somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দিনে মিছিলকারী, রাতে বিচারপতি!

২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক. শেষ পর্যন্ত বোমাটা ফাটালেন স্বয়ং প্রধান বিচারপতি মহোদয় নিজেই। পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিলেন, অবসরের পর বিচারপতিদের লেখা রায় বেআইনি ও সংবিধান পরিপন্থী। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংকটের মূল কারণ যেহেতুে এ স্পর্শকাতর বিষয়টি, তাই মাননীয় প্রধান বিচারপতির এ মন্তব্য শুধু এসব রায়ের বৈধতাই নয় বরং তা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী, দশম পার্লামেন্ট ও বর্তমান সরকারের বৈধতাকেও প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে।

ණ☛ বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি (ত্রয়োদশ সংশোধনী) বাতিলের রায় লেখা হয়েছিল অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের অবসর গ্রহণের দীর্ঘ ১৬ মাস পর। তাই এতদিন পর মাননীয় প্রধান বিচারপতির এ মন্তব্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের বৈধতাকে বড় ধরনের আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে নিঃসন্দেহে।

ණ☛ বিচারকদের অবসরের পর লিখিত রায়গুলো বেআইনি ও সংবিধান পরিপন্থী হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের রায়সহ সংবিধানের ৫ম ও ৭ম সংশোধনী বাতিলের রায়গুলোও কী তাহলে বেআইনি ও সংবিধান পরিপন্থী বলে অবৈধ বিবেচিত হবে? অবসরের পর লিখিত জামায়াত নেতা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়সহ ফাঁসির রায়গুলোও কী বেআইনি ও সংবিধান পরিপন্থী বলে অবৈধ বিবেচিত হবে? বিচারপতিরা সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের শপথ গ্রহণ করেন বিধায় তারা যদি এভাবে সংবিধান পরিপন্থী রায় লেখেন, তাহলে তারাও কি সংবিধান লঙ্ঘনের অপরাধে অভিযুক্ত বলে গণ্য হবেন? আর সুপ্রিম কোর্ট যেহেতু সংবিধানের অভিভাবক।

ණ☛ তাই মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয় তার ওপর অর্পিত সংবিধান সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করবেন কী? এতদিন ধরে এসব বেআইনি ও সংবিধান পরিপন্থী রায়ের জন্য যে এত বড় জাতীয় বিপর্যয়, সহিংসতা, হানাহানি ও সংকটের সৃষ্টি হলো তার দায় দায়িত্বই বা কে নেবে? এতে সবচেয়ে বড় সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে বিচারপতি খায়রুল হকের অবসর গ্রহণের পর লিখিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় অবৈধ বিবেচিত হলে।

ණ☛ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি তখন বৈধ বলে গণ্য হবে। পাশাপাশি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, দশম সংসদ, বর্তমান সরকার, সবই বেআইনি ও অসাংবিধানিক বলে গণ্য হবে। অনিবার্যভাবেই সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে বড় ধরনের বিপর্যয় ও ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়বে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যক্তি।

দুই. মাননীয় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তার মেয়াদের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে লিখিত বিবৃতিতে আরও বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা বাংলাদেশের সংবিধান, আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের শপথ গ্রহণ করেন। কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর তিনি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণ্য হন বিধায় তার গৃহীত শপথও বহাল থাকে না।

ණ☛ আদালতের নথি সরকারি দলিল। একজন বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর আদালতের নথি নিজের নিকট সংরক্ষণ, পর্যালোচনা বা রায় প্রস্তুত করা এবং তাতে দস্তখত করার অধিকার হারান।’ আসলে হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকরা অবসরের পরদিন থেকেই কালো কোর্ট ও গাউন গায়ে জড়িয়ে আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে মামলা করার অধিকার অর্জন করেন। উচ্চ আদালতে এমন অসংখ্য উকিল পাওয়া যাবে যাদের নামের আগে বিচারপতি লেখা আছে।

ණ☛ বিচারপতি টি এইচ খান তাদের মধ্যে একজন উত্কৃষ্ট উদাহরণ। তাই অবসরে যাওয়া বিচারকরা সাংবিধানিক শপথ থেকে মুক্ত হয়ে সভা, সেমিনার, টকশো সবই করেন। আরও মজার বিষয় হচ্ছে অবসর নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেউ কেউ বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিশ্চিহ্নের রাজনৈতিক স্লোগানও দেন। মিছিলে যোগ দিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেত্রীর বাসভবন পর্যন্ত ঘেরাও করেন। অথচ তখনো তার হাতে অসংখ্য মামলার রায় অলিখিত অবস্থায় জমা পড়ে আছে।

