আটশ সাত বছর বেঁচেছিলেন। আনুশ ছাড়াও তার আরো কয়েকটি সন্তান ভূমিষ্ট হন। আনূশের বয়স যখন নব্বই বছর তখন তার পুত্র কিনান এর জন্ম হয়। এরপর তিনি আরো আটশ পনের বছর বেঁচেছিলেন। এ সময় তার আরো কয়েকটি ছেলে–মেয়ে জন্ম হয়। কিনানের বয়স সত্তর বছর উপনীত হলে তার ঔরষে মাহলাইল এর জন্ম হয়। এরপর তিনি আরো আটশ চল্লিশ বছর আয়ু পান। এসময় তার আরো কিছু ছেলে-মেয়ের জন্ম হয়। তারপর মাহলাইল পয়ষট্টি বছর বয়েসে উপনীত হলে তার পুত্র য়ারদ এর জন্ম হয়। এরপর তিনি আরো আটশ ত্রিশ বছর বেঁচে ছিলেন। এসময় তার আরো কয়েকটি ছেলে-মেয়ে জন্ম হয়। য়ারদ একশত বাষট্টি বছর বয়সে পৌছালে তার পুত্র খানুখ এর জন্ম হয়। এরপর তিনি আরো আটশ বছর বেঁচে থাকেন। এসময় তার আরো কয়েকটি পুত্র-কন্যা জন্মগ্রহণ করে। খানুখের বয়স পয়ষট্টি বছর হলে তার পুত্র মুতাওয়াশশালি এর জন্ম হয়। তিনি আরো আটশ বছর বেঁচে ছিলেন। এসময় তার আরো কয়েকটি ছেলে-মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। তারপর মুতাওয়াশশালি যখন একশত সাতাশি বছর উপনীত হন তখন তার পুত্র লামাক এর জন্ম হয়। তিনি আরো সাতশ বিরাশি বছর হায়াত পান। এসময় তার আরো কয়েকটি ছেলে-মেয়ে জন্মলাভ করে। লামাক এর বয়স একশ বিরাশি বছর হলে তার ঔরষে নুহ আ. এর জন্ম হয়। এরপর তিনি আরো পাঁচশ পচানব্বই বছর বেঁচে থাকেন। এসময় তার আরো কয়েকটি ছেলে-মেয়ে জন্ম হয়। নুহ আ. এর বয়স পাঁচশ বছর হলে তার ঔরশে সাম, হাম ও য়াফিছ এর জন্ম হয়। এ হলো আহলে কিতাবদের গ্রন্থের সুস্পষ্ট বর্ণনা। [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইসলামের ইহিতাস : আদি-অন্ত) 1ম খন্ড হতে ]

হযরত আদম আ. ও হযরত নুহ. আ. এর মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যেই রোপিত হয়েছিল শিরকের ভয়াবহ বীজ- এই অংশে সেই আলোচনা থাকছে।


তারা বলছে “ তোমরা তোমাদের উপাস্যদেরকে ত্যাগ করো না এবং ত্যাগ করোনা ওয়াদ, সুয়া, ইয়াগুছ, ইয়াওক ও নছরকে। (সূরা- নুহ : আয়াত 23)

সূরা নুহ এর 23 নং আয়াতের ব্যাখ্যা এবং এতদসংশ্লিষ্ট ঘটনাক্রম পরিচ্ছন্ন ছুদুরের সাথে খেয়াল করলে মুর্তিপূজার প্রারম্ভ এবং মানবজাতির তাওহীদ ও শিরক দুটি রাস্তায় ভাগ হয়ে যাবার সত্যাসত্য দিবালোকের ন্যয় ফুটে উঠবে।

