ঢাকার মিরপুরের কালশী থাকতেন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান। মাস ছয়েক আগে তিনি ওই ব্যাংকের মোহাম্মদপুর শাখা থেকে মতিঝিল শাখায় বদলি হয়েছেন। এরার তিনি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানাধীন মাহমুদপুর এলাকায় বাসা নিয়েছেন। ঢাকা ছেড়ে নারায়ণগঞ্জ আসার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে আনিসুর রহমান বলেন, উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে যে সময় লাগে, যাত্রাবাড়ীতে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার হওয়ার পর মাহমুদপুর থেকে তাঁর চেয়ে কম সময় লাগে। তা ছাড়া বসবাসের খরচ তুলনামূলকভাবে কম। এ কারণেই ঢাকা ছেড়ে মাহমুদপুরে এসেছেন। শুধু আনিসই নন। তাঁর মতো হাজারো মানুষ শনির আখড়া, রায়েরবাগ, মাতুয়াইল, সাইনবোর্ড, সানারপাড় ও নারায়ণগঞ্জে নতুন করে বাসা ভাড়া নিচ্ছেন। চাহিদা বাড়ছে শনির আখড়া ও এর আশপাশের এলাকার। কারণ যাত্রাবাড়ীতে ফ্লাইওভার নির্মাণের পর যাতায়াতে সময় কম লাগছে। আর এ জন্য লোকজন এসব এলাকায় আসছে বলে স্থানীয় ও ভাড়াটিয়ারা জানিয়েছেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, নতুন করে ওই এলাকাগুলোতে আবাসিক ভবন নির্মিত হচ্ছে। প্রধান সড়ক থেকে কয়েক কিলোমিটার ভেতরেও পাঁচ-সাততলা ভবন ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে ও উঠছে। এলাকাগুলোতে দ্রুত বাড়ছে জনসংখ্যার ঘনত্ব। তবে সেখানে ভালো স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল না থাকার অভিযোগ রয়েছে।
রাজধানীর শনির আখড়ায় প্রায় ১২ বছর ধরে বাস করছেন মো. আবুল কাশেম। তিনি জানান, গত দু বছর ধরেই শনির আখড়ায় বাসা ভাড়া বাড়ছে। এর বড় একটা কারণ ফ্লাইওভার। যাত্রাবাড়ীতে ফ্লাইওভারটি চালু হওয়ার পর এখন শনির আখড়া থেকে সহজেই রাজধানীতে যাওয়া যায়। আগে হয়তো বাসা ভাড়া বছরে যেখানে পাঁচ শ থেকে এক হাজার টাকা করে বাড়ানো হতো, এখন বাড়ছে দেড় থেকে দু হাজার টাকা করে বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু তারপরও বাসা খালি থাকে না, কারণ অনেকেই টাকার চেয়ে সময় বাঁচাতে এখানে আসছেন।
মাতুয়াইলের স্থায়ী বাসিন্দা মো. শহীদুল্লাহ বলেন, আগে ঢাকা যেতে দেড় থেকে দু ঘণ্টা লাগত। ফ্লাইওভারের কারণে সেখানে ১৫ মিনিটে যাওয়া যায়। অনেকেই নতুন করে এসব এলাকায় বাড়ি করছেন। অনেক জায়গা যেটি দু-তিন বছরে আগেও বিল ছিল, এখন সেখানে বড় বড় ভবন নির্মিত হচ্ছে। আবার তাঁরা ভাড়াও পাচ্ছেন। ভালো কোনো শিক্ষা-চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকার পরও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এখানে থাকতে আসছেন।শহীদুল্লার অভিযোগ, ফ্লাইওভারটি হওয়ার কারণে যাতায়েত ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। কিন্তু মাতুয়াইলের ভেতরে রাস্তাগুলো ভালো না হওয়ায় এখনো যাতায়াতে সমস্যা রয়েছে। সেগুলোর অবস্থা ভালো হলে আরও বেশি লোকজন এ এলাকায় আসবে।
