হংকংয়ে ক্রমশঃ জনপ্রিয় হচ্ছে ইসলাম...
গণচীনের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত একটি বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল ও মহানগরী হংকং হচ্ছে চীনের বিশেষ প্রশাসনিক একটি অঞ্চল। হংকংয়ে ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে ইসলাম। ১৯৯৩ সালে এ অঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যার পরিমান ছিল ৬০,০০০ জন। ২০১৬ সালে সেই সংখ্যা ৩,০০,০০০ অতিক্রম করে, যা বর্তমানে আরও বেড়েছে।
২০১৪ সালের পরিসংখ্যান মতে হংকংয়ে মুসলিম জনসংখ্যা ৪.১ ভাগে উন্নীত হয়। ১১১০.১৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের হংকংয়ের বর্তমান জনসংখ্যা পৌনে এক কোটির মত, সংখ্যায় যা প্রায় ৭৫,৭০০ জন। বৌদ্ধ, তাওবাদ ও খ্রিস্ট ধর্মের পর ইসলাম হংকংয়ের চতুর্থ বৃহত্তম ধর্ম। তবে হংকংয়ের বিপুলসংখ্যক মানুষ নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী। হংকংয়ে বসবাসকারী মুসলিমদের মধ্যে ৬০ শতাংশ ইন্দোনেশিয়ান। এ ছাড়া ৪০ হাজার চীনা মুসলিম এবং ৩০ হাজারের মত ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশী মুসলিম রয়েছে।
হংকংয়ে হালাল রেস্টুরেন্টের সংখ্যাঃ
মুসলিমদের সঙ্গে সঙ্গে হংকংয়ে ইসলামী সংগঠন ও হালাল রেস্টুরেন্টের সংখ্যাও বাড়ছে। ধারণা করা হয়, আজ থেকে প্রায় ৩০/৩৫ হাজার বছর আগে হংকং ভূমির জন্ম হয় এবং ছয় হাজার বছর আগে সেখানে মানববসতি গড়ে ওঠে। খ্রিস্টপূর্ব ২১৪ সালে কিন বংশের শাসকগণ হংকংকে চীনের অন্তর্ভুক্ত করে। তবে ১৮৪১ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পর আধুনিক হংকংয়ের যাত্রা শুরু হয়।
হংকংয়ে ইসলাম বিকাশলাভের সূত্রপাতঃ
স্বীকৃত ইতিহাস অনুযায়ী ব্রিটিশ বাহিনীর সদস্য হিসেবে ভারতীয় মুসলিমরা হংকংয়ে পদার্পণ করলে সেখানে ইসলাম বিকশিত হতে শুরু করে। ব্রিটিশ প্রশাসনই হংকংয়ে মসজিদ ও মুসলিম কবরস্থান নির্মাণের জন্য জায়গা প্রদান করে। সে সময় আসা বেশির ভাগ মুসলিমই ছিলেন সেনা সদস্য। তবে তাদের মধ্যে মুসলিম ব্যবসায়ীগণও ছিলেন।
হংকংয়ে সর্বপ্রথম মসজিদঃ
হংকংয়ে ক্রমবর্ধমান মুসলিমরা তাদের ইবাদত বন্দেগীর জন্য ৩০, শেলি স্ট্রিটে ১৮৫০ সালে সর্বপ্রথম একটি জামে মসজিদ নির্মাণ করেছে। ১৯১৫ সালে এটিকে পুনর্নির্মাণ হয়। তারপর থেকে তা এখনো দাঁড়িয়ে আছে আশপাশের সুউচ্চ ভবনের ছায়ায়।
৩০, শেলি স্ট্রিট জামে মসজিদ, হংকং
৩০, শেলি স্ট্রিট জামে মসজিদ, হংকং
হংকংয়ে দ্বিতীয় মসজিদঃ
হংকংয়ের দ্বিতীয় মসজিদ নির্মিত হয় ১৮৯৬ সালে নাথান রোডে ভিক্টোরিয়া হার্বারের পাশে, যা কোলন মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার নামে পরিচিত। ১৯৭৬ সালে সিম শ সুইয়ের মধ্য দিয়ে রেললাইনের টানেল করার সময় মসজিদটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৮০ সালে তা ভেঙে পুনর্নির্মাণ করা হয়।
নাথান রোডে ভিক্টোরিয়া হার্বারের পাশে স্থাপিত কোলন মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার, হংকং
হংকংয়ে তৃতীয় মসজিদঃ
মসজিদে আম্মার হংকংয়ের তৃতীয় মসজিদ। ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত মসজিদের নামের সঙ্গে ‘সাদিক’ শব্দটি পরে যুক্ত করা হয়। সাদিক ছিলেন একজন চীনা মুসলিম স্থপতি। তিনি মসজিদে আম্মারের প্রতিষ্ঠাতা এবং নকশাবিদ।
