রমনার মোড়ে বহুক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি। এখন রাত প্রায় সাড়ে বারোটা, মাওলানা সাহেব বলেছেন বারোটায় উপস্থিত থাকতে। উনি লেট করার লোক না, আজকে করছেন। অতি আশ্চর্য ঘটনা।
পুরা রাস্তা শুনশান। ঢাকায় সাধারণত গাড়িঘোড়া সারারাত চলে, আজকে একটা গাড়িও নাই। শহরে কারফিউ নাকি কে জানে? আমি দেশের খবর তেমন একটা রাখি না। এমন থাকাই ভালো, নিরিবিলি। লোকজন দেখলে ইদানীং ভয় ভয় লাগে।
পা ব্যাথা করে আসছে। পৌনে একটা বাজে মাওলানা সাহেবের কোনও খবর নাই। হুজুর কি ভুলে গেলেন নাকি? একবার উঠে ভাবলাম চলে যাই। তারপর আবার বসে পড়লাম। থাক, এখন কাজ নাই তেমন। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি, হুজুরের কোন কারণে হয়তো দেরী হচ্ছে।
হঠাৎ ঝপঝপ করে ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ পেলাম। পেছনে গাছ থেকে একটা প্রমাণ সাইজের হুতুম প্যাঁচা এসে বসল আমার পাশে। মাথাটা নব্বই ডিগ্রী ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি কিছুটা ইতস্ততঃ করে বললাম...
-হুজুর আসছেন?
-বেয়াদব! এমনে কেই বড়দের লগে কথা কয়? সালাম কই?
প্যাঁচাটা মানুষের মতো কথা বলে উঠলো। বুঝলাম উনিই মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।
-আসসালামু আলাইকুম হুজুর। গোস্তাকি মাফ হয়। ভাবছিলাম আপনিই কিনা...তাই। হুজুর রাস্তায় অসুবিধা হয়েছে কি?
-না অসুবিধা হয় নাই। আমি সময়মত এসেছি। গাছের ডালে বসেছিলাম। তোমার পরীক্ষা নিতেছিলাম। দেখলাম চলে যাও নাই। তুমি পরীক্ষায় পাস। তোমাকে উপদেশ দেওয়া যায়।
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। না যেয়ে ভালো করেছি। নাইলে মহা কেলেঙ্কারি হতো।
-হুজুর আপনার নির্দেশনা পাওয়ার যোগ্যতা আমার নাই। আমি খুবই আনন্দিত। আপনার আদেশ আমার শিরোধার্য।
-তেলামি বাদ দাও মিয়া। তেলামি দেশটারে খাইলো। তোমার অসুখের কি অবস্থা। মাথার ডাক্তারের দেয়া ওষুধ খাও রেগুলার?
-জ্বি হুজুর।
-মাশা আল্লাহ। কাজ হয় ঠিকমতো?
-জ্বি না হুজুর। কাজে দিলে আপনাকে দেখতাম কিভাবে?
-যুক্তির কথা বলেছে। এটা ভাবি নাই। বাদ দাও, আসল কথায় আসো। দেশে রাজনীতির খবর কি?
-হুজুর অবস্থা খুবই ভালো। কোথাও কোন সমস্যা নাই। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে খেলা চলছে, হাফটাইম পর্যন্ত খেলার স্কোর ১-১।
-আলহামদুলিল্লাহ, তোমার খবর কি? এইবার ভোট দিবা?
-ছি ছি হুজুর। কি বলেন। তবা তবা। আমি যুবক মানুষ। আমার ফেসবুকে লেখা "আই হেইট পলিটিক্স"। ভোটের দিন শিশুপার্ক ঘুরতে যাব সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রাজনীতি বড়দের ব্যাপার। এগুলায় আমরা ছাত্ররা নাক গলাবো কেন?
হুজুর গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণের নিরবতা। মাওলানা সাহেব বুঝতে পেরেছেন ব্যাপারটা। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললেন...
-দেশের অবস্থা কি খুবই খারাপ?
-জ্বি হুজুর।
-আর তোমরা বলতেছো তোমরা ছাত্ররা নাক গলাবা কেন?
আমি চুপ করে রইলাম। কিছু একটা বলতে গিয়েও বললাম না।
-তোমাদের মতো থাকতে অসহযোগ আন্দোলনে দশমাস জেল খাটছিলাম। আর তোমরা ভোটেই যাও না। বাহ! তোমাদের এগুলা বইলা লাভ নাই...কাগমারীতে পাকিস্তানীদের কইছিলাম, "আসসালামু আলাইকুম"। আজ তোমাদের বলতেছি আসসালামু আলাইকুম। আসি...
হুতুম প্যাঁচাটা উড়ে অন্ধকার গাছগুলোর দিকে চলে গেল। আমি সেইদিকে তাকিয়ে থাকলাম। অন্ধকার জমাট বেঁধেছে। খুব গাঢ় সেই অন্ধকার।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:৩৯