ঘুম ভেঙ্গে গেছে দৃজার,
আবার স্বপ্নে হানা দিয়েছে অতীত । যে অতীতকে সে মনেপ্রানে চেয়েছে ভুলে থাকতে , সেই অতীত প্রতি রাতে এসে হানা দিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে । দৃজা পারেনি ভুলে থাকতে সেই বিগত দিনগুলোকে , সেই বিগত মালাকে!
শোয়া থেকে উঠে বসল দৃজা । পাশের সাইড টেবিলে রাখা গ্লাসটা তুলে নিল সে , কয়েক ঢোকে খালি করে ফেলল গ্লাসটা । পানিটুকু পান করে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল গ্লাসটির দিকে । এরপর যেখান থেকে গ্লাসটি পেল সেখানে রাখতে গিয়ে দেখতে পেল খামটি । গতকাল সন্ধ্যায় তার PS বলল একটা লোক নাকি তাকে এই খামটি দিতে বলেছে এবং বলেছে এটা যেন একমাত্র দৃজাই খুলে দেখে , আর কেউ যেন না খুলে । এখানে নাকি ভীষণ জরুরি কিছু আছে এমনটাই নাকি বলেছিল লোকটা । গতকাল ব্যস্ততার জন্যে আর দেখা হয়নি । এখন আর ঘুম আসছে না ভাবছে এখন একবার পড়ে দেখবে কিনা । গ্লাসটি রেখে দৃজা খামটি তুলে নিল । মাথার দিকটা ছিঁড়ে উপুর করতেই একটা চিঠি তার কোরের ওপর এসে পড়ল । চিঠিটা খুলে সে বেড ল্যাম্পের আলোয় পড়তে শুরু করল ।
দৃজা,
কেমন আছো ? আরেহ কি বোকা আমি , তোমাকে জিজ্ঞেস করছি কেমন আছো !তুমি কেমন থাকবে তা তো এখন সবার জানা ।তোমার জীবনাচরণ তো এখন অনেক মেয়ের কাছে অনুসরনীয় ।বাংলার অনেক মেয়ে এখন তোমার অবস্থানে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে , এ এমন এক অবস্থান যেখানে নিজেকে ভীষণভাবে উপভোগ করা যায় । নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলা যায় ,“ তাকিয়ে দেখ সবাই আমি কতটা ভিন্ন তোমাদের থেকে । তাকিয়ে দেখ আমার শরীরে তোমাদের শরীরে লেপ্টে থাকা দৈন্যতাটুকু নেই । আছে শুধু তোমাদের স্বপ্নের সেই অপ্রাপ্তিব্য সীলমোহর ।”
নাহ তুমি ভালোই আছো ।
ভালো থাকবেই বা না কেন ? এখন তোমার গায়ে চড়েছে সবচেয়ে দামি পোশাক । তোমার গলার ঐ হিরে বসানো নেকলেসটা অনেক নারীর হিংসের কারণ । তোমার হাসি আর ঢেউ খেলানো শরীর অনেক যুবকের হোঁচট খাওয়ার কারণ ।তোমার চারপাশে তোমাকে ঘিরে থাকা বিখ্যাত মানুষগুলো কেবল তোমার মোহেই সারাদিন গুঞ্জন তোলে ।বাংলার বিখ্যাত বিলিওনিয়ার তোমাকে রোলস রয়েস গাড়ি উপহার দেয় ।প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা দূত হিসেবেও তোমার ডাক পড়ে । এটাকে হয়তো সুখ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায় , কিন্তু তবুও তুমি সুখী নও ! সারাদিনের এই জৌলুসের ছটা তোমার রাত্রিবেলার শয্যায় বিলীন হয়ে যায় তাই না ? অতীতগুলো তোমাকে দুঃস্বপ্ন হয়ে হানা দেয় তাই না ? বারাবর তোমাকে মনে করিয়ে দেয় কী ছিলে তুমি , কেমন ছিল তোমার অতীতের দিনগুলি ।