শুক্রবার। বিকেল গড়িয়ে সময়ঘড়ি চলছে সন্ধ্যার পানে। প্রথামাফিক পশ্চিম আকাশ লাল আভায় ভরে যাওয়ার কথা। কিন্তু আকাশ জুড়ে যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির উৎসব। এই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে উপস্থিত হয়েছি টিএসসিতে। একজনের আসার কথা। এখনো আসেনি। তার ফোনটিও বন্ধ। বিরক্তি নিয়ে বসে আছি। পাশেই একটি দল আড্ডা দিচ্ছে। আড্ডায় তিন ছেলে, দুই মেয়ে। আড্ডায় নানা কথা, প্রাণের উচ্ছ্বাস স্পষ্ট। অন্যজনের কথায় কান পাতা আমার ধাতে নেই। তবুও ওদের প্রাণের উচ্ছ্বাসে, কথার তোড়ে ভেসে যাওয়া ঠিকই মনোযোগ কাড়ে। দেখি ওদের প্রাণের উৎসব। কথার মুখরতা।
আরো একটু সময় যায়। গাঢ় সন্ধ্যা গিলে ফেলে চারপাশ। তবুও তার কোনো খবর নাই। বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ি। সোজা রুমে। হাতে তেমন একটা কাজ নাই। কী করা যায়! মোবাইলে এফএম ছাড়ি। এখানেও কথার উৎসব। রেডিও আমারে দুই আরজে আখিঁ, চৈতি কথা বলেই যাচ্ছে। খই-এর মতো করে ফুটছে কথারা, শব্দরা। কান পেতে শুনি ওদের কথামালা। শুনতে শুনতে কালি ও কলমের একটি পুরানো সংখ্যায় চোখ বুলায়। দেখি ভাষা নিয়ে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বিশদ একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেখানে লেখা, পৃথিবীর মোট ভাষার অর্ধেকসংখ্যক আজ বিলুপ্তির পথে। প্রতিবছর হারিয়ে যাচ্ছে কিছু কিছু ভাষা। আফ্রিকায় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকুল অঞ্চলের তিন-চার হাজার ভাষার মৃত্যু ঘটতে পারে অচিরে। আজকের ছয় বা দশ হাজার ভাষার জায়গায় একবিংশ শতাব্দী শেষে হয়তো টিকে থাকবে তিনশ’ ভাষা।
কী সাংঘাতিক কথা। তাহলে কী এইসব ভাষায় আজ যারা কথা বলে, একবিংশ শতাব্দী শেষে তাদের নিজস্ব ভাষায় প্রাণের উৎসব থেমে যাবে। এই যে আমরা মেতে উঠছি প্রাণের উৎসবে, ক্ষণে ক্ষণে, কিন্তু তারা কী আপন মাতৃভাষা ছেড়ে অন্য ভাষায় এভাবে মেতে উঠতে পারবে। লেখায় দেখা পাই, নাইজেরিয়া ও ক্যামেরুনের এক সীমান্তবর্তী গ্রামের ৮৭ বছরের এক বৃদ্ধার। তিনি কথা বলেন বিকইয়া ভাষায়। বাবা-মায়ের কাছে তিনি শিখেছিলেন এ ভাষা। কিন্তু জীবনের শেষবেলায় এসে এ ভাষায় ভাব প্রকাশ করার মতো আর কেউ ছিল না। এজন্য তিনি নিরবে কেঁদে বুক ভাসাতেন।
আমাদের দেশের সৃষ্টি ভাষার ভিত্তিতে। রক্তের বিনিময়ে। পৃথিবীর একমাত্র আমরাই মাতৃভাষার জন্য আতœহুতি দিয়েছি। পৃথিবীর বিপুল সংখ্যক লোক এই ভাষায় কথা বলে। এ হিসেবে হয়তো বাংলা ভাষার বিলুপ্তির আশংকা অমূলক। তবে বাংলা ভাষার ওপর এখন যে হারে হিন্দি ও ইংরেজির আক্রমণ চলছে তা ভাবনার বিষয় বৈকি। দেখা যাক, ভবিষ্যত আমাদের উত্তরপ্রজন্মকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায়।