আসলেই, হাদিস অসাধারণ। বাস্তবে দেখলাম, একটা উপন্যাস পড়ার চেয়ে, একটা চমৎকার গল্প পড়ার চেয়ে এমনকি মুভি বা ডকুমেন্টারি দেখার চেয়ে কিছুক্ষণ বসে কয়েকটা হাদিস পড়া বেশি থ্রিলিঙ, উপভোগ্য।
নিয়মিত হাদিস পড়ার সাথে বর্তমান সময়ের তুলনা করতে গেলে আমরা বলতে পারি ছেলেদের সিরিজ দেখা বা মেয়েদের সিরিয়াল দেখার কথা। মিলটা হল, পরিপ্রেক্ষিত এক, চরিত্রেরা এক, প্রতি ক্ষেত্রে নতুন নতুন অবস্থা। তফাৎ হল, এখানে বিশ্বাস কাজ করে। ফিকশন নয়। ন্যায় কাজ করে, ক্ষয় নয়।
আমাদের গুরুজনেরা যে প্রতিদিন সকালে কুরআন বা হাদিস পড়তেন না? এর একটা অসাধারণ ইফেক্ট রয়েছে। আমরা বেশি ব্যস্ততার ভাণ ধরে শুধু বিশ্বাসের খোলসটুকু নিয়ে দুনিয়া ফেরি করে ফিরি। আম জাম কলার সাথে সাথে নিজেকেও বেচি। আমাদের গুরুজনেরা ভাল ছিলেন, সুখে ছিলেন, শান্তিতে ছিলেন; কারণ তাঁরা প্রতিদিন ভোরে উঠে ওইটুকু সময় কুরআন বা হাদিস পড়তেন যেটুকু সময় আমরা এখন সিরিজ বা সিরিয়ালে দিই। তাদেরও ব্যস্ততা ছিল, আমাদেরও ব্যস্ততা আছে। তাঁদেরও ফুরসত ছিল না, আমাদের তো নেইই।
তফাৎ? তাঁরা সুখী ছিলেন, পরিপূর্ণ ছিলেন, সদাহাস্য ছিলেন। তাঁদের ¯েœহভরা হাসি এত বেশি আসতো, যে, তাঁদের মুখটাই শুধু হাসিমুখ হয়ে গিয়েছিল। কারণ, তাঁরা দিনের শুরুটাই করতেন অসাধারণ নিউট্রালাইজার দিয়ে। কম্পাস যেমন ক্যালিব্রেট করতে হয় না? থার্মোমিটার যেমন প্রতিবার তাপমাত্রা দেখার পর ঝাঁকিয়ে ঠিক করে নিতে হয়, তেমনি করে আমাদের মন-দেহ-মগজকে প্রতিদিন বিক্ষিপ্ততা থেকে গুটিয়ে নিতে হয়। ঠিক রাতে শোয়ার আগে বিছানা ঝেড়ে নতুন করে বিছানোর মত। পি এইচ এর মান সব সময় নিউট্রাল রাখতে হয়।
প্রতিদিন আমাদের মন জঞ্জালে ভরে ওঠে। আমাদের চারপাশে আমরা এমন সব মানুষকে দেখতে পাই, যারা আদর্শ নয়। যারা প্রমাণ নয়। যারা সত্যের মাপকাঠি নয়। এই অস্বাভাবিকতা দেখতে দেখতে আমাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। অসুস্থতা প্রাকৃতিক হয়ে ওঠে। শঠতা, মিথ্যা, ধোঁকা, খারাপ ব্যবহার, উচু গলায় কথা, অশান্তি, খিস্তি, খেউড় এবং সবচে বড় কথা অবিশ্বাস ও ক্রুরতা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। যখন অস্বাভাবিক কারো কাছে স্বাভাবিক হয়ে যায়, তখন সে নিজে অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে।
যখন টেনশন, অবিশ্বাস, চাপ এবং কাঠিন্য আমাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে যায়, তখন হাসিটা আর কোথায় থাকবে? তৃপ্তি, মমত্ব, অনুভব কোথায় থাকবে? মনতো ক্যালিব্রেট করে ঠিক জায়গায় আর নেই। একদিন, দুদিন, তিনদিন। মনতো সরতে সরতে পিশাচ হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমাদের পুরনোদিনের গুরুজনরা যা করে গেছেন, সেটা খারাপ কিছু নয়। একটা সিরিয়ালের মত করে দিনে মাত্র বিশটা মিনিট সকালবেলা হাদিস বা কুরআন পড়া। মন-মগজ ধর্মচেতনায় আলোড়িত, পরিতৃপ্ত। বাকী দিনটুকুতে সেই ভাবনা ও তৃপ্তির অনুরণন।