সহিহ বুখারীতে ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত হয়েছে যে, নুহ আ. এর যুগের মুর্তিগুলো আরবের কাফেরেরা গ্রহণ করে। ‘দাওমাতুল জান্দাল’ এলাকার কালব গোত্র ‘ওয়াদ’ মুর্তির পূজা করতো। হুযায়েল গোত্র পূজা করতো ‘সুওয়া’ নামক মুর্তির। মুরাদ গোত্র এবং সাবা শহরের নিকটবর্তী জারফ নাম স্থানের অধিবাসী বানু গাতিফ গোত্র ‘ইয়াগুছ’ নামক মুর্তির পূজা করত।হামদান গোত্র ‘ইয়াউক’ নামক মুর্তির পূজারি ছিল এবং হিমায়ের এলাকর ‘যু কালা’ গোত্র ‘নাসর’ নাম মুর্তির পূজা করত। প্রকৃতপক্ষে এগুলি নুহের আ. কাওমের সৎলোকদের নাম ছিল। তাদের মৃত্যুর পর শয়তান ঐ যুগের লোকদের মনে এই খেয়াল জাগিয়ে তুলল যে, ঐ সৎলোকদের নামে উপাসনালয়ে তাদের স্মাকর হিসাবে কোন নিদর্শন স্থাপন করা উচিত। তাই তারা সেখানে কয়েকটি নিশান স্থাপন করে ও প্রত্যেকের নামে ওগুলোকে প্রসিদ্ধ করে। তারা জীবিত থাকা পর্যন্ত ঐ সৎলোকদের পূজা হয়নি বটে কিন্তু তাদের মৃত্যুর পর ও ইলম উঠে যাওয়ার পর যে লোকগুলোর আগমন ঘটে তারা অজ্ঞতাবশতঃ ঐ জায়গাগুলোর ও ঐ নামগুলোর নিদর্শন সমূহের পূজা শুরু করে।

আলী ইবনে আবি তালহা রহ. ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণনা করেন যে, ঐ লোকগুলো ছিলেন আল্লাহর ইবাদাতকারী, দ্বীনদার, আল্লাহওয়ালা ও সৎ লোক। তারা আদম আ. থেকে নুহের আ. পর্যন্ত ছিলেন সত্যের অনুসারী, যাদের অনুসরণ অন্য লোকেরাও করত। যখন তারা মারা গেলেন তখন তাদের অনুসারীরা পরস্পর বলাবলি করলঃ যদি আমরা তাদের প্রতিমূর্তি (মুরাল) তৈরী করে নিই তাহলে ইবাদাতে আমাদের ভালভাবে মন বসবে এবং তাদের প্রতিমূর্তি দেখে আমাদের ইবাদতের আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে।’ সুতরাং তারা তাই করল। অতঃপর যখন এইলোকগুলিও মারা গেল এবং তাদের বংশধরদের আগমন ঘটল তখন ইবলিশ শয়তান তাদের কাছে এসে বললঃ ‘তোমাদের পূর্বপুরুষরাতো ঐ ব্যাক্তির মুর্তি পূজা করত এবং তাদের কাছে বৃষ্টি ইত্যাদি প্রার্থনা করত। সুতরাং তোমরাও তাই কর!’ তারা তখন নিয়মিতভাবে ঐ মহান ব্যক্তিদের প্রতিমূর্তিগুলোর পূজা শুরু করে দিল। (তাফসির ইবনে কাসির- পৃষ্ঠা নং-602-603, নূহের আ. সময়ের মূর্তিগুলোর বর্ণনা শিরোনামে)

ইমাম বগভী রহ. বর্ণনা করেন, এই পাঁচজন প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তায়ালার নেক ও সৎকর্মপরায়ন বান্দা ছিলেন। তাদের সময়কাল ছিল হযরত আদম ও নুহ আ. এর আমলের মাঝামাঝি। তাদের অনেক ভক্ত ও অনুসারি ছিল। তাদের ওফাতের পর ভক্তরা সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে আল্লাহর ইবাদত ও বিধি বিধানের প্রতি আনুগত্য অব্যাহত রাখে। কিছুদিন পর শতয়াত তাদেরকে এই বলে প্ররোচিত করল: তোমরা যেইসব মহাপুরুষের পদাঙ্ক অনুসরণ কর যদি তাদের মুর্তি তৈরি করে সামনে রেখে লও, তবে তোমাদের উপাসনা পূর্ণতা লাভ করবে এবং বিনয় ও একাগ্রতা অর্জিত হবে। তারা শয়তানের ধোকা বুঝতে না পেরে মহাপুরুষদের প্রতিকৃতি তৈরী করে উপাসনালয়ে স্থাপন করল এবং তাদের স্মৃতি জাগরিত করে ইবাদতে বিশেষ পুলক অনুভব করতে লাগল। এমতাবস্থায়ই তাদের সবাই একে একে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে গেল এবং সম্পূর্ণ নতুন এক বংশধর তাদের স্থলে স্থলাভিষিক্ত হল। এবার শয়তান এসে তাদেরকে বোঝাল : তোমাদের পূর্ব পুরুষের খোদা ও উপাস্য মুর্তিই ছিল। তারা এই মুর্তিগুলোরই উপাসনা করত। এখান থেকে প্রতিমাপূজার সূচনা হয়ে গেল। উপরোক্ত পাঁচটি মুর্তির মাহাত্ব তাদের অন্তরে সর্বাধিক প্রতিষ্ঠিত ছিল বিধায় পারস্পরিক চুক্তিতে তাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। [হযরত মাও: মুফতী মুহাম্মদ শফি র. এর তাফসিরে মাআরেফুল কুরআন (বিস্তারিত)অষ্টম খন্ড-581 পৃষ্ঠা)