দৃষ্টিনন্দন মসজিদে আম্মার, হংকং
মসজিদে আম্মারের অভ্যন্তরভাগের একটি দৃশ্য, হংকং
বহু মসজিদের নগরী এখন হংকং
একটি নির্মাণাধীন মসজিদসহ বর্তমানে হংকংয়ে মসজিদের সংখ্যা সাতটি। এ ছাড়া মুসলিমদের জন্য ৭০টি স্বীকৃত হালাল রেস্টুরেন্ট, পাঁচটি ইসলামিক স্কুল, কয়েকটি মাদরাসা ও দুটি পৃথক কবরস্থান রয়েছে।
ব্রিটিশ আর্থিক প্রতিষ্ঠান এইচএসবিসি ইসলামী অর্থব্যবস্থা (Islamic finance system) প্রবর্তন করে। ২০০৭ হংকংয়ে অবস্থিত ‘আরব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’ প্রতিষ্ঠা করে ‘এইচকে ইসলামিক ইনডেক্স’। ইসলামিক ইউনিয়ন অব হংকং, ইসলামিক কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন, হংকং ইসলামিক ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশন, ইউনাইটেড মুসলিমস অ্যাসোসিয়েশন অব হংকং অত্র অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য ইসলামী সংগঠন।
হংকংয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং প্রাক ইতিহাসঃ
হংকং বা হংকং বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল গণচীনের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত একটি বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল ও মহানগরী। ম্যান্ডারিন চীনা ভাষায় হংকংকে শিয়াংকাং (চীনা: 香港) বলে। হংকং অঞ্চলটি মূল চীনা ভূখণ্ড থেকে দক্ষিণ চীন সাগরে ভেতরে প্রসারিত হয়েছে। এর উত্তরে চীনের কুয়াংতুং প্রদেশ এবং পূর্ব, পশ্চিম আর দক্ষিণে দক্ষিণ চীন সাগর অবস্থিত। পার্ল নদীর বদ্বীপের পূর্বভাগে অবস্থিত এই অঞ্চলটি ২৬০টিরও বেশি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নিয়ে গঠিত, যাদের মধ্যে প্রধানতম দ্বীপটি হল হংকং দ্বীপ। লানথাউ দ্বীপটিও উল্লেখযোগ্য। দ্বীপগুলির বাইরে হংকংয়ের অধীনে কাওলুন উপদ্বীপ ও কাওলুন উপদ্বীপের উত্তরে নতুন অঞ্চল বা নিউ টেরিটরিজ নামের একটি অঞ্চল আছে, যা কুয়াংতুং প্রদেশে অবস্থিত একটি ছিটমহল। হংকং দ্বীপের উত্তর-পশ্চিম তীরে অবস্থিত ভিক্টোরিয়া এলাকাটি হংকংয়ের বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র। প্রায় ১১০২ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট হংকংয়ে ২০১৬ সালের জনগণনা অনুযায়ী ৭৫ লক্ষেরও বেশি লোকের বাস, ফলে এটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলির একটি। হংকংয়ে একটি মিশ্র সংস্কৃতি বিদ্যমান। এখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় ধরনের সংস্কৃতির ছুটি ও উৎসবগুলি পালন করা হয়, যেমন চীনা চান্দ্র নববর্ষ এবং বড়দিন। হংকংয়ের বহু লোক ইংরেজি ও চীনা উভয় ভাষাতেই কথা বলে।
পুরাকালে কৃষি ও মৎস্য শিকারই ছিল হংকংবাসীর পেশাঃ
আদিতে হংকং কৃষিজীবী ও মৎস্যশিকারীদের কতগুলি গ্রাম নিয়ে গঠিত জনবিরল একটি এলাকা ছিল।[৫] কিন্তু বর্তমানে এটি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর্থ-বাণিজ্যিক কেন্দ্র ও সমুদ্র বন্দরে পরিণত হয়েছে।