মুম্বাইয়ের দিনলিপিঃ আক্রান্ত মুম্বাই... (পর্বঃ চার)
ডাক্তাররা বললেন, “একটা বিকল্প পথ তৈরি করতে হবে; কারণ, তোমার আম্মার বাম কিডনির উপর টিউমারটা চেপে বসে আছে। এই কিডনি কোন কাজই করতে পারছে না। এর ফলে উনি কষ্ট পাচ্ছেন।” সেই জন্য ডাক্তাররা একটা বিকল্প পথ বাইরে তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। আর তার জন্য আম্মার পিঠের পিছন দিয়ে সূচ ঢুকিয়ে একটা তারকে বাম কিডনি পর্যন্ত (খুব সোজা বাংলায় বললে) পৌঁছে দিতে হবে। এপাশে থাকবে একটা ব্যাগ। নির্ধারিত দিনে আম্মাকে নিয়ে গেলাম একতলার অপারেশন রুমে...
আমাকে ডাক্তাররা ভিতরে যেতে দিলেন না। আসলে যেতে না দেওয়াটাই উচিৎ। আমি আম্মাকে দেখবো আবেগ দিয়ে যার জন্য ডাক্তারদের কাজ করতে বেগ পেতে হতে পারে। চূড়ান্তে সেখানে আম্মারই ক্ষতি হবে। উৎকণ্ঠা নিয়ে আমি বাইরে পায়চারী করতে থাকলাম। দুশ্চিন্তায় ঠোঁটের চামড়া তোলার অভ্যাস ক্লাস সিক্স থেকে। মনে হচ্ছিলো সেদিনই আমি এক কেজি চামড়া তুলে ফেলবো। একটু সময় লাগলো কিন্তু আম্মার অপারেশন ‘সুন্দরভাবে’ শেষ হল। কারণ আম্মা পুরোটা সময় একদম চুপচাপ ছিলেন। ডাক্তাররাও আম্মার প্রশংসা করলেন। এই ঘটনার অল্প কিছুদিন পরে...
আমি কেবিনের মেঝেতে চাদর পেতে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। সাথে ছোট মামা ছিলেন। আম্মা মামার সাথে কথা বলছিলেন। বিভিন্ন কথা প্রসঙ্গে এক সময় আম্মা আমার প্রসঙ্গ তুললেন। আম্মা ভেবেছিলেন আমি হয়তো ঘুমাচ্ছিলাম। “ওর জীবনটা একদম এলোমেলো হয়ে গেলো আমার জন্যে। ওর ক্লাস, ভার্সিটি সব নষ্ট হচ্ছে এখানে এসে। ওর জন্য আমি ব্যথায় কিছু বলতেও পারি না। আমার থেকে ওই বেশি অস্থির হয়ে যায়। সেদিন যখন পিঠ দিয়ে সূচ ঢুকিয়ে অপারেশন করছিল আমাকে তিনটা অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয়; কিন্তু কোনোটাই কাজ করছিল না সেভাবে। কিন্তু আমি চুপচাপ ছিলাম ওর কথা ভেবে যে, ও না আবার অস্থির হয়ে পড়ে। ডাক্তারদেরও কিছু বলিনি!!!” আম্মার এই কথা শুনে জাস্ট মাথায় একটা ইলেকট্রিক শকের মতো খেয়েছিলাম। রক্তদানের সময় যে সূচ ব্যবহার করে অপারেশনের সেই অ্যাপারেটাস সূচটা তার থেকেও মোটা ছিল। এরপরের ঘটনা বেশি কিছু বলার দরকার আছে বলে মনে হয় না...
আমার আম্মার মতো এরকম মহান মা প্রত্যেকের আছে। প্রতিনিয়ত তারা কষ্ট সহ্য করেও হাসিমুখে থাকেন। আম্মা বেঁচে থাকার সময় একদিনও ঘটা করে মা দিবস পালন করা হয় নাই। অথচ সাড়ে চার বছর হয়ে গেছে... আম্মা নেই। এখন ৩৬৫ দিনই আমার কাছে “মা দিবস''...
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০১৬ রাত ১২:১৭