এরা ছিলেন নুহ আ. এর জাতির সেই লোক যাদের তারা ইবাদত করত। এরা এতো প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন যে, আরবেও তাদের পূজা শুরু হয়েছিল। তাই অদ্দ ‘দূমাতুল জান্দল’ এর ‘কালব’ গোত্রের, সুয়া সমুদ্র উপকূলবর্তী গোত্র ‘হুযায়েল’ এর, ইয়াগুছ ইয়ামেনের সাবার সন্নিকটে ‘জুরুফ’ নামক স্থানের ‘মুরাদ’ এবং ‘বানী গুতায়েফ’ গোত্রের, ইয়াউক হামদান গোত্রের এবং নাসর হিময়্যার জাতির ‘জুল কিলাআ’ গোত্রের উপাস্য ছিলেন। এই পাঁচটি হলো নুহ আ. এর জাতির নেক লোকদের নাম। যখন এরা মৃত্যুবরণ করলেন তখন শয়তান তাদের ভক্তদেরকে কুমন্ত্রনা দিল যে, তোমারা এদের প্রতিমা বানিয়ে নিজেদের ঘরে ও দোকানে স্থাপন কর। যাতে তারা তোমাদের স্মরণে সর্বদা থাকেন এবং তাদেরকে খেয়ালে রেখে তোমরাও তাদের মতো নেক কাজ করতে পার। প্রতিমা বানিয়ে যারা রেখেছিল তারা যখন মৃত্যু বরণ করেছিল, তখন শয়তান তাদের বংশধরদেরকে এই বলে শিরকে পতিত করল যে, তোমাদের পূর্বপুরুষরা তো এদের পূঁজা করতো যাদের প্রতিমা তোমাদের বাড়ীতে বাড়ীতে স্থাপিত হয়েছে। ফলে তারা এদের পূজা করতে আরম্ভ করে দিল। (বুখারী সূরা নুহের তাফসির পরিচ্ছদ)
[তাফসির আহসানুল বয়ান- 1023 নং পৃষ্ঠার 214 নং টীকা ] [ একই বর্ণনা রয়েছে তাফসিরে তাইসিরুল কুরআনের ব্যাখ্যায়ও, তাফসিরে জালালাইন সপ্তম খন্ড 119 পৃষ্ঠা, তাফসিরে মাজহারি 12 তম খন্ডের 127 তম পৃষ্ঠায় মুর্তিপূজার প্রারম্ভ বা সূচনা এভাবেই বর্ণিত আছে ]


পবিত্র কুরআনের সূরা সাবা (22 তম পারা 34 নং সূরা 13 নং আয়াত ও আলোচনা)

দেখে নেয়া যাক, সূরা সাবার 13 নং আয়াতে কি বলা হয়েছে-
“তারা সুলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী প্রাসাদ, ভাস্কর্য, হাউজ সদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং সুদৃঢ়ভাবে চুল্লির উপর স্থাপিত বৃহদাকার ডেক নির্মাণ করত। হে দাউদ পরিবার কৃতজ্ঞতার সাথে তোমরা কাজ করতে থাক। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই কৃতজ্ঞ।”
বর্ণিত আয়াত হতে কয়েকটি প্রশ্নঃ
1) “তারা” বলতে কাদের বুঝানো হয়েছে?

2) এই আয়াতে “ভাস্কর্য” বলতে কি বুঝানো হয়েছে?

3) কৃতজ্ঞতার সাথে কাজ করা বলতে কি বুঝানো হয়েছে?

উত্তর (1)- “তারা” বলতে জ্বীনদের বুঝানো হয়েছে।

উত্তর (2)- “ভাস্কর্য” (আরবি শব্দ তামাছিলা) কি তার শাব্দিক অর্থ অত্র নিবন্ধের শুরুতে বিভিন্ন অভিধান ও তাফসিরের কিতাব অনুসারে দেয়া হয়েছে।

তথাপিও সূরা সাবার 13 নং আয়াতের আলোকে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা যেতে পারে। এ অংশের আলোচনায় হযরত সুলায়মান আ. এর প্রতি ভাস্কর্য নির্মাণ করার নির্দেশ দেয়া সংক্রান্ত বিভ্রান্তির নিরসন ঘটবে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ধরণ সংক্রান্তে পরিচ্ছন্ন ধারণা লাভ করা যাবে। “কাজ” করার আদেশ দান সংক্রান্ত মতপ্রার্থক্যের শীতল সমাধান বেরিয়ে আসবে।

