এক্সপো সাধারণত তিন সপ্তাহ থেকে ছয় মাস দীর্ঘ হয়ে থাকে। বিভিন্ন সময় স্বাগতিক দেশ এবং মূল বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এর নামেও ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন, গ্লোবাল এক্সপো, ওয়ার্ল্ড এক্সপো, ইউনিভার্সেল এক্সপোজিশন, গ্লোবাল ফেয়ার ইত্যাদি। যে নামেই ডাকা হোক এক্সপোর উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এবং চিন্তার ধরন সবসময় একই রকম। ইতিহাসবিদদের মতে এক্সপোর মূল ভাবনা ধার করা হয় ফরাসিদের কাছ থেকে। ১৮৪৪ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে একটি শিল্পমেলা করা হয়। সেখান থেকে মূল ভাবনা বা পরিকল্পনা ধার নিয়ে ১৮৫১ সালে ব্রিটেনের রাজধানী এবং সে সময়ের শিল্প দুনিয়ার সবচেয়ে বড় শহর লন্ডনে আয়োজন করা হয় বিশ্বের প্রথম এক্সপো। যা ‘গ্রেট এক্সিবিশন অব দি ওয়ার্কস অব অল ইন্ডাস্ট্রিয়াল নেশনস’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। ওই আয়োজনে বিশ্বের ২৫টি দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এক্সপো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় ১৯২৮ সালে বিআইই বা ইন্টারন্যাশনাল এক্সিবিশন ব্যুরো প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। প্রতিষ্ঠাকালে বিআইই’র সদস্য ছিল ৩১টি দেশ। পরবর্তীতে এর বাণিজ্যিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব বুঝে এক্সপোর সাথে যুক্ত হয় প্রায় দেড় শতাধিক রাষ্ট্র। বিআইই প্রতিষ্ঠার পর প্রথম আন্তর্জাতিক এক্সপো করা হয় নিউইয়র্কে। এর আগে আমেরিকার পেনসিলভানিয়া রাজ্যের ফিলাডেলফিয়ায় সে দেশের প্রথম ওয়ার্ল্ড এক্সপো আয়োজিত হয়। বর্তমানে বিআইই’র মাধ্যমে প্রতি ৫ বছর অন্তর বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক ওয়ার্ল্ড এক্সপো আয়োজন করা হয়। এ ছাড়াও দুই/এক বছরের বিরতিতে বিভিন্ন সময় আঞ্চলিক এবং বিষয় ভিত্তিক এক্সপোজিশন করতে দেখা যায়। এক্সপো মিলানোর পর ২০২০ সালে পরবর্তী ওয়ার্ল্ড এক্সপো অনুষ্ঠিত হবে আরব আমিরাতে। বিআইই’র সদস্য দেশগুলোর ভোটাভুটির মাধ্যমে এক্সপোর আয়োজক দেশ নির্ধারণ করা হয়। ২০২০ সালে অনুষ্ঠিতব্য এক্সপোর আয়োজক দেশ হিসেবে গত বছর রাশিয়া এবং আরব আমিরাত ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। সে সময়ে রহস্যজনক কারণে বাংলাদেশ রাশিয়াকে ভোট দেয়ায় আরব আমিরাতের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং সেদেশে বাংলাদেশের শ্রমিক রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় বলে পত্রপত্রিকার খবরে বলা হয়।
ওয়ার্ল্ড এক্সপো বিশ্ববাসীকে নতুন নতুন অনেক কিছুর সাথেই পরিচয় করিয়েছে। অনেক ল্যান্ডমার্ক বা ঐতিহাসিক নিদর্শন সৃষ্টি করেছে। যেমন, ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার, লন্ডনের কৃস্টাল প্যালেস, বেলজিয়ামের অ্যাটোমিয়াম। এগুলোর খবর সবাই রাখে, কিন্তু এগুলোর জন্ম ইতিহাসের সাথে যে এক্সপো জড়িয়ে আছে সে খবর হয়তো অনেকেই রাখে না। ১৮৭৬ সালে এক্সপোর মাধ্যমে আমেরিকা প্রথম বিশ্ববাসীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় টাইপরাইটার, টেলিফোন, টমাটোর ক্যাচাপসহ বেশ কিছু নতুন নতুন পণ্য। ১৮৮৯ সাল ছিল ফ্রান্সের বাস্তিল দুর্গ পতনের শততম বছর। ওই বছরই প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সেল এক্সপোজিশন। বাস্তিল দুর্গ পতনের শত বছরকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রজাতন্ত্রী ফ্রান্স তখন ইউনিভার্সেল এক্সপোজিশনের সদর দরজা হিসেবে নির্মাণ করে ৩০০ মিটার উঁচু ইস্পাতের আইফেল টাওয়ার। ১৯০০ সালে আরেকটি ওয়ার্ল্ড এক্সপো করা হয়েছিল ফ্রান্সে। সে সময় বিশ্ববাসী পরিচিত হয় ডিজেল ইন্জিন, চলমান সিঁড়ি (এসকেলেটর) এবং সবাক চলচ্চিত্রসহ অনেক আবিষ্কারের সাথে। ১৯০৪ সালের সেন্ট লুইস এক্সপো বিশ্ববাসীকে উপহার দেয় খাবারযোগ্য আইসক্রিম। পানামা খাল নির্মাণ শেষ হয় ১৯১৫ সালে। সে বছর এক্সপো সানফ্রান্সিসকোর মাধ্যমে দুনিয়া জুড়ে পানামা খালের খবর ছড়িয়ে পড়ে এবং ভূমিকম্প বিধ্বস্ত সানফ্রান্সিসকো পুনর্নির্মাণের দক্ষতা প্রকাশ পায়। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে বিস্ময়কর স্থাপনা অ্যাটোমিয়াম নির্মাণ করা হয়েছিল ১৯৫৮ সালে অনুষ্ঠিত সে দেশের ওয়ার্ল্ড এক্সপো উপলক্ষে। জাপানের ওসাকা ওয়ার্ল্ড এক্সপোতে বিশ্ববাসী প্রথম দেখেছিল বিস্ময়কর আবিষ্কার মোবাইল টেলিফোন। ১৯৭০ সালের ওই এক্সপোয় আমেরিকা একখণ্ড পাথর দেখিয়ে বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছিল। যা নীল আর্মস্ট্রংরা চাঁদের বুক থেকে তুলে এনেছিলেন। ইতালির ভাসমান শহর ভেনিসে আজ যে গোন্দলা এবং ওয়াটার ট্যাক্সি দেখে পর্যটকরা বিস্ময় প্রকাশ করেন এই গোন্দলা, ওয়াটার ট্যাক্সি, মনোরেল এবং স্কাই ট্রেনের সাথে ১৯৮৬ সালে বিশ্ববাসীকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল কানাডার ভ্যাঙ্কুভারের গ্লোবাল এক্সপো। অস্ট্রেলিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৮৮ সালের ব্রিসবেন এক্সপোকে সামনে রেখে তার দেশের ২ হাজার কিলোমিটার এলাকাকে নতুন করে টেলিফোন সংযোগের আওতায় এনেছিল। ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত চিনের সাংহাই এক্সপোর মূল ভেন্যুকে ২০১২ সালে সাংহাই মিউজিয়াম অব কনটেমপোরারি আর্ট ঘোষণা করা হয়। ২০১৫ সালের এক্সপো মিলানোয় পাঁচ টন ওজনের প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ এক পিজা বানিয়ে বিশ্ববাসীকে চমকে দেন ইতালির ৬০ জন বিখ্যাত পিজার শেফ।
এক্সপো মিলানোয় অংশগ্রহণকারী দেশগুলোকে নিজ নিজ দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাফল্য এবং কৃষি ভাবনা তুলে ধরার জন্য একেকটি দিন নির্ধারণ করে দেয়া হয়। নির্ধারিত দিনে বিভিন্ন দেশের ডেলিগেট এবং সাংবাদিকদের সামনে দেশগুলো তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাফল্য এবং কৃষি ভাবনা তুলে ধরে। এর ধারাবাহিকতায় ২০ সেপ্টেম্বর এক্সপো মিলানোয় পালিত হয় ‘বাংলাদেশ ডে’। সেখানে প্রায় হাজারখানেক গুরুত্বপূর্ণ ডেলিগেট্স, সাংবাদিক এবং প্রবাসী বাংলাদেশিরা উপস্থিত ছিলেন।
ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক এবং সামাজিক খাতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। তার সরকার বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিশ্ব মডেলে পরিণত করতে পেরেছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে ২০২১ সালে বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তিতে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে ঘোষণা করা সম্ভব হবে। মন্ত্রী বলেন, ইতালি বাংলাদেশের ষষ্ঠ বৃহত্তম রপ্তানি বাজার। ইতালি বাংলাদেশকে পিএসপি সুবিধা দিয়েছে। যার ফলে গতবছর বাংলাদেশ ইতালির সাথে ১৭৪৭.৪৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের বাণিজ্য করেছে। বাংলাদেশ ইতালিতে রপ্তানি করেছে ১৩৮২.৩৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য এবং আমদানি করেছে ৩৬৫.১০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য। তিনি জানান, তৈরি পোশাক এবং বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি শিল্পে ইতালিয়ান পাঁচটি কোম্পানি বাংলাদেশে কাজ করছে। মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক সময় শূন্য হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের খাদ্যাভাব পূরণ করেছিলেন, এখন তার কন্যা শেখ হাসিনা ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যাভাব পূরণ করে বিদেশে চাল রপ্তানি করছেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ডে’র অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে ক’জন শিল্পী আনা হয়। তারা নেচেগেয়ে আমাদের সংস্কৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করেন। সকালে মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদসহ দূতাবাসের কর্মকর্তারা এবং স্থানীয় ডেলিগেটরা গলায় লাল সবুজের পতাকা নিয়ে র্যালি করেন। নির্দিষ্ট সময় থেকে প্রায় একঘণ্টা পরে মন্ত্রী এবং দূতাবাস কর্মকর্তারা র্যালিতে যোগ দেন। কারণ বিএনপির প্রবাসী কর্মীরা তোফায়েল আহমেদকে প্রায় এক ঘণ্টা হোটেলে অবরুদ্ধ করে রাখে। তারা মন্ত্রীর হোটেলের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। পরে পুলিশ এবং দূতাবাস কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় মন্ত্রী তোফায়েল আহমদ হোটেল থেকে বেরিয়ে এক্সপোর উদ্দেশ্যে রওনা করেন।
ইতালিতে অনুষ্ঠিত প্রথম এক্সপোর শতাধিক বছর পরে দ্বিতীয় এক্সপো অনুষ্ঠিত হলো মিলানোয়। প্রথম এক্সপোর সময় এখানে বাংলাদেশি কমিউনিটি না থাকলেও এখন আমাদের কমিউনিটির পরিধি বেশ বড়। সরকারি হিসেবে এক লাখের কিছু কম বলা হলেও বেসরকারি হিসাবে প্রায় দেড়লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি বসবাস করেন ইতালিতে। তাদের অনেকেরই আগ্রহ দেখা গেছে এক্সপোকে ঘিরে। ইতালির বিভিন্ন শহর থেকে তারা ছুটে গেছেন নিজ দেশের প্যাভিলিয়ন দেখতে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে গেছেন গর্ব করে। কিছু কিছু শহর থেকে বাস রিজার্ভ করে এক্সপো দেখতে গিয়েছেন প্রবাসীরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভেনিসের বাংলাদেশি কমিউনিটি। ভাসমান এই শহর থেকে শতাধিক বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকরা এক্সপো দেখতে গিয়েছেন ভেনিস বাংলা স্কুলের উদ্যোগে। দূর-দূরান্ত থেকে এক্সপো দেখতে আসা প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রায় সবাইকে হতাশা প্রকাশ করতে দেখা গেছে। তাদের অনেকে ক্ষোভের সাথে বলেন, আমরা প্রতি মাসে কাঁড়ি কাঁড়ি ইউরো ডলার দেশে পাঠাই অথচ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের এত দৈন্যতা কেন? কোথায় যায় আমাদের পাঠানো অর্থ? কোন খাতে ব্যয় করা হয় আমাদের ঘাম ঝরানো টাকা? প্রবাসীরা বলেন, দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয় না, বিদেশে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করা হয় লজ্জাজনক ভাবে। অথচ সরকার বলে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হতে চলেছি। আমাদের জিডিপি বেড়েছে। দেশকে ডিজিটাল করা হয়েছে। দেশ এখন মালয়েশিয়া হতে চলেছে। এসব কথার কোনো প্রমাণতো বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে খুঁজে পাওয়া গেল না! প্রবাসীরা বলেন, গর্ব করার মতো আমাদের অনেক কিছু আছে, অথচ তার কোনো উপস্থিতি নেই বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নে। আমাদের মৃৎশিল্প, কুটির শিল্প, তাঁত, লোকজ সংস্কৃতি অনেক উন্নত। সেগুলো রুচিশীলভাবে উপস্থাপন করে বিশ্ববাসীকে চমকে দেয়া যেতো। আমাদের পিঠা-পুলিসহ ঐতিহ্যবাহী খাবার, পোশাক, কৃষি উৎপাদন এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য যদি থ্রি-ডির মাধ্যমে দেখানো যেত বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখত। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের মধ্যে পজেটিভ ধারণা জন্ম নিত। প্রবাসীরা বলেন, বাংলাদেশের উদ্ভাবিত বিভিন্ন জাতের উচ্চফলনশীল ধান এবং এর গৌরব কথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার বড় সুযোগ ছিল এক্সপো মিলানোয়। কিন্তু সে সুযোগ যথাযথভাবে বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারেনি। অথচ পরিবর্তনশীল জলবায়ুর সাথে তাল মিলিয়ে অল্প জমিতে অধিক ফলনে আমাদের দেশি উদ্ভাবনের সফলতা কম নয়। বরং পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে বেশি। যা বিনে খরচে বিশ্বদরবারে আমরা তুলে ধরতে পারতাম। বিশ্ববাসীকে জানান দিতে পারতাম, বাংলাদেশিরা শুধু অন্যের দেশে শ্রম বিক্রি করে না, উদ্ভাবন ক্ষমতাও বাংলাদেশিদের আছে। বাংলাদেশিরা শুধু রাজনৈতিক কামড়াকামড়ি করে না, বিশ্ববাসীকে অনেক কিছু দেয়ার সক্ষমতাও বাংলাদেশিদের আছে। বাংলাদেশ শুধু খরা বন্যার দেশ না, অনেক সমৃদ্ধিও বাংলাদেশে আছে। কিন্তু সে চেষ্টা আমাদের প্যাভিলিয়নে দেখা যায়নি। প্রবাসীরা বলেন, রাইস ক্লাস্টারের প্রতিটি দেশ তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং কৃষি উৎপাদন, আবিষ্কার, পর্যটন, ঐতিহ্য দারুণভাবে তুলে ধরেছে। তাদের চিন্তা এবং রুচিশীলতা ফুটিয়ে তুলেছে। এশিয়ান দেশগুলোর প্রায় সব দেশের প্যাভিলিয়ন কর্মীরা নিজ নিজ দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরেছে। কম্বোডিয়া ধান উৎপাদনে তাদের কৃতিত্ব বিশাল করে দেখাতে চেষ্টা করেছে। মিয়ানমার তাদের কৃষি সফলতা, উৎপাদন এবং পর্যটন দেখিয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে। মাত্র তিন থেকে পাঁচ মিনিটে তারা তাদের গোটা দেশকে অসাধারণভাবে তুলে ধরেছে বিশ্ববাসীর সামনে। তাদের চমৎকার লাইফ পারফরম্যান্স দর্শনার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। অথচ বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নে কিছু ড্রাই ফুড এবং নিম্ন মানের সুভেনির ছাড়া তেমন কিছু দেখা যায়নি। প্যাভিলিয়নের এক কোনায় ছোট একটা কাঁচের শোকেসে ছোট ছোট ক’টা স্বচ্ছ বৈয়মে ক’জাতের ধান পুরে রাখা হয়েছে, যা কোনোভাবেই আমাদের দেশের উদ্ভাবন ক্ষমতার সাথে মানানসই হয়নি। বরং খুবই আপত্তিকর এবং লজ্জাকর উপস্থাপন হয়েছে। প্রবাসীরা বলেন, বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে যেসব সুভেনির উপস্থাপন করা হয়েছে সেগুলো কোনোভাবেই বিশ্ব মেলায় উপস্থাপনযোগ্য নয়। নিম্নমানের ওগুলো দেখে বিশ্ববাসী বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালো কোনো ধারণা নিতে পারেনি। তারা বলেন, সরকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উন্নত করার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে। বিদেশি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়। দেশে বিলবোর্ড লটকায়। এসব না করে যদি বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য করা হতো, ব্যবসায়িক প্রসারে তাদের টার্গেট বেঁধে দেয়া হতো, আন্তর্জাতিক ইভেন্টগুলোকে গুরুত্বের সাথে দেখা হতো তবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এমনিতেই উঁচুতে উঠে আসত। তারা বলেন, এক্সপো মিলানোয় বাংলাদেশের খাদ্য, কৃষি, পর্যটন, সংস্কৃতি গ্রহণযোগ্যভাবে উপস্থাপন করার জন্য আমাদের সরকার বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে খুব বেশি পরিশ্রম করার দরকার ছিল না, শুধু সদিচ্ছা থাকলেই চলত। একজন শাইখ সিরাজকে ব্যবহার করেই অনেক কিছু করা যেত। কিন্তু আমাদের সরকার কখনোই সহজ পথে হাঁটেনি। হেঁটেছে, হাঁটছে উল্টো পথে। প্রবাসীরা ক্ষোভের সাথে বলেন, আগামী দিনে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উপস্থাপন করতে হলে সম্মানজনকভাবে করতে হবে। নয়তো এসব ইভেন্টে যোগ না দেয়াই ভালো। এতে আর যাই হোক একজন বাংলাদেশি হিসেবে বিদেশে আমাদের লজ্জাকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না।