আশপাশে প্রমাণ মানুষ নেই? হাদিসে তো আছে। তারা তো কল্পনার চরিত্র নন, হাদিস কোনও পুরাণ নয়। এক সময় কয়েকটা গবেষণায় উঠে এসেছিল, বাংলাদেশের মানুষরা এই পৃথিবীর সবচে সুখী। এখনো গবেষণায় উঠে আসে, ধর্মচেতনা সম্পণœ মানুষরা সবচে বেশি সুখী, তৃপ্ত, শারীরিকভাবে সুস্থ এবং দীর্ঘজীবি। কীভাবে? তাদের মন-মগজ প্রতিদিন সবচে শুভ’র দ্বারা ক্যালিব্রেট হচ্ছে।
হায়, জীবন একটাই। এবং আমরা বিকিয়ে দিচ্ছি জুয়াড়ির মত এই একমাত্র জীবনটাই। আনক্যালিব্রেটেড মন একটা মাতাল হাতীর চেয়ে কোন অংশে কম বিদ্ধংসী নয়। ধ্বংস করে নিজেকে, সম্পর্ককে, নিজের সুস্থতাকে, এবং সবকিছুকে। দিনশেষে এটাই নরম্যাল। অথচ এটা নর্ম হওয়ার কথা ছিল না।
হাদিস পড়তে নিলে সেই ১,৪০০ বছর আগে মানবকূলে আসা সর্বশ্রেষ্ঠ সত্ত্বার জীবন্ত কাহিনী চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
সেই মহান সত্ত্বা, কখনো তাঁর গাধার পিঠে চড়ে পেছনে বসা জনকে বলছেন, ‘হে জাবের!’
জাবের রা. বলছেন, ‘লাব্বাইক, ইয়া রাসূলআল্লাহ্ দ.!’
কখনো কাসওয়া উটের পিঠে বসে তেইশ বছরে বিজিত মক্কায় বলছেন, রেখে গেলাম দুটা বিষয়। কুরআন ও আহলে বাইত।
কখনো গাছের তলায়, কেমন সেই খেজুর গাছ? প্রথমদিকে শুধু অক্ষর ভাসে, আস্তে আস্তে চিত্র গড়ে ওঠে মনের ভিতর। হাদিস তো সেই অনন্য সত্ত্বার আনাগোনার গাঁথা। তাঁর দ. গভীর রাতে বেরিয়ে এসে আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রা. কে জড়িয়ে ধরে দোয়া করার কথা।
আবু বকর, উমার, উসমান, আলী, ফাতিমা, হাসান, হুসাইন, আব্বাস, হামজা রিদ্বওয়ানুল্লাহি তাআলা আলাইহিম আজমাঈন হলেন এই কথাচিত্রের চরিত্রেরা।
তবে হাদীস পড়ার বিষয় আছে কিছু। বাংলা বা ইংরেজিতে সাধারণত আমরা হাদিস বলতে যা পাই তা হল অপভ্রংশ। হাদিসকে রিভাইজ করতে করতে একেবারে কেমন যেন করা হয়েছে। কেন করেছে এরা, এরাই জানে।
আরবি হাদিস বুঝতে খুব বেশি কষ্ট হয় না, একটু চর্চা থাকলেই হল। কম্পিউটারে আরবি শেখার কোনও প্রোগ্রাম ইন্সটল করে নিলেই এক দু সপ্তাহ পর থেকে বোঝা সম্ভব। থ্রিলটা গড়ে ওঠে তখন থেকেই।
আর হাদিস পড়ার জন্য চশমা চাই। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির সঠিক লেন্সের চশমা। লাল নীল হলুদ রঙে রাঙানো চশমা নয়, যা দিয়ে সব একই রঙা দেখা যাবে। বরং রঙহীন মমত্বের চশমা। বিশ্বাসের চশমা, ভালবাসার চশমা, মানবতা ও সর্বকালোর্দ্ধতার চশমা। আমাদের ভেস্তনেশা আমাদের ভবিষ্যতকে এবং মনেবৃত্তিকে পুরোপুরি ভেস্তে দিয়েছে। হাদিস বলতে আমরা কোন কাজে কয় গন্ডা সওয়াব, কয় পাল্লা জান্নাত, কী করলে কত্ত গুনাহ্, কী করলে শরিয়াত সম্মতভাবে কাকে কয়টা দোররা মারা যাবে এই হিসাব অ্যাত্তো অ্যাত্তো কষেছি, যে, আমাদের মনেবৃত্তি হয়ে গেছে পুরোপুরি স্বার্থপর গোমড়ামুখো দোকানদারের মত- যে শুধু পাল্লার দিকে তাকায়, নোটের দিকে তাকায়, ভাঙতি পয়সার দিকে তাকায় এবং মালের দিকে তাকায়, তাকায় না কেবল নিজের দিকে এবং ক্রেতার মুখটার দিকে।।
হাদিস বলতে আমরা শুধু জান্নাতের ঘ্রাণই চিনি, জাহান্নামের আগুনই চিনি, সওয়াবের বস্তাই চিনি এবং গুনাহের বোঝাই চিনি। আদতে তাই হাদিস বলতে আমরা শুধু আমাদের নিজেদেরকেই চিনি। নিজ স্বার্থকে। ওই দোকানদারের মত, যে নিজ স্বার্থকে চিনতে গিয়ে নিজের দিকে তাকানোর সময়টাও পায়নি, ক্রেতার মুখের দিকে তাকাবার তো প্রশ্নই ওঠে না।
হাদিস এর বাইরের কিছু। এর বাইরে হাদিসে চরিত্র আছেন। এই সুমহান চরিত্রের দিকে তাকাবার ফুরসৎ আমাদের স্বার্থান্ধ চোখ কখনো দেয়নি। কুরআন ঠিকই বলে দিয়েছেন, উসওয়াতুন হাসানাহ্ । সর্ব্বোত্তম আদর্শ। ফাক্বাদ্ আত্বা আল্লাহ্ । নিশ্চই তাঁর আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্য। হাদিসে আমরা সবদিকে নজর দিই, শুধু যাঁকে নিয়ে হাদিস তার দিকে তাকানোর ফুরসতটা আমাদের প্রিপ্রোগ্রামড মন দেয় না। হাদিস মানে তো আবু বকর রা.’র ক্যারেক্টার। যিঁনি নবীদের পর সর্বশ্রেষ্ঠ। উমার রা.’র ক্যারেক্টার, নবুয়ত চলতে থাকলে যিঁনি নবী হতেন। উসমান রা.’র ক্যারেক্টার। যিঁনি সর্ব্বোচ্চ খোদাসচেতন, তাক্বওয়াবান। আলী রা.’র চরিত্র, যিঁনি নবীজী দ.’র সবচে প্রিয়। ফাতিমা, হাসান, হুসাইন রা.’র চরিত্র, যাঁরা জান্নাতের সবার আদেশদাতা, নেতৃস্থানীয়।
আমাদের পোড়ামনে এঁদের কোনও স্থান নেই। তাই হাদিস আমাদের কাছে নিকষ কালো নিরস একটা ভয়ের বস্তু। হ্যা, রাসূল দ. কে সবকিছুর চেয়ে ভাল না বাসলে কেউ বিশ্বাসীই নয়, এটা আমরা থিওরিতে মানি, কিন্তু
তাঁর দিকে তাকানোর সময় যে আমাদের নেই! আমরা হাদিসটা শুনি, সেখানে কোন্ ক্ষমার কথা বলা হয়েছে সেটা টুকে নিই, সেই কথা বলার সময় মহান রাসূল দ.’র চেহারা কেমন হয়েছিল সেই লাইনটা তো পড়িইনি। বাসবো ভাল কেমন করে? অনুবাদক কেটে বাদ দিয়ে দিয়েছে, নাহয় সম্পাদক, নাহয় ছিল, আমিই পড়িনি। সম্পর্ক জান্নাতের সাথে হয়েছে, জাহান্নামের সাথে হয়েছে, পুরস্কারের সাথে হয়েছে, শাস্তির সাথে হয়েছে, শুধু রাসূল দ. ও তাঁর নিকটজনদের সাথে হয়নি।
তাঁরা আমাদের কাছে অস্পৃশ্য, অতি মহান, তাই কাছের কেউ না। অথবা তাঁরা একদম সাধারণ, আমাদেরই মত, তাই মূল্যবান কেউ না। যেভাবেই হোক, তাঁরা আমাদের থেকে অনেক দূরের কেউ। যেন তাঁরা আমাদের কেউ না। যেন তাঁরা কোনদিন ছিলেন না। যেন তাঁদের থাকা না থাকার কোনও গুরুত্ব নেই। হাদিস তখনি কর্কষ, বিতৃষ্ণাময়, এলেবেলে, দুর্বোধ্য। এবং আমরা প্র্যাক্টিক্যাল।