আসুন দেখি তাফসিরে মাজহারির 9ম খণ্ডে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা কিভাবে করা হয়েছে : -

“ তারা সুলায়মানের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রাসাদ, ভাস্কর্য, হাউজ সদৃশ বৃহদাকার পাত্র, এবং সুদৃঢ়ভাবে স্থাপিত ডেগ নির্মাণ করতো। ”
এখানে মাহারিব অর্থ সুদৃঢ় প্রাসাদ, সুউচ্চ মসজিদ, সুউন্নত বসতবাটি। মাহারিব শব্দটি মিহরাব এর বহুবচন। এর শাব্দিক অর্থ হরব (যুদ্ধ) করা, আক্রমণ প্রতিহত করা, আর সুউচ্চ প্রাসাদও বিরুপ প্রাকৃতিক প্রভাবকে প্রতিহত করে।

বাগবি লিখেছেন বায়তুল মাকদিস মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয় হযরত দাউদের আমলে। যখন মসজিদের প্রাচীর এক মানুষ সমান নির্মাণ করা হল, তখন প্রত্যাদেশ হল, হে দাউদ! তোমার মাধ্যমে এই মসজিদের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হওয়া আমার অভিপ্রায় নয়। তোমার উত্তরসূরী সোলায়মানকে আমি দান করবো নুবওয়ত ও সাম্রাজ্যাধিকার। আর সে-ই সুস্পন্ন করবে এই মসজিদের নির্মাণ। এর কিছুকাল পরেই হযরত দাউদের মহাতিরোভাব ঘটল। তার স্থলাভিষিক্ত হলেন তার প্রিয় পুত্র হযরত সুলায়মান এবং তিনিই সুসম্পন্ন করলেন বায়তুল মাকাদিস মসজিদের নির্মাণ পর্ব। ঐ নির্মাণ পর্বে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন শুভ-অশুভ উভয় প্রকার জ্বীনকে। কয়েকটি দলে বিভক্ত করে দিয়েছিলেন তিনি তাদেরকে। তাদের কাজের প্রকৃতিও ছিল বিভিন্ন রকম। আর মসজিদ নির্মাণে ব্যবহৃত শ্বেতমর্মর পাথরগুলো তিনি তাদেরকে দিয়ে উত্তোলন করিয়েছিলেন খনি থেকে। মসজিদ নির্মাণ ছাড়াও ঐ শ্বেতমর্মরগুলো দিয়ে তিনি নির্মাণ করিয়েছিলেন সুরক্ষিত দুর্গ, নগর-প্রাকার ও অনেক বসতবাটি। বনি ইসরাইলেরা ছিল বারটি গোত্রবিভক্ত। তাদের প্রত্যেক গোত্রের জন্য তিনি জ্বিনদের দ্বারা নির্মাণ করিয়ে নিলেন পৃথক পৃথক সুরক্ষিত নগরি। মসজিদ নির্মাণ করালেন সবার শেষে। জিনদের এক এক উপদলের দায়িত্ব ছিল এক এক রকমের। কেউ খনি থেকে পাথর তুলতে লাগল। কেউ তুলতে লাগল সোনা-রুপা। কেউ সমুদ্রাভ্যন্তর থেকে সংগ্রহ করে আনল মনি-মুক্তা। কেউ আবার আনল মেশক আম্বর ও সুগন্ধি দ্রব্য। এভাবে সবগুলো নির্মাণ সামগ্রী মিলে হয়ে গেল বিশাল স্তুপ। সেগুলো গণনা অথবা পরিমাণ করার সাধ্য কারো ছিল না।