[৬] একটি উৎকৃষ্ট প্রাকৃতিক গভীর পোতাশ্রয়ের কারণে হংকং জাহাজ পরিবহনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকিং, বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হংকংয়ের অর্থনীতির ভিত্তি। এছাড়া পর্যটন ও মৎস্য আহরণও দুইটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাত। অধিকন্তু, হংকং বিশ্বের অন্যতম প্রধান চলচ্চিত্র নির্মাণ কেন্দ্র। ১৯১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হংকং বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। ২০২০ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কেন্দ্রসমূহের সূচক তালিকাতে হংকং ৬ষ্ঠ অবস্থানে এবং এশিয়ার মধ্যে ৪র্থ অবস্থানে ছিল (টোকিও, সাংহাই ও সিঙ্গাপুরের পরে)।[৭] হংকং বিশ্বের ১০ম বৃহত্তম রপ্তানিকারক ও ৯ম বৃহত্তম আমদানিকারক অঞ্চল।[৮][৯]
প্রায় তিন হাজার বছরেরও প্রাচীন মানববসতি হংকংয়েঃ
হংকংয়ে তিন হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষের বাস। ১৮২১ সালে ব্রিটিশ বণিকেরা হংকংয়ের পোতাশ্রয় ব্যবহার করা শুরু করে। ১৯শ শতকের মধ্যভাগে যুক্তরাজ্য ও চীন একাধিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৮৪২ সালে প্রথম আফিমের যুদ্ধশেষে চীনের ছিং সাম্রাজ্য ব্রিটিশদের কাছে হংকং দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দেয়।[৫] এরপর ১৮৬০ সালে দ্বিতীয় আফিমের যুদ্ধের পরে উপনিবেশটির সাথে কাওলুন উপদ্বীপটি যোগ করা হয়। তারও পরে ১৮৯৮ সালে যুক্তরাজ্যে নতুন অঞ্চল বা নিউ টেরিটোরিজ নামক অঞ্চলটিকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিলে হংকংয়ের কলেবর আবারও বৃদ্ধি পায়।[১০][১১] ১৯৮৪ সালে যুক্তরাজ্যে সমগ্র হংকং অঞ্চলকে চীনের কাছে ফেরত দেবার ব্যাপারে সম্মত হয় এবং ১৯৯৭ সালে এটিকে চীনের কাছে ফেরত দেওয়া হয়।[১২] তবে চীনারা হংকংকে একটি বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চলের মর্যাদা দেবার ব্যাপারে সম্মত হয়, যেখানে চীনের বাকী অংশে প্রচলিত সব নীতি বা নিয়ম হংকংয়ের অনুসরণ করতে হয় না। একটি বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে হংকংয়ের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি চীনা মূল ভূখণ্ড থেকে পৃথক, যে ব্যাপারটি "এক দেশ, দুই ব্যবস্থা" নামক মূলনীতি দ্বারা বর্ণনা করা হয়েছে।[১৩]
হংকং আজ বিশ্বের আধুনিক শিল্পাঞ্চলঃ
হংকং একটি অতি উন্নত অঞ্চল। ২০১৯ সালে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে এর অবস্থান ৪র্থ ছিল।[১৪] হংকংয়ের অধিবাসীদের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ২০১৯ সালে বিশ্বের সর্বোচ্চ ছিল।[১৪] ঘনবসতিপূর্ণ এই এলাকার শতকরা ৯০ ভাগ মানুষই যাতায়াতের জন্য গণপরিবহন ব্যবস্থা ব্যবহার করে থাকে।[১৫] যদিও হংকং মহানগরীর মাথাপিছু স্থূল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (ক্রয়ক্ষমতার সমতা অনুযায়ী) বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ, তা সত্ত্বেও এখানে গুরুতর অর্থনৈতিক বৈষম্য বিদ্যমান।[১৬]
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, ইকনা এবং অন্যান্য অনলাইন সংবাদ মাধ্যম
হংকংয়ের ধারাবাহিক উন্নতির চিত্র ফুটে উঠেছে বিগত শতাব্দির শেষের কয়েক দশকে ধারণকৃত নিচের ছবিগুলোতে-
১৯৫০ এর দশকে ভিক্টোরিয়া, হংকং
১৯৬০ এর দশকে কাউলোন শহর এবং ভিক্টোরিয়া, হংকং
১৯৭০ এর দশকে কাউলোন শহর এবং ভিক্টোরিয়া, হংকং
১৯৮০ এর দশকে কাউলোন শহর এবং ভিক্টোরিয়া, হংকং
১৯৯০ এর দশকে কাউলোন শহর এবং ভিক্টোরিয়া, হংকং
রাতের আলো ঝলমলে হংকং
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০২১ বিকাল ৪:০৮