না। বরং হাদিস অসাধারণ, কারণ হাদিস হল আমার ও আমার নবীর সাথে সংযোগ স্থাপনের একমাত্র মাধ্যম। কুরআনে অন্য নবীদের ঘটনা বর্ণিত আছে। আমাদের রাসূল দ.’র ঘটনাগুলো বর্ণিত সবচে বেশি, কিন্তু তা ইঙ্গিতে। তা শানে নুযুল জানা না থাকলে কখনোই বোঝা যাবে না। দৃশ্যত কুরআন যেখানে অন্য মহান নবী ও রাসূলগণের উপাখ্যান সেখানে হাদিস হল আমাদের মহান নবী ও তাঁর নিকটজন, যাঁদের ভাল না বাসলে যাঁদের সম্মাননা না করলে নুবুয়তের হক্ব আদায় হয় না, তাঁদের কথাচিত্র।
হাদিস ওই সময় পর্যন্ত অস্পষ্ট কথা হয়ে রইবে যে পর্যন্ত রাসূল দ. ও তাঁর নিকটজনদের ভালবাসার চিত্র মনে অঙ্কিত না হয়। রাসূল দ. দূরের কেউতো নন, তিনি তো বিশ্বাসীর সবচে কাছের জন। কুরআনই তো বলছে, এই নবী দ. বিশ্বাসীদের কাছে তাদের নাফস থেকেও নিকটতর। আরে রাসূল দ. যে পর্যন্ত সবচে কাছেরজন না হবেন, সে পর্যন্ত তিনি সবচে প্রিয় কীভাবে হবেন? আর তিনি দ. যে পর্যন্ত সবচে প্রিয় না হচ্ছেন সে পর্যন্ত কীভাবে আমরা বিশ্বাসী হব? এটাইতো শর্ত, অলঙ্ঘ্য শর্ত, যার ব্যাপারে ইসলামের কোনও ফির্কায় কোনও দ্বিমত নেই।
হাদিস শঙ্কিতজনের জন্য নয়। শঙ্কিতের শঙ্কা, কম্পিতের প্রকম্পন, বিতৃষ্ণের তৃষ্ণাহীনতা এবং অবিশ্বাসীর অবিশ্বাস আরো বাড়ায় হাদিস। হাদিস প্রেমিকজনের জন্য। মমতার্দ্রর জন্য। দুনিয়ার চাওয়া পাওয়া হিসাব নিকাশ স্বার্থ ধন-জন-মন-প্রাণ সব যে রাসূল দ.’র ভালবাসায়, তাঁর সাহাবা ও আহলে বাইতের ভালবাসায়, বিশ্ব মানবতার প্রতি মমত্বে, পুরো সৃষ্টি জগতের প্রতিটা প্রাণী-উদ্ভিদ-জড় এমনকি জাররা জাররা অণু পরমাণুতে সঁপতে পারবে, এই সর্বঅনুভবের আলোকে মহান একমেবাদ্বিতীয়ম্ সর্বশক্তিমান একক উপাস্য আল্লাহতে পরিপূর্ণ সমর্পিত হতে পারবে, সে-ই তো একমাত্র বিশ্বাসী, আর তারই জন্য হাদিস।
ঈমানের মূল ইয়া আইয়ুহার রাসূল দ. কে যে বিশ্বাসের আয়নায় দেখার চেষ্টা করেছে, তার জন্য পরম শিহরনের ক্ষেত্র হয়ে দেখা দেবে হাদিস। সে হাদিসে রাসূল দ.’র অনুভব পাবে। রাসূল দ.’র হাসি, রাসূল দ.’র কান্না, রাসূল দ.’র ক্ষমা, মমতা, উদারতার স্পর্শ পেয়ে কেঁপে কেঁপে উঠবে।
হাদিস একটা ইনফিনিট ফ্লাক্সের মত। যত পড়া, তত মজা। তরতাজা মজা। যত পড়তে থাকা, তত যুক্ত করে করে নিজেকে তাঁর চেতনায় বিলীন করা।
হাদিস সাগর সত্য বটে। তবে সে সাগরের পাড়ে কে কী তুলছে তা দেখার বিষয়। কেউবা মুক্তা আনে নিচ থেকে, কেউবা পাড়ে ঝিনুক কুড়ায়, কেউবা মাছ তোলে তো কেউ ডুবে মরে। কেউ কিন্তু পুরো সাগরটাকেই নিয়ে নেয়। কীভাবে! পাড়ে বসে সকাল দেখে, দুপুর দেখে, রাত। হাঁটুজলে নামে, বুকপানিতে, একটু গভীরে সাঁতরে আসে। কিছু নিতে সে আসেনি এবং আসেনি কিছু দিতে, ফলাফল, পুরো সাগরই তার। দেয়ানেয়ার বাইরে গিয়ে অবগাহনের জায়গা হল হাদিস সাগর।