এরপর ডেকে আনা হল স্থপতি ও প্রকৌশলীদেরকে। তারা পাথরগুলোকে করিয়ে নিলো মসৃন ও নির্দিষ্ট পরিমাপের। মনি-মুক্তা দিয়ে অঙ্কন করিয়ে নিল বিভিন্ন রকমের নয়নাভিরাম নকশা। দেয়াল ও মেঝে নির্মাণ করা হলো শ্বেত ও পীতবর্ণ মর্মর প্রস্তর দিয়ে। মেঝেতে বিছিয়ে দেওয়া হল ফিরোজা বর্ণের গালিচা। এভাবে একসময় সমাপ্ত হল নির্মাণ কর্ম। দেখা গেল বায়তুল মাকদিসের মতো চিত্রাকর্ষণ প্রাসাদ তৎকালীন পৃথিবীতে আর একটিও নেই। ঘোর অন্ধকার রাতেও সমসজিদটি সমুদ্ভাসিত হতে লাগল পূর্ণিমার চাঁদের মতো। হযরত সুলায়মান বনী ইসরাইলদের বিদ্বান ও সুধী সমাবেশে ঘোষণা করলেন, আমি এই সুদৃশ্য মসজিদ ভবনটিকে নির্মান করিয়েছি কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যে। এর বাহিরে ও ভিতরের সমস্ত কিছু কেবলমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস বর্ণনা করেছেন, রাসুল স. বলেছেন, বায়তুল মাকদিস নির্মাণ সমাপনের পর নবী সুলায়মান আল্লাহ সকাশে প্রার্থী হয়েছিলেন তিনটি বিষয়ে। আল্লাহ তাকে দান করেছেন দুটি। সম্ভবত তৃতীয়টিও। ওই তিনটি বিষয় হচ্ছে- 1. আল্লাহ যেন দান করেন প্রত্যুতপন্নমতিত্ব, যাতে যে কোন জটিলতার সমাধানে তিনি গ্রহণ করতে পারেন তরিৎ সিদ্ধান্ত। 2. যেনো তার সকল সিদ্ধান্ত হয় আল্লাহর সকল সিদ্ধান্তের পূর্ণ অনুকূল। 3. তাকে যে বিশাল সম্রাজ্য দেওয়া হয়েছে যেন ভবিষ্যতে আর কেউ না পায়। তিনি আরো নিবেদন করেছিলেন হে আমার প্রভুপালক! যে আমার এই মসজিদে দুই রাকাত নামায পাঠ করবে তাকে তুমি নিষ্পাপ করে দিয়ো সদ্যজাত শিশুর মতো। আমি আশা করি আল্লাহ তার এই নিবেদনটিও কবুল করে নিয়েছেন। বাগবী।

হযরত আনাস ইবনে মালেক বর্ণনা করেছেন, রাসুল স. বলেছেন, স্বগৃহে পঠিত নামাযের পূন্য একগুণ। সাধারণ মসজিদে পঠিত নামাযের পূণ্য পঁচিশ গুণ, জামে মসজিদে পাঁচশ গুণ। মসজিদে আকসায় এক হাজার গুণ, আমার এই মসজিদে পঞ্চাশ হাজার গুণ এবং কাবা গৃহে এক লক্ষ গুণ। - ইবনে মাজা।

হযরত আবু সাইদ খুদরী বর্ণনা করেছেন, রাসুল স. আজ্ঞা করেছেন- তিনটি মসজিদ ব্যতীত তোমাদের বাহন অন্য কোন স্থানে বেঁধো না- মসজিদে হারাম, মসজিদে আকসা ও আমার মসজিদ।

সমাধান ঃ সোনা, রুপা ইত্যাদি দ্বারা মসজিদ অলংকৃত করা যায় কিনা সেই সম্পর্কে বিদ্বানগণের মধ্যে রয়েছে মতপৃথকতা। কেউ কেউ বলেছেন, এরকম করা মাকরুহ। কারণ এতে করে সম্পদের অবচয় হয়। রসুল স.ও এরকম করার অনুমতি দেননি। তার পিতৃব্যপুত্র হযরত ইবনে আব্বাসও একবার আজ্ঞা করেছিলেন, তোমরা মসজিদকে কখনো অতি অলংকৃত করো না, যেমন করে থাকে ইহুদী ও খৃষ্টানেরা।

আবার কোন কোন বিদ্বজ্জন বলেছেন, মসজিদ অলংকরণ পূণ্যের কাজ। কারণ এতে প্রকাশ পায় মসজিদেরই মাহাত্ব্য। হযরত সুলায়মানের আমল এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ‘হেদায়া’ রচয়িতা লিখেছেন, কেউ যদি তার নিজস্ব সম্পদ দ্বারা মসজিদকে সৈন্দর্যমন্ডিত করে, তবে তা হবে সিদ্ধ। কিন্তু মসজিদের তত্বাবধায়কের পক্ষে এরকম করা সিদ্ধ নয়। তিনি ব্যায় করতে পারবেন কেবল মসজিদের জরুরী নির্মাণ কর্মের জন্য। নকশা ইত্যাদি করা তার জন্য সিদ্ধ নয়। যদি কোন তত্বাবধায়ক এরকম কিছু করেই ফেলে, তবে তাকে ক্ষতিপূরণ করতে হবে তার নিজস্ব সম্পদ দিয়ে। ইবনে হুম্মাম বলেছেন, মসজিদ অলংকরনের চেয়ে দুস্থ জনতাকে সাহায্য করা অধিক উত্তম। কিন্তু অধিকাংশ বিদ্বজ্জন বলেন, মসজিদে রংবেরংয়ের নকশা আঁকা, কাঠ অথবা চুন-সুড়কির মসলার দ্বারা চিত্রিত করা, সোনা-পানির ব্যবহার ইত্যাদি জায়েজ। এতে কোন অসুবিধা নেই। অর্থাৎ এতে কোন পাপ-পুন্য কোনটাই নেই।