শুরু আবাসিক এলাকাই নয়, অনেক ছোট ছোট ফ্যাক্টরি ও গার্মেন্টসও ওই সব এলাকায় গড়ে উঠছে। সাইনবোর্ড এলাকায় বেল্ট বানিয়ে পাইকারি বিক্রি করেন রবিউল হোসেন। তিনি আগে ঢাকার গোপীবাগে থাকতেন। কিন্তু এ এলাকায় ভাড়া কম হওয়ায় সপরিবারে এখানে এসেছেন। ফ্লাইওভার হওয়ায় ঢাকায় যেতে কম সময় লাগায় ব্যবসার কোনো সমস্যা হচ্ছে না বলেও দাবি করেন তিনি।
সানারপাড়ের নিতাইপুরের কয়েকটি বাড়ির মালিক মো. সাহাবুদ্দিন। তিনি জানান, ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় এখন সানারপাড়ে লোক সমাগম বাড়ছে। অনেকেই এখন ঢাকায় অফিস করলেও এখানে থাকছেন। ঢাকার অন্যান্য স্থানের তুলনায় এ এলাকায় বাসা ভাড়া তুলনামূলকভাবে কম। জনঘনত্ব বাড়ার এটাও একটা বড় কারণ।
সানারপাড় থেকে রাজধানীর ইস্কাটনে নিয়মিত অফিস করেন অপসোনিন ফার্মা লিমিটেডে কর্মরত মো. আল মাসুদ। তিনি বলেন, যাত্রাবাড়ীতে হওয়ার কারণে শনির আখড়া, রায়ের বাগ, সাইনবোর্ড ও সানারপাড় এলাকায় এখন লোক সমাগম বাড়ছে। তবে, চাহিদা বেশি থাকায় অন্যান্য এলাকার তুলনায় ভাড়া বাড়িয়ে নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ফ্লাইওভার হওয়ার পরে বাসা ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। তবে এসব এলাকার বাসা ভাড়া ঢাকার তুলনায় এখনো কম বলেও জানান তিনি।
নিজের ভবনটিকে দেখিয়ে রহমতপুরের মো. কামাল হোসেন মিয়া নামের এক বাড়ির মালিক বলেন, দু বছর আগেও এখানে একটি মাত্র ফ্ল্যাট বাড়ি ছিল, এখন ছয়টি ফ্ল্যাট বাড়ি হয়েছে।
ফ্লাইওভার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আবার জমির দামও বেড়েছে ওই সব এলাকায়। তিন চার বছর আগে যেগুলো বিল বা খেত ছিল, সেগুলোতে গড়ে উঠছে ছোট-বড় পাকা ভবন। ফ্লাইওভার কাজ শুরুর সঙ্গে সানারপাড়ের কান্দাপাড়া এলাকার জমির দাম পরিবর্তনের চিত্রটি এভাবেই তুলে ধরলেন ওই এলাকায় ৩০ বছরের বাসিন্দা মো. মোতালিব চৌধুরী। বললেন, ‘ফ্লাইওভারের কাজ শুরুর আগে যে জায়গার দাম ছিল আট লাখ টাকা, কাজ শুরুর পরই সেটির দাম ১০ লাখ টাকা। কাজ অর্ধেক শেষ হতে সেটির দাম হয় ১৫ লাখ টাকা, ফ্লাইওভারের কাজ শেষ হবার পর সেটির দাম গিয়ে দাঁড়ায় ২০ লাখ টাকায়। আবার জায়গার দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে বাসা ভাড়াও।
ওই এলাকায় জনবসতির বাড়ার সঙ্গে নাগরিক সুবিধা বাড়েনি এমনটা দাবি করে মোতালিব বলেন, এসব এলাকায় এখনো নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তরাই বেশি থাকছেন। ফলে এলাকার অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো কেউ সেভাবে নজর দেয় না। নেই ভালো স্কুল, কলেজ বা চিকিৎসা কেন্দ্র। রয়েছে গ্যাসের সমস্যা। নাগরিক সেবা নিশ্চিতকরণের ব্যাপারগুলোর দিকে কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিত।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক ও নগরবিদ সারোয়ার জাহান বলেন, এ ধরনের ফ্লাইওভারের কারণে মানুষ সহজে রাজধানীতে আসতে ও যেতে পারছে। জনসংখ্যার ঘনত্ব বাড়লে প্রতিটি জিনিসের ওপরই তাঁর চাপ পড়বে এমনটা জানিয়ে সারোয়ার জাহান আরও বলেন, জনসংখ্যা ঘনত্ব দিকটির গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
সূত্র -- প্রথমআলো ডট কম