আচ্ছা তোমার সেই অতীত কী মনে করিয়ে দেয় , আজকের এই দৃজাকে কোন এক নিম্নবিত্ত পরিবারে নাদিম নামের ছেলেটি ভীষণ ভালোবাসত । হ্যাঁ ভালোবাসত , তবে আজকের এই দৃজাকে না সেই পুরনো মালাকে । যার চোখে হয়তো বাঁচার স্বপ্ন ছিল কিন্তু ছিল না বাঁচতে গিয়ে নিজেকে বিকিয়ে দেয়ার বাসনা । দৃজা আজ এইযে জৌলুস দেখছ তা থকবে না , এই জৌলুসটুকু ফিকে হলেই দেখতে পাবে হারিয়ে গেছে তোমার চারপাশে গুঞ্জন তোলা মানুষগুলো । দেখবে দৃজা নামটি মুছে গেছে পুরো পৃথিবী তখন নতুন দৃজার মোহে মেতে আছে , পুরনো দৃজার কোন অস্তিত্ব থাকবে না । তাহলে আজ যে কৃত্রিম ভালোবাসা দেখছ তার জন্য বাঁচবে নাকি নিজের সত্যটুকু খুঁজে নেবে ? আমি জানি প্রতি রাতে তোমার অতীত তোমাকে বিরক্ত করে । কেন তা কি বুঝতে পারছ না নাকি এই জীবন নিয়ে বাঁচতে চাও ? যদি বাঁচতে চাও তবে বাঁচো তবে মনে রেখ সময় ভীষণ চঞ্চল ! সে কখনও থেমে থাকে না ।
আর হয়তো তোমার জন্য আমি অপেক্ষায় থাকব , সেই নোনা ধরা একতলা দালানের মাঝে যদি সময় বেরহম না হয় তো । একদিন তুমি বুঝতে পারবে তোমার সবটুকু । ভয় পেয়ো না আমি বদলাব না নিজেকে বিকিয়ে না দিলে বদলে যাবার সুযোগ আসে না দৃজা ।
ইতি
নাদিম
থমকে গেছে দৃজা আর দৃজার পৃথিবী , না ভুল বলেনি সে । তার চারপাশে আজ যে আলো দেখছে তা ভীষণ কৃত্রিম তা সে বুঝতে পারে । আর পারে বলেই প্রতি রাতে এমন যন্ত্রনাদায়ক স্বপ্ন এসে ধরা দেয় । আর নিতে পারছে না দৃজা , এমন যন্ত্রনা সহনীয় নয় । কিন্তু চাইলেই কী এর থেকে পরিত্রান পাওয়া যায় ? এক সময় এমন একটা জীবনের স্বপ্ন দেখত আর আজ এর থেকে মুক্তি পেতে চাইছে । কী আদ্ভূত এই জীবন , কী অদ্ভূত এই দৃজা ওরফে মালা ! আর কী সহজ নাদিমদের ভালোবাসা মালাদের জন্য !
{অঞ্জন দত্তের মালা গানটির অবলম্বনে লিখা}
সবাইকে মালা দিবসের শুভেচ্ছা !!!!!!
পরিশিষ্ট:
এই লিখাটি ২০১৯ সালে লিখেছিলাম । কাঁচা হাতের লিখা , চোখের সামনে এক নাদিম আর আরেক দৃষ্টরজা ওরফে দৃজাকে দেখে এই গল্পটি লিখেছিলাম । দৃজা এখন বেশ ভালোই আছে । বেশ বিখ্যাত মানুষের দয়িতা হয়ে আর নাদিম ? তার খবর আমি পাই না প্রায় ৩ বছর হলো ! একদিন যে হারিয়ে গেল আর তার খোঁজ পাওয়া গেল না ! মাঝে মাঝে নাদিমের কথা ভেবে খুব খারাপ অস্বস্তি বোধ হয় । তার সাথে আমার যতবার আলাপ হয়েছে ততবার ম্যারি ক্লেয়র আর মালাকে নিয়ে আলাপ হয়েছে । কিন্তু সে যে অঞ্জন হয়ে হারিয়ে যাবে এটা আমি বুঝতে পারিনি !
“ ভালো খেকো নাদিম , দৃজারা এমনই হয় ! কারণ সভ্যতা তাদের এমনই গড়ে দেয় ! ”