ইবনে হুম্মাম বলেছেন, মসজিদ সুসজ্জিত করা হল। সুচিত্রিত হল মসজিদ গাত্র, মিহরাব। অথচ সে মসজিদে নামায নিয়মিত হল না। অথবা সেখানে আসা যাওয়া করে মুষ্টিমেয় নামাজী। কখনো উঠে শোরগোল। লোকেরা সেখানে লিপ্ত হয় দুনিয়াবী কথাবার্তায়, মনে হয় যেন কারো গৃহের বৈঠকখানা। এরকম অবস্থায় সুচিত্রিত মসজিদ নির্মাণ অবশ্যই মাকরুহ।

হযরত সুলায়মানের ঘটনার প্রেক্ষিতে রাসুল স. এর হাদিসকে বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। কারণ অতিতকালের নবী রাসুলগণের দ্বারা প্রবর্তিত প্রথা আমাদের উপরেও প্রযোজ্য, যদি না তার বিপরীতে আমাদের শরিয়াতে কিছু বলা থাকে। উল্লেখ্য, হযরত সুলায়মানের সময়ের মানুষের মন-মানসিকতা ও সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের সময়ের পরিবেশ ও পরিস্থিতি তুলনীয় নয়। হযরত সোলায়মান ছিলেন দুর্দান্ত প্রতাপশালী নৃপতি। তাই সম্রাজ্যের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে গিয়ে তাকে বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিতে হতো। যেমন- তার প্রজাদের মধ্যে জ্বিনেরা ছিল দুর্বিনীত, সতত চঞ্চল। অবকাশ পেলেই তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করত। তাই তাদেরকে সব সময় রাখতে হতো কাজ দিয়ে। হযরত সুলায়মান তাই তাদেরকে সারাক্ষণ লাগিয়ে রাখতেন প্রাসাদ নির্মাণ, অলংকরন ও অন্যান্য কাজে। রাসুল স. কে এরকম বিব্রত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি। তার উম্মতও এসকল কিছু হতে মুক্ত। তাই হযরত সুলায়মানের সময় যা জায়েজ রাসুল স. এর সময় তা নিরর্থক। ঐতিহাসিকেরা বলেন, বখতে নসরের আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত বায়তুল মাকদিসের নির্মাণশৈলী ও অলংকরণ ছিল অটুট। সে তার দুর্ধর্ষ বাহিনীকে দিয়ে ধুলিসাৎ করে দিয়েছিল বনি ইসরাইলের প্রাসাদ, দুর্গ, নগরপ্রাকার ও অন্যান্য স্থাপনা। মসজিদ ও ধ্বংস করেছিল সে। খুলে নিয়ে গিয়েছিল মসজিদের মূল্যবান পাথর ও অন্যান্য সামগ্রী।

‘তামছিল’ এর বহুবচন ‘তামাছিল’ এর অর্থ ভাস্কর্য, মুর্তি, বিগ্রহ, প্রতিমা। আর এখানে ভাস্কয্য বলে বুঝানো হয়েছে পিতল, তামা, সিসা ও মর্মরপ্রস্তর নির্মিত মুর্তিকে। উল্লেখ্য জ্বিনেরা হযরত সুলাময়মানের উদ্দেশ্যে ইয়েমেনে নির্মাণ করেছিল এক বিস্ময়কর স্থাপত্য। এক বর্ণনায় এসেছে হযরত সুলায়মান জ্বিনদের দ্বারা নির্মাণ করাতেন সাধারণতঃ পশুপাখিদের মুর্তি। মসজিদের মধ্যেও তিনি অংকন করিয়েছিলেন ফেরেশতা মন্ডলী, নবী-রসুল ও খ্যাত নামা মনিষীগণের চিত্র। উদ্দেশ্য ছিল ঐ সকল পূণ্যবানগণের স্মৃতি যেন মানুষের অন্তরে জাগ্রত হয় এবং মানুষ যেন তাদের প্রভাবে অনুপ্রাণিত হয় আল্লাহর ইবাদাতে। (তাফসির মাজহারি, নবম খন্ড)

আরো জানি জ্বিনদের কাজ সম্পর্কে :