ওইযে, কেউ হাদিসে বিজ্ঞান খোঁজে, কেউ খোঁজে শরিয়াতের ফয়সালা, কেউ সমাজনীতি, কেউ রাজনীতি, কেউ অর্থনীতি, কেউ শাসন তো কেউ জান্নাত জাহান্নাম। কেউ হাদিসকে মোহনা, উপসাগর, মহাসাগরে বিভক্ত করে সহিহ হাসান গারিব খবরে ওয়াহিদ ও দ্বয়িফের বেড়াজাল টেনে।
সাগর নিয়ে ব্যবসা করাও কাজের কথা, তবে কিনা, তাতে পুরো সাগরটা নিজের করে পাওয়া যায় না। যে নিজের করে পুরোটা পেতে চায়, সে কিছু নিতে এবং দিতে আসে না সাগরপাড়ে। হাদিস নুবুয়্যতের সাগর, রিসালাতের সাগর, হাদিস মানেই ইসলাম। কুরআনের একটা একটা বাণী বোঝা গেছে শুধু হাদিস থেকে। হাদীস না থাকলে কোনদিন আমরা জানতেও পারতাম না, কোন্ আয়াতটা কেন নাজিল হয়েছিল এবং সেই আয়াতের ফলে ইসলামে কী সিদ্ধান্ত এসেছিল।
সাগর নিয়ে বাণিজ্য কখনো বন্ধ হবে না, তাই বলে বাণিজ্য বন্ধ করার নাম করে নিজেই বণিক সাজার দরকার নাই। সাম্পান নিয়ে সাগরপাড়ের ময়লা উপভ্রংশ যে জিনিস সেই লবণ ফেরি করার দরকার নাই। পায়ের কাপড় কতটুকু গোটাতে হবে, হাতের কোন্ পর্যন্ত রোমকূপ ধুতে হবে, এই কচলাকচলি কম হয়নি। সাগরকে আমরা অযু করার পানিতে পরিণত করেছি।
এইসব রহস্য আমাদের পূর্ববর্তীরা জানতেন। গুরুজনরা জানতেন। পথপ্রদর্শকরা জানতেন। কিন্তু নিয়মের কচকচির ভিতরে আসলটুকু হারিয়ে গেছে। প্রেমিকজনা চোদ্দশ বছর ধরেই হাদিস নিয়ে মমত্বের চাষ করেছেন, তবে তাঁরা বণিক না হওয়াতে তাঁদের সওদাও হয়নি, বিকিকিনিও হয়নি। নাম তাঁদের রুমী, জামী, সাদী, আবদুল ক্বাদির, হাসান মুঈনুদ্দিন। তাঁরাও হাদিসেই ডুবে ছিলেন, কিন্তু এর অনুসিদ্ধান্তগুলো সওদা করে বেচেননি। অনুভব বিক্রি করা যায় না, অনুসিদ্ধান্তই শুধু বিক্রি করা যায়। হাদিস পড়ে জামা প্যান্টের হুকুম আহকাম তো এক লহমায় বলে দেয়া যাবে, মনে কী শিহরণ এলো, মানবতার ভালবাসায় চোখ কীভাবে ভিজে উঠল, রাসূল দ.’র পরিত্রাণের নিশ্চয়তায় মন কীভাবে শঙ্কামুক্ত হলো, তা তো বলে দেয়া যাবে না। মনে কীভাবে সবকিছু প্রতিস্থাপিত হয়ে শুধু আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল দ. এবং তাঁদের মহান পরিত্রাণের বিশ্বমানবিক অনুভব জাগ্রত হল, তা কখনোই বলে দেয়া যাবে না। হাদিস যেমন অস্পৃশ্য, হাদিসের অনুভবওয়ালারাও তেমনি অস্পৃশ্য রয়ে গেছেন।
তাই হাদিস পড়ার আগে আক্বিদার ঘোরপ্যাঁচ, ঈমানের মারপ্যাঁচ, মাসআলা ফাতওয়া আর ফয়সালার কচকচ চোখ বন্ধ করে ঠেলে একদিকে সরিয়ে রাখতে হবে। এরপর, ‘প্রিয় হে, আমি এলাম! আমি অবুঝ, তবু এলাম।’ বলে ডুব দিতে হবে তাঁর মধ্যে, যিঁনি এসেছেন আমাদের জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ১১:১২