প্রবাসীদের এসব অভিযোগের অনেকটা স্বীকার করে আবদুল মতিন বলেন, ইতালির বিভিন্ন শহর থেকে প্রবাসীরা এক্সপোর বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন দেখতে এসেছেন এবং তাদের ভালো লাগা, খারাপ লাগা প্রকাশ করেছেন। ইতালিসহ বিভিন্ন দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এসেছেন, তারা সবাই বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। মিলানোর বিভিন্ন স্কুল থেকে শত শত ছাত্রছাত্রী এসেছে। তারা বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের ধান সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। তারা বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং উদ্ভাবন ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পেরে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। তিনি বলেন, প্রবাসীদের কেউ কেউ অভিযোগ তুললেও তাদের অভিযোগের মধ্যে এক ধরনের ভালোবাসা, ভালোলাগা কাজ করেছে। আমরা তাদের অভিমত এবং প্রত্যাশা জানতে পেরেছি, যা পরবর্তীতে কাজে লাগানো যাবে। আবদুল মতিন বলেন, বেশিরভাগ প্রবাসীর অভিযোগ বাংলাদেশের প্যাভিলিয়ন এত ছোট কেন? তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি এখানে আমাদের কোনো হাত ছিল না। তিনি বলেন, প্রবাসীদের প্রত্যাশা মতো হয়তো আমরা বাংলাদেশের প্যাভিলিয়ন সাজাতে পারিনি কিছু কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে, কিন্তু বাংলাদেশের সরকার, মন্ত্রণালয়, মিলানোস্থ বাংলাদেশের কনস্যুলেট জেনারেল এবং আমাদের আন্তরিক চেষ্টায় কোনো কমতি ছিল না। আমরা সবাই চেয়েছি বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ সঠিক এবং সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হোক। মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বাংলাদেশ ডে’র অনুষ্ঠানে দেশের সাফল্য তুলে ধরেছেন। আবদুল মতিন জানান, প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার দর্শনার্থী বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নে এসেছেন।
বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের সহকারী পরিচালক এবং অপারেশন ম্যানেজার আবদুল মতিন এক্সপো মিলানোর আগে ১৯৯৮ সালে পর্তুগাল এক্সপো, ২০০৫ সালে জাপান এক্সপো, ২০০৬ সালে চায়নার ওয়ার্ল্ড লেজার এক্সপো, ২০০৮ সালে স্পেন এক্সপো, ২০১০ সালে সাংহাই এক্সপো, ২০১১ সালে সিয়ান ওয়ার্ল্ড হর্টিকালচার এক্সপো, ২০১২ সালে নেদারল্যান্ডসের ওয়ার্ল্ড হর্টিকালচার এক্সপো, ২০১৩ সালে বেইজিং ইন্টারন্যাশনাল গার্ডেন এক্সপো এবং চায়না-আরব এক্সপোজিশনে নিজ উদ্যোগে অংশগ্রহণ করেছেন। এছাড়াও ইতালি, বেলজিয়াম, জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল, অস্টিয়া, জাপান, চায়নাসহ বিভিন্ন দেশের অনেক আন্তর্জাতিক ইভেন্টে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ২০১৬ সালে ইতালি এবং তুর্কির আরও দু’টি আন্তর্জাতিক এক্সপোজিশনে ইতোমধ্যেই তিনি আমন্ত্রণ পেয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসএস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসএস করা আবদুল মতিন দীর্ঘদিন প্রবাসী জীবন কাটিয়েছেন। একজন প্রবাসী দেশকে কীভাবে ধারণ করে এবং বিদেশে দেশকে কীভাবে উপস্থাপন করতে চায় তা খুব ভালোভাবে জানেন অভিজ্ঞ আবদুল মতিন। এক্সপো মিলানোর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বিনয়ের সাথে বলেন, আমার অভিজ্ঞতা খুব বেশি না। যেটুকু যা অর্জন করেছি দেশ বিদেশে ঘুরে ঘুরে অর্জন করেছি। বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক মেলায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে দেখেছি বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেকেরই জানার আগ্রহ আছে। আমি সবসময় চেষ্টা করেছি আমার দেশের ইতিবাচক দিকগুলো বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে। তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে অভিজ্ঞজনদের নিয়ে একটি বিশেষ সেল গঠন করা উচিত। যারা দেশকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইভেন্টে সঠিকভাবে উপস্থাপনের জন্য সরকারকে পরামর্শ দেবে এবং কীভাবে বাংলাদেশকে সম্মানজনক উপস্থাপন করা যায় তা নিয়ে গবেষণা করবে। তিনি বলেন, বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরতে এবং বাণিজ্যিক প্রসার ঘটাতে সরকার ইতোমধ্যে অনেক ভালো ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এসবের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ইভেন্টগুলোকে আরেকটু গুরুত্বের সাথে নিলে আমরা সত্যি সত্যিই বাংলাদেশকে বিশ্ব মডেলে পরিণত করতে পারব। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা অনেক সহজ হবে। যারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট কারার চেষ্টা করে তারা হালে পানি পাবে না বলে আমি বিশ্বাস করি। আবদুল মতিন বলেন, আমরা তো কত টাকা কত দিকে খরচ করি, বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে গ্রহণযোগ্য উপায়ে উপস্থাপনের জন্য কিছু খরচ করলে অনেক সুফল আসবে। তিনি বলেন, ২০২০ সালের এক্সপোতে অংশগ্রহণের জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু করা উচিত। মিলানোর অভিজ্ঞতা দুবাইতে কাজে লাগাতে পারলে অনেক ভালো কিছু করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন আবদুল মতিন।
এক্সপো মিলানো নিয়ে ইতালির স্থানীয় মিডিয়া এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় গত ছ’মাস যাবৎ অনেক সমালোচনা ছাপা হয়েছে। বিশেষ করে রেস্টুরেন্টগুলোয় অধিক মূল্যে খাবার বিক্রি করা, চড়ামূল্যে টিকেট বিক্রি করা এবং আয়োজকরা যথাসময়ে ভ্যেনুর কাজ শেষ করতে না পারার সমালোচনা হয়েছে ব্যাপক। তবে এক্সপোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা, শৃঙ্খলা এবং ইতালির শিল্পবোধ নিয়ে প্রায় সবাই প্রশংসা করেছে। কিছু কিছু পত্রপত্রিকা তাদের মন্তব্য কলামে প্রকাশ করেছে, এক্সপোর মূল উদ্দেশ্য মানুষের সাথে ভাঁওতাবাজি করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া। তাদের ভাষায়, এই মেলা করে বিশ্বের কোনো লাভ হয়নি। নিরাপত্তাহীন খাদ্য চাপ কমেনি। বরং মিলিয়ন মিলিয়ন ইউরো ব্যয় করে রসনা বিলাস হয়েছে এবং কিছু মানুষ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে। এতএত সমালোচনার মধ্যেও ২ কোটি দর্শনার্থীর টার্গেট পূর্ণ হয় এক্সপো শেষ হওয়ার অনেক আগে।
দুইটা ভালোলাগার খবর দিয়ে লেখা শেষ করি, এক্সপো মিলানোর বিশেষ দূত হিসেবে বিশ্ববরেণ্য অল্প ক’জন মানুষকে বিশেষ সম্মান দেয়া হয়। এই সম্মানিত মানুষের মধ্যে ছিলেন আমাদের মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি গত ৭ জুলাই এক্সপো মিলানোয় মূল বক্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তখন শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয় খবরটি হলো, গত ৩০ অক্টোবর ক্লাস এক্সপো হেরিটাজ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। মোট ৯টি ক্লাস্টারের মধ্যে রাইসসহ ৩টি ক্লাস্টার হেরিটাজ অ্যাওয়ার্ডের জন্য নির্বাচিত হয়। নির্বাচকরা বলেন, রাইস ক্লাস্টারের মধ্যে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের অপারেশন ম্যানেজার আবদুল মতিন ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন। তারা আবদুল মতিনের পারফরমেন্সে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এক্সপো মিলানোর জন্য বাংলাদেশ একজন যোগ্য মানুষকে খুঁজে পেয়েছে। জনাব মতিনকে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চসংখ্যক ওয়ার্ল্ড এক্সপোয় যোগদানকারী হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং তার হাতে ক্লাস এক্সপো হেরিটাস অ্যাওয়ার্ড ২০১৫ তুলে দেয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানে ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী রোমানো প্রদিসহ প্রায় ডজনখানেক বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:৫৮