সুরা সাবার 13 নং আয়াতে কিছু কাজের বিবরণ দেয়া হয়েছে যেগুলো সোলায়মান আ. জ্বিনদের দ্বারা করাতেন। উক্ত আয়াতের ‘মাহারিবা’ শব্দটি ‘মাহরাবুন’- এর বহুবচন। অর্থ গৃহের শ্রেষ্ঠ ও উচ্চ অংশ। বাদশাহ অথবা বড় লোকেরা নিজেদের জন্য যে সরকারি বাসভবন নির্মাণ করে, তাকেও মেহরাব বলা হয়। এ শব্দটি “হারাবা” থেকে উদ্ভুত। অর্থ যুদ্ধ। এ ধরণের বাসভবনকে সাধারণত অপরের নাগাল থেকে সংরক্ষিত রাখা হয় এবং এর জন্য প্রয়োজন হলে যুদ্ধ করা হয়। এর সাথে মিল রেখে গৃহের বিশেষ অংশকে মেহরাব বলা হয়। মসজিদে ইমামের দাঁড়াবার জায়গাকেও এই সাতন্ত্র্যের কারণেই মাহরাবুন বলা হয়। কখনো মসজিদ অর্থেই ‘মাহারিব’ শব্দ ব্যবহার হয়। প্রাচীন কালে “মাহারিবা বনি ইসরাঈল” এবং ইসলাম যুগে “মাহারিবা সাহাবা” বলে তাদের মসজিদ বোঝানো হতো।

“তামাছিলা” শব্দটি “তামাছাল” এর বহুবচন। অর্থ চিত্র বিগ্রহ ইবনে আরাবি আহকামুল কোরআনে বলেন, চিত্র দু’প্রকারের হয়ে থাকে- প্রাণীদের চিত্র ও অপ্রাণীদের চিত্র। অপ্রাণীও দু’প্রকার- (এক) জড়প্রদার্থ, যাতে হ্রাস বৃদ্ধি হয় না; যেমন পাথর, মৃত্তিকা ইত্যাদি। (দুই) হ্রাসবৃদ্ধি হয় এমন পদার্থ; যেমন-বৃক্ষ, ফসল ইত্যাদি। জ্বিনরা হযরত সুলায়মান আ. এর জন্য উপরোক্ত সর্বপ্রকারের বস্তুর চিত্র নির্মাণ করত। প্রথমত “তামাছিলা” শব্দের ব্যাপক ব্যবহার থেকে একথা জানা যায়। দ্বিতীয়তঃ ঐতিহাসিক বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, সোলায়মান আ. এর সিংহাসনের উপর পাখিদের চিত্র অংকিত ছিল। (তাফসির মাআরেফুল ক্বোরআন- সংক্ষিপ্ত-1105-1106 পৃষ্ঠা)

“মাহরিবা” শব্দটি “মাহরাবুন” এর বহুবচন। অর্থ হলো উঁচু জায়গা অথবা সুন্দর অট্টালিকা, উদ্দেশ্য উঁচু উঁচু অট্টালিকা, বিশাল বিশাল বাসভবন বা মসজিদ ও উপাসনালয়। “তামাছিলা” শব্দটি “তামাছিলুন” এর বহুবচন অর্থ প্রতিমা, মুর্তি। এ মূর্তি অপ্রাণীর হতো। অনেকে বলেন, পূর্ববর্তী আম্বিয়া ও নেক লোকদের মূর্তি মসজিদে নির্মাণ করা হতো যাতে তা দেখে মানুষ আল্লাহর ইবাদত করে। তবে এ অর্থ ঐ সময় নেওয়া সঠিক হবে, যখন এটা মেনে নেওয়া যাবে যে, সুলায়মান আ. এর শরিয়াতে মুর্তি নির্মাণ বৈধ ছিল। আর একথা সঠিক নয়। পক্ষান্তরে ইসলাম র্মুর্তি নির্মাণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করে দিয়েছে। “জিফানুন” শব্দটি “জাফনাতুন” এর বহুবচন অর্থ বিরাট পাত্র, “জায়াবিন” শব্দটি “জায়াতুন” এর বহুবচন অর্থ হউজ, ছোট চৌবাচ্চা যাতে পানি জমা রাখা হয়। অর্থাৎ চৌবাচ্চার মত বড় বড় পাত্র “ক্বুদওয়ারুন” ডেগ “রাসিয়্যাতুন” অর্থ স্বস্থানে স্থাপিত। বলা হয় যে, এই সকল ডেগ পাথর খোদাই করে নির্মাণ করা হত স্থানান্তর করার যোগ্য ছিল না। যাতে এক সাথে এক হাজার মানুষের খাবার রান্না হত। আর এসকল কাজ জ্বিনরা করত। (তাফসির আহসানুল বয়ান-748 পৃষ্ঠার 93 নং টীকা বা ব্যাখ্যা)

