যদিও আমি ধরে নিতে পারিনা যে, আমি যে হলের কথা বলব সবাই সে হলেই উঠবে, তবু যদি কিছু মিল পান তো মন্দ কিসে?
'ভার্সিটিতে পড়বি, আর হলে উঠবি না!' আমার এক বড় ভাইয়ের উক্তি। তো মিশন শুরু করেছিলাম প্রথম বর্ষ থেকেই। একদিন পরিদর্শনে গেলাম। আপনারা যারা গণরুম চেনেন তারা তো জানেনই, আমিও সেদিন জানলাম এবং দ্বিতীয়বার চিন্তা না করে মিশন এক বছরের জন্য স্থগিত ঘোষনা করলাম। দ্বিতীয় বর্ষে আসার পর আমার এক ক্লাসমেট যে প্রথম বর্ষেই হলে উঠেছে সে বলল, এই বেলা উঠে পর। বেশীদিন গণরুমে থাকতে হবেনা, তাড়াতাড়ি রুম পাবি।
শুরু করলাম ঘুরঘুর করা। আস্তে আস্তে জানলাম, হলে উঠতে হলে সব পলিটিক্যাল ভাইদের নাম মুখস্ত করতে হবে। তাদের নামের লিস্ট নিয়ে একটি শীট গণরুমের ছেলেদের কাছে থাকে। আমিও একটি 'আউটডেটেড' লিস্ট জোগাড় করলাম। 'আউটডেটেড' মানে হচ্ছে, এখানে নামের পাশে যে রুম নাম্বার লেখা আছে তা বর্তমানে পরিবর্তিত।সেটাতেই কয়েকদিন চোখ বুলালাম। সারাদিন ক্লাশ করতাম, সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন ভাবে সময় কাটিয়ে রাত ১০:০০ ঘটিকার পর নামতাম পরিচিতি অভিযানে। কারন ১০ টার আগে কোন ভাইকেই রুমে পাওয়া যায়না। এভাবে ১২ টা বেজে যেত। তখন আর ৩০ টাকা ভাড়ার দুরত্বের বাসায় যাওয়া সম্ভব হতোনা। থাকতাম কোন বন্ধুর মেসে। এভাবে একদিন ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো, জেলার এক ভাইয়ের সাথে পরিচয় হলো। তিনি আমাদের ইমেডিয়েট সিনিয়র এক ভাইকে বললেন, 'এই ছেলেটাকে তুলে দে তো..'।
এভাবে উঠে পড়লাম গণরুমে। যেখানে এমনকি নিজের তোষক তো দুরের কথা, ব্যাগ রাখার জায়গা পাওয়াও দুষ্কর। ঘুমানোর জন্য অপেক্ষা করতে হতো, কখন অন্যরা সবাই ঘুমাবে। সবাই ঘুমানোর পর খেয়াল করতাম কোন লাইনে একটু জায়গা ফাকা আছে। গণরুমে যেহেতু ঢালাও ফ্লোরিং, মাঝে মাঝে জায়গা পেতাম, কখনো কখনো পেতাম না। চলে যেতাম রিডিং রুমে, কয়েকটা চেয়ার একত্র করে শুয়ে পড়তাম। কপাল যদি খুব খারাপ থাকত, সেদিনই গণরুমে শোবার জায়গা পেতাম। আর সারারাত ছাড়পোকা তাদের কামড়ের ধার পরীক্ষা করত শরীরের বিভিন্ন স্থানে কামড়িয়ে। তখন আর মনে হতোনা দোজখ এর চেয়ে খারাপ কিছু হতে পারে। মনে মনে সান্ত্বনা পেতাম এই ভেবে যে, যেহেতু ছাড়পোকা গুলো এই রুমে আমার চেয়ে 'সিনিয়র' তাই তাদের দাবড়ানি একটু সহ্য করতেই হবে।
এরপর আসে গেস্টরুম প্রসঙ্গ। গেস্টরুম হচ্ছে সিনিয়র ভাইদের কর্তৃক জুনিয়রদের ডেকে নিয়ে 'সুবিধা অসুবিধা' আলোচনা করা,(মতান্তরে ঝাড়ি দেয়া)। দ্বিতীয় বর্ষে বলে যদিও গেস্টরুম কম হতো, তবুও যেদিন থাকত সেদিন আমার গলা শুকিয়ে প্রায় মরুভূমি হয়ে যেত। সেখানে উপস্থিত প্রত্যেক বড় ভাইয়ের নাম বলতে হবে এবং না বলতে পারলে যথারীতি 'ঝাড়ি'। আমার স্মরণশক্তি, বিশেষ করে নাম মনে রাখার ব্যাপারে বিশ্ববিখ্যাত, ফলে যা হবার তাই হতো। যদি রাস্তা দিয়ে সিনিয়র যাবার সময় সালাম দিতে ভূল হতো, 'প্রোগ্রাম' এ না যেতাম তখনও কপালে এই থাকত।
'প্রোগ্রাম' ব্যাপারটা এখানে কম্পিউটার ল্যাঙ্গুয়েজ না। এটা হচ্ছে বিভিন্ন পলিটিক্যাল উপলক্ষে মিছিল। এখানেও স্লোগান আস্তে দিলে বা শুধু ঠোট মেলালে 'ঝাড়ি'। শুধুমাত্র পরীক্ষা ব্যতীত অন্য কোন কারণে এটা বাদ দেয়া যাবেনা।
এইসব নিয়েই আপাতত হলে আছি। সবার দোয়া চাই যাতে ছাড়পোকাটা অন্তত একটু কমে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




