আমার এক বন্ধু আছে। মিন্টু নাম। এসএসসি পরীক্ষার পর আর পড়েনি। বাবার তাঁতের ব্যবসায় যোগ দেয়। পৃথিবীর সবকিছুতেই ওর তুমুল আগ্রহ। আমি তখন আমি সবেমাত্র ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। ঢাকায় কোথাও থাকার জায়গা নাই বলে অনাবাসিক হয়েও হলে উঠেছি। হলে তুলেছে এক পলিটিক্যাল বড়ো ভাই। থাকি সূর্যসেন হলের গণরুমে। প্রতিদিন সকালবেলা অবধারিতভাবে গেস্টরুমে যাই। তারপর মিছিল নিয়ে মধু। এই করতে করতে আমাদের রুমের বেশ কয়জন দলের ফার্স্ট ইয়ারের নেতা বনে যায়। আর এর সুবাদে রুমে অস্ত্র চলে আসে। পয়েন্ট থার্টি টু বোরের। রাতে সেটা নিয়ে ছাদে যাই। দুর্মূল্যের গুলি। তাও মাঝে মাঝে ফুটায় কেউ কেউ। আবার সেফটি ক্যাচ লক করে ডামি মহড়া দিয়েই কেউ কেউ খুশি হই। রাতে তোষকের নিচে চালান হয় সেটা। কখনো কখনো চকচকে চাপাতি সঙ্গী হয় রাতের ঘুমের। আমাদের বেডে চাপাতিও ঘুমায়। বাড়ি গেলে বেশ ভাব নিয়ে এ গল্প বন্ধুদের বলি। আমাদের এই উন্মুল জীবন দেখতে বেশ উৎসাহী হয় মিন্টু। একদিন চলে আসে হলে। তোদের কী মুক্ত স্বাধীন জীবন- ক্যাম্পাসে আমাদের জীবনযাত্রা দেখে মিন্টু এই মন্তব্য করে দুদিনের মাথায় বাড়ি ফেরে। পরের রাতে অ্যান্টি গ্রুপ আমাদের রুম ভাঙ্গচুর করে। তারও চারদিন পরে আমরা আবার হলে উঠি। রুম থেকে অনেক জিনিষই খোয়া গেছে। সাজাহান মিনা স্যারের ফিন্যান্স বইটি চাপাতির কোপে দ্বিখন্ডিত দেখি। মনে পড়ে, আমার বেডের নিচেই একটি চাপাতি রাখা ছিল।
পরে সরকার বদল হয়। আমরাও কেটে পড়ে ছাইপাশের পলিটিক্স থেকে। তারও বেশ পড়ে পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করি। দেশের খ্যাতনামা অনেকের সাথেই চিন -পরিচয় হয়। খাতিরও জমে কারো কারো সাথে। খাতিরের এ গল্প গ্রামে গিয়ে বন্ধুদের বলি। মিন্টু একটু বেশিই আগ্রহ নিয়ে শোনে। এক বিকালে, এক বিখ্যাত অভিনেত্রীর বাসায় গেছি ইন্টারভিউ নিতে। এমন সময় মিন্টুর ফোন। বলে, তুই কই, আমি তোর হলে আইছি। রাতে ফিরে মিন্টুর সাথে মোলাকাত করি। মিন্টু বলে তোদেরই জীবন রে। বিখ্যাত লোকদের সাথে উঠবস। আর আমাদের জীবন---- মিন্টুর কথা আমার কানে যায় না। আমি অন্য চিন্তায় মগ্ন। পকেটে তো টাকা নাই। মিন্টুকে কিভাবে রাতে খাওয়াই।
এই তো প্রায় বছর খানেক আগের ঘটনা। অফিসের কাজে চট্টগ্রাম গেছি। আমাদের দলের সাথে দেশের বেশ কয়জন উঠতি মডেল ও অভিনেত্রী। আগ্রাবাদ হোটেলে প্রোগ্রাম। প্রোগ্রামের একফাঁকেই বন্ধু রাজ্জাককে ফোন করি। ও পড়ে চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে। টিউশনির কারণে হলে না থেকে শহরের জিইসি মোড়ের দিকে থাকে। রাজ্জাক চলে আসে। প্রোগ্রাম শেষে আমাদের সাথেই হোটেলে ফেরে। হোটেলে আসতে আসতে রাজ্জাক বলে, মামা, তোরা আসিস বেশ সুখে। তারকারাও তোদের কী দাম দেয়। রাজ্জাকের কথা শুনি কী শুনি না। জানালা দিয়ে দেখি, একজন পথচারী ভিক্ষুককে দু'টাকার নোট দেয়। দু'টাকার ছেঁড়া নোটটি সে বেশ তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকিয়ে দেখে। তারপর ছুঁড়ে ফেলে দেয়। দু'টাকার নোটটি বাতাসে ভেসে একটি মাইক্রোর চাকার নিচে গিয়ে পড়ে। মাইক্রো বাসটি তা গুঁড়িয়ে দিয়ে চলে যায়। আর বারে বারে মনে হয়, আমার জীবনটাও তো এমন। ছেঁড়া, তালি দেয়া দু'টাকার মতো। এই চলছে আর কি। চলে যতোদিন।