হযরত সোলায়মানের অনুগত হিসাবে তারা এসব কাজ করতো।তার জন্য ইচ্ছামত বড় বড় উপাসনালয়, মূর্তি, চৌবাচ্চার মতো বড়বড় পাত্র ও বড়বড় ডেগসমূহ নির্মাণ করত।“মাহারিব” অর্থ এবাদতের স্থান। আর তামাছিল দ্বারা বুঝানো হয়েছে তামা কিংবা কাঠের তৈরী মুর্তি বা ভাস্কর্য। “জাওয়াব” জাবিরার বহুবচন। এর অর্থ পানি সংরক্ষেণের চৌবাচ্চা। জ্বিনেরা হযরত সোলায়মান আ. এর জন্য চৌবাচ্চা সদৃশ বড় বড় খাবারের পাত্র বানাত। তারা রান্না করার জন্য যেসব ডেগ বানাতো সেগুলো এতা বড় ছিল যে, সেগুলোর একাংশ পুতে রাখা হত।

এসব হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক অনুগত বানানো জ্বিনেরা হযরত সোলায়মানের জন্য যেসব কাজ করত তার কিছু নমুনা। এগুলোর সবই মুযেযা ও অলৌকিক ঘটনা এবং আল্লাহ তায়ালারই করা। এর একমাত্র ব্যাখ্যা সম্ভবত এটাই। অন্য কোন ব্যাখ্যা দেয়ার কোনই উপায় নেই।

এ বর্ণনার শেষভাগে হযরত দাউদের বংশধরকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, ‘ হে দাউদের বংশধর তোমরা শোকরের কাজ কর।’ অর্থাৎ আমি দাউদ ও সোলায়মানের মাধ্যমে এতো কিছুকে তোমাদের আয়ত্তাধীন করে দিলাম। কাজেই হে দাউদের বংশধর। তোমরা অংহকার ও দাম্ভিকতা দেখানোর জন্য নয় বরং আল্লাহ তায়ালার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য কাজ কর। বস্তুত সৎ কাজ হচ্ছে আল্লাহর বিরাট কৃতজ্ঞতা। (তাফসির ফি জিলালিল কুরআন-16 তম খণ্ড- পৃষ্ঠা-224)


শোকরের কাজ করার বিষয়ে অর্থাৎ মহান আল্লাহর এতো নেয়ামত ভোগ করার পরে দাউদ আ. এর বংশধর কর্তৃক আল্লাহর শোকরগুজারির নমুনা বর্ণিত হয়েছে কিতাবাদিতে। যেমন-
হযরত দাউদ আ. ও সোলায়মান আ. এবং তাদের পরিবারবর্গ মৌখিকভাবে ও কর্মের মাধ্যমে এই আদেশ পালন করেছেন। তাদের গৃহে এমন কোন মুহুর্ত যেত না যাতে ঘরের কেউ না কেউ্ এবাদতে মশগুল না থাকত। পরিবারের লোকজনকে সময় ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। ফলে দাউদ আ. এর জায়নামায কোন সময় নামাযী শুন্য থাকতো না। (ইবনে কাসির)
বুখারী ও মুসলিমের এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ স. বলেন- আল্লাহ তায়ালার কাছে হযরত দাউদ আ. এর নামায অধিক প্রিয়। তিনি অর্ধ রাত্রি ঘুমাতেন, অতঃপর রাতের এক তৃতিয়াংশ এবাদতে দন্ডায়মা্ন থাকতেন এবং শেষের এক ষষ্ঠাংশে ঘুমাতেন। আল্লাহ তায়ালার কাছে হযরত দাউদ আ. এর রোযাই অধিক প্রিয়। তিনি একদিন অন্তর অন্তর রোযা রাখতেন। (ইবনে কাসির) [তফসির মাআরেফুল কুরআন- (সংক্ষিপ্ত- পৃষ্ঠা নং-1106)]


[ পরিশেষে বলব উপরের আলোচনায় প্রত্যেক হৃদয় গভীরে সমকালীন ইস্যু নিয়ে তৈরী হওয়া সমস্যা ও এসংক্রান্ত প্রশ্নের সঠিক সমাধান উঠে এসেছে বলে মনে করছি। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে সহিহ সমযদার করুন। আমিন।]

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২০ সকাল ৮:৪৩
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×