ණ☛ দিনে মিছিলকারী আর রাতে বিচারপতি— এটা কোন যুক্তিতে সংগত হতে পারে? আমাদের সংবিধান থেকে শুরু করে বিদ্যমান কোনো আইনেই অবসরের পর রায় লেখার কোনো সুযোগই নেই। অথচ হাইকোর্টের রুলস, আপিল বিভাগের রুলসহ দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধির সব আইনেই স্পষ্টত বলা আছে, সব মামলার রায় প্রকাশ্য আদালতে ঘোষণা করতে হবে এবং প্রকাশ্য আদালতেই রায়ে স্বাক্ষর দিতে হবে।

তিন. ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগের বিভক্ত রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা হয়। আর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয় ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। কিন্তু ততদিনে প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের অবসর গ্রহণের দীর্ঘ ১৬ মাস পার হয়ে যায়।

ණ☛ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোসহ গোটা দেশ যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির দাবিতে উত্তপ্ত ঠিক তখনই তাড়াহুড়ো করে ওই রায়কে ভিত্তি ধরে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এনে মহাজোট সরকার সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে দেয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মূল রায়ে আপিল বিভাগ পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে অভিমত দিলেও বিচারপতি খায়রুল হক অবসর গ্রহণের দীর্ঘ ১৬ মাস পর লিখিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে মূল রায়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব বিষয়কেই সুকৌশলে এড়িয়ে রায় লেখেন।

ණ☛ আর ততদিনে তো এমনিতেই সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়। এর ফলে দলীয় সরকারের অধীনে ৫ জানুয়ারির মতো প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর প্রতিবাদে সারা দেশে হানাহানি ও সংঘাতে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এরই মধ্যে বিচারপতি খায়রুল হক আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পান। এমনিতেই বিচারপতি খায়রুল হকের বেশ কিছু রাজনৈতিক বিবেচনার রায় নিয়ে বিরোধী মহলে অস্বস্তি ছিল। আর এতদিন পর বর্তমান প্রধান বিচারপতির এ কথাটি যেন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বৈধতাকেই সরাসরি প্রমাণে রূপান্তরিত করল।

ණ☛ আর প্রধান বিচারপতির একথা বলার মাধ্যমে খায়রুল হকের রায়ের সাংবিধানিক ভিত্তি ও আইনগত বৈধতা চরমভাবে গ্রহণযোগ্যতা হারায়। খায়রুল হকের রায় যে অবৈধ ছিল তার প্রমাণ স্বয়ং বর্তমান প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের কথাতেই প্রমাণিত হয়ে যায়। নড়েচড়ে উঠে রাজনৈতিক অঙ্গন। সঙ্গে আইন অঙ্গনেও চরম সংকটের জন্ম হয়। তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির যৌক্তিকতা নতুন করে দম ফিরে পায়। দেশের মানুষ তো বটেই, বহির্বিশ্বে সরকার নতুন করে প্রশ্নের মুখে পড়বে।

ණ☛ নিরপেক্ষ ব্যবস্থায় সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়তে হবে সরকারকে। ভবিষ্যৎ সরকারও বড় ধরনের রসদ পেয়ে গেল সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে বর্তমান শাসকদের বিচারের মুখোমুখি করার। আর যারা এতদিন ধরে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার দোহাই দিয়ে দিনকে রাত আর রাতকে দিনে রূপান্তর করে আসছেন তাদের জন্য তো এটা মহাবিপদ।

চার. গত বছরের ২১ অক্টোবর সদ্য অবসরে যাওয়া আপিল বিভাগের বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক লন্ডনে ন্যক্কারজনক এক হামলার শিকার হলে তিনি গণমাধ্যমকে জানান ‘আমি মানবতাবিরোধী অপরাধের তিনটি মামলার রায় দিয়েছি। জামায়াত নেতা সাঈদীকে তো আমি ছাড়া আর কেউ ফাঁসি দেয়নি।

ණ☛ এ কারণে জামায়াত আমার ওপর টার্গেট করে।’ আপিল বিভাগের বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক গত বছরের ১ অক্টোবর অবসরে যান। সাবেক প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন অবসরে যান গত বছরের ১৬ জানুয়ারি। অথচ এই দুজন বিচারপতি মাওলানা সাঈদীর পূর্ণাঙ্গ রায় দেন গত ৩১ ডিসেম্বর। একজন অবসরে যাওয়ার প্রায় এক বছর পর। আরেকজন অবসরের তিন মাস পর। কিন্তু বেলা শেষে হঠাৎ করেই ভয়ঙ্করভাবে মুখ বোমা ফাটালেন স্বয়ং দেশের প্রধান বিচারপতি মহোদয়।

ණ☛ তবে এবার দেখার পালা, যারা সংবিধান লঙ্ঘন করলেন তাদের বিরুদ্ধে সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে প্রধান বিচারপতি কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন? কারণ সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে সংবিধান সুরক্ষার দায়ভার সুপ্রিম কোর্টের। আপনি লিখিত বিবৃতি দিয়েছেন। এটা থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ অবশিষ্ট নেই। আর বিচারালয় মানুষের আস্থার প্রতীক। আস্থার সুরক্ষাও প্রয়োজন।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:০৩
৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×