আমি ধরেই নিচ্ছি যে, এই প্রশ্নটি আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। অথবা, দুটো বাক্য লেখার জন্য হলেও তো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের খুব প্রয়োজন পড়ে; অস্বীকার করা যায় না। সত্যি বলতে, আপত্তি থাকার প্রয়োজন নেই তো। আমাদের মধ্যে অনেকেই হিন্দি বোঝেন, কেউ কেউ তো বলতেও পারেন। সুতরাং একটি সিনেমা (যা কিনা হিন্দি ভাষার) বাংলাদেশে মুক্তি পেলে কি এসে যায়!
অনেকেই ইতিমধ্যে অনলাইনে ‘পাঠান’ সিনেমার পাইরেটেড কপি নিশ্চয় পেয়ে গেছেন বলে অন্তত আমার ধারণা। সেখান থেকে কিছু কিছু অংশ কেটে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দিচ্ছেন কিছু লাইক, ভিউয়ার পাওয়ার আশায়। আমি পারলে হয়তো আমিও সেটাই করতাম। মানে মন্দটা কি? লোকজন তো দেখছে!
রাতদিন এক করে আমরা বাঙালীরা ‘পাঠান’ সিনেমার রিভিউ লিখছি যাতে কিছু পাঠক পাওয়া যায়। এই লোভ তো আমার মাঝে প্রবল। কিন্তু লেখাটা কিন্তু হিন্দি তে লিখছি না। হয় বাংলায়, নয়তো ইংরেজিতে। এখন এই ইংরেজিতে লেখার দরুণ ‘Colonized Mindset’ বলে আমায়/আমাদের গালি-ও দিতে পারেন কিন্তু বাংলার চেয়ে ইংরেজিতে আয় বেশি হচ্ছে। সুতরাং গালিটা বোধহয় হজম করা যায়। অথবা, এই যে আমরা ইংরেজি ভাষা শিখছি তার একটা অনুশীলন হয়ে যাচ্ছে বলে পার পাওয়া যেতেও পারে।
কিন্তু একটি মজার বিষয় লক্ষ্য করেছেন? ‘পাঠান’ সিনেমা যথাক্রমে তামিল, তেলেগু ভাষায় ড্যাবিং করা হলেও বাংলায় করা হয়নি। অথচ পশ্চিমবঙ্গে তো মুক্তি পেয়েছে! তাহলে? এর উত্তর হলো, বাঙালীরা এখন হিন্দি জানেন এবং যেহেতু তিনি হিন্দি জানেন সেহেতু তিনি উর্দুও জানেন। কারণ এই দুই ভাষার ‘মা’ কিন্তু একজন।
উর্দু-হিন্দি দুটি ভাষাই ইন্দো-ইরোনীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তভুক্ত। দুটি ভাষাই সংস্কৃতির অপভ্রংশ খাড়িবুলি থেকে উৎপন্ন হিন্দুস্তানি ভাষার দুটি ভিন্ন লিখিত রূপ। হিন্দুস্তানি ভাষা ফারসি প্রভাবিত আরবি হরফে লিখলে তা উর্দু। আর হিন্দুস্তানি ভাষা দেবনাগরি লিপিতে লিখলে তা হিন্দি। উর্দু ভাষা আরবি-ফারসি শব্দবহুল আর হিন্দি ভাষা সংস্কৃত শব্দ বহুল। ভাষাগোষ্ঠী হিসেবে হিন্দি-উর্দু কে একই ভাষা হিসেবে গণ্য করা হয় এবং হিন্দি-উর্দুর ভাষাগত বিভাজনটি কৃত্রিম।
ব্যাপারটা পরিষ্কার তো? আরো বিশাল ইতিহাস জোর করে লেখার বা জানাবার অন্তত আজ আমার কোন ইচ্ছে নেই। দৈনিক যুগান্তরে জয়া ফারহানা ‘হিন্দি ফিল্ম বোঝেন, উর্দু শেরও তবে বাংলা বোঝেন না’ শিরোনামে একটি ঝরঝরে লেখা উপহার দিয়েছেন। একটু গুগল সার্চ দিতে হবে এই যা!
ভাষা নিয়ে এই দ্বন্দ্ব কেয়ামত পর্যন্ত শেষ না হলেও, বাংলা ভাষা কে বাঁচানোর এই যে এত আপ্রাণ চেষ্টা কেন? সব জায়গায় বাংলা ভাষার উপস্থিতি থাকতেই হবে কেন? একটু হিন্দি, একটু উর্দু আর একটু বাংলা থাকলে সমস্যা কোথায়? অনেকটা বর্তমান সময়ের রিমিক্স গানগুলোর মত শোনাবে। মজা না?
চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (ওপার বাংলায়) এক বক্তিতায় বলছেন, মা বলছে, সবাই খেতে এসো। খাবার লাগিয়ে দিয়েছি…। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কোথায় লাগালে? কার গালে? কার টেবিলে?
বাংলা ভাষার নতুন নতুন শব্দ গ্রহণ করার ক্ষমতা অনেক বেশি। এই পরিবর্তন যুগ যুগ ধরে আবর্তিত হয়ে আজ এইখানে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু পরিবর্তন মানেই বিভৎসভাবে পরিমার্জন বা পরিবর্ধন করা উচিত নয়/গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মনে রাখবেন, এই ভাষা-ভাষা করে আমাদের একটি বায়ান্ন পর্যন্ত আছে। আজ সেটা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
হ্যাঁ, ইংরেজি ভাষার মত করে আমাদের বাংলাটা এখনো শিল্পে পরিণত হতে পারেনি। কিন্তু বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার মত দলও তো সৌদি আরবের মত দলের কাছে হেরে নাকানি-চুবানি খেয়েছিলো। ভারতের দুর্দান্ত ক্রিকেট টিম বাংলাদেশের ক্রিকেট টিমের কাছে এক দিনের ম্যাচে প্রায় ‘হোয়াইট ওয়াশ’ হতে চলেছিলো। ওটাকে অবশ্য আমরা ‘বাংলা ওয়াশ’ বলে থাকি।
সুতরাং এখনো আমরা সবাই চুপ করেই আছি, ‘কলম যুদ্ধ’ শুরু হয় নি। আমরা তার প্রয়োজনও বোধ করছি না। আমি ঠুনকো হলেও ‘Snowball Effect’ থেকে রক্ষা পেলেই হলো। তারপর ‘পাঠান’ অথবা ‘পাঠা’ যা ইচ্ছে আমদানি করুন। ধন্যবাদ
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:০৮