somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রথম পর্বঃ প্রিন্স অফ পার্সিয়া

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ২:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দ্বিতীয় অংশঃ

আমি যখন পারস্যে সেই সময় অস্টিয়েজ তার প্রতি আনুগত্যের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হারপাগাসকে রাতের ভোজনের জন্য নিমন্ত্রণ করেন। পাচন সমস্যাজনিত রোগে ভোগার দোহাই দিয়ে অস্টিয়েজ গুরুপাক দ্রব্যাদি গ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত রাখেন৷ হারপাগাসের সামনে পরিচারকরা একের পর এক মাংসজাতীয় আহার্য উপস্থাপন করছিল। অস্টিয়েজ হারপাগাসকে অনুরোধ করেন যেন সে প্রতিটি খাদ্যের স্বাদই একটু করে হলেও চেখে দেখে। রাজার আদেশ শিরোধার্য, হারপাগাসও কৃতজ্ঞতার সাথে সে অনুরোধ রক্ষা করে চলছিল। সবশেষে তার সামনে একটি ঝুড়ি পরিবেশন করা হয়। ডালা খুলতেই একটি কাটা মস্তক হারপাগাসের কোলে গড়িয়ে পরে।

“হারপাগাস, তুমি কি বুঝতে পারছ এতক্ষণ কি খেলে?”

হারপাগাস নিজেকে শান্ত রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল, “জ্বি মহারাজ”।

“আমার আদেশ পালন করতে না পারার শাস্তি কি তা তো তুমি জানতে হারপাগাস৷ সম্ভবত তোমার মন নরম ছিল। নরম মনের সেনাপতির অধীনে সৈন্যদের যুদ্ধে কি দশা হয় তা নিশ্চয় জানো৷ আমি নিশ্চিত আজকের পর তোমার মন প্রস্তরের ন্যায় কঠোর হবে৷ সহধর্মিণীকে নিয়ে ছুটি কাটিয়ে এস। উত্তরে যাও, সেখানে আমার নিজস্ব ভবন আছে সেখানেই ওঠ। ওদিকের আবহাওয়াও চমৎকার, দক্ষিণের চেয়ে অনেক ভাল। ফিরে এসে প্রধান সেনাপতির পদ গ্রহণ করবে। এটাই তোমার আনুগত্যের পুরস্কার”।

পুত্রশোক চেপে অস্টিয়েজকে তার অনুগ্রহের জন্য ধন্যবাদ দিয়ে পরের দিনই হারপাগাস উত্তরের দিকে রওনা দিল। একবাটানাতে ফেরার পর আমার উদ্দেশ্যে তার লিখে যাওয়া পত্র হাতে পৌছানোর পর পুরো ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হই। এই পাপের ভাগীদার আমি নিজেও, হারপাগাসের পরিবারেরও বিপদ হতে পারে এ কথাটা আমার মাথায় আসেনি। পৌত্রকে ফিরে পাবার পরও অস্টিয়েজ এরকম একটা কাজ করতে পারেন তা বুঝতে পারিনি। ঈশ্বর ধৈর্যশীল, আমাদেরও উচিৎ ক্রোধকে প্রশমিত করে ধৈর্য ধারণ করা।

টানা তের বছরের অবরোধের পর নেবুচাঁদনেজার টায়ারের প্রতিরক্ষা ভাঙ্গতে সক্ষম হলেন। টায়ার আবারো ব্যাবিলনের কর্তৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য হল। টায়ারকে শায়েস্তা করে নেবুচাঁদনেজার পুরনো-নতুন দেনা-পাওনা মেটানোর জন্য মিশর অভিমুখে রওনা দেন। অস্টিয়েজও পুরনো ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার নিমিত্তে ম্যান্ডেন ও কুরুশকে একবাটানাতে আমন্ত্রণ করেন।

ম্যান্ডেন যখন একবাটানাতে প্রবেশ করে তখন রাজ দরবার চলছিল। ভ্রমণক্লান্ত মা-পুত্র প্রাসাদে না যেয়ে সোজা রাজদরবারে উপস্থিত হয়। গেল বার পরিস্থিতি এত দ্রুতই রঙ বদলাচ্ছিল যে কুরুশের পক্ষে মিডিয়ার রাজদরবারের প্রতাপ ও রাজপ্রাসাদের শোভা-সৌষ্ঠব অবলোকন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। মায়ের সাথে রাজদরবারে ঢোকার পর তার চোখ কপালে ওঠে। বার বছর বয়স পর্যন্ত সে দারিদ্রতা দেখেছে, পরের এক বছর পারস্যে কাটানো সময়ে দারিদ্রতা ছিল না, ছিল শুধুই গড়পড়তা স্বচ্ছলতা। হঠাৎ করেই সামনে জমকালো বাতাবরণ উন্মোচিত হওয়ায় পৃথিবীর আরেক রূপ সম্পর্কে তার জ্ঞানের নতুন দুয়ার খুলে যায়। রাজ দরবারে ঢোকার পর সে তার মুখ খোলে, “মাতামহ যে এত সুদর্শন তা আগে বলনি তো মা!

ছেলের কথা শুনে ম্যান্ডেনও ঠাট্টা করে বলল, “কে বেশি সুদর্শন কুরুশ? তোমার পিতা নাকি মাতামহ?”

“আমার পিতা পারস্যের সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ, আর মাতামহ মিডিয়ার”। কুরুশের সপ্রতিভ উত্তরে পুরো রাজদরবারে হাসির রোল উঠল। গেল বছর প্রথম দর্শনেই সে সবার মন জয় করে নিয়েছিল, তার প্রতি স্নেহ উত্তরোত্তর বেড়েই চলছিল। শিশুসুলভ বাচালতা, উৎসুক হৃদয়, মিশুক স্বভাব সবাইকে তার দিকে আকর্ষণ করছিল- যেন সে আহুরামাজদার প্রদীপ, আমরা সবাই তার আরাধক। পারস্যের পরিবেশের তুলনায় মিডিয়ায় সবকিছুই তার কাছে নতুন, সব কিছুই যেন তার জানা চাই। শিক্ষক নির্বাচনে সে উচু-নিচু, ধনী-গরিবের ভেদ না করে উপযুক্ত ব্যাক্তিকেই গুরু হিসেবে বেছে নিল। কুরুশের এই আচরণ মিডিয়ার রাজতন্ত্রের পরিপন্থী হলেও কোন কারণে পৌত্র বেজার হোক অস্টিয়েজ তা চাননি। কুরুশের সবচেয়ে পছন্দের বিষয় হয়ে দাড়ালো ঘোড়সওয়ারী, মিডিয়ার ঘোড়া তাকে চরমভাবে মন্ত্রমুগ্ধ করেছে। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই, মিডিয়ার ঘোড়া পুরো পৃথিবীতে ঈর্ষনীয়। স্বাভাবিকভাবেই সে হারপাগাসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করল।

দিনের অধিকাংশ সময় অস্টিয়েজ পৌত্রের সাথে কাটাতেন। পৌত্রের যে কোন আবদার মেটানো তার বার্ধক্যের অন্যতম আনন্দে পরিণত হয়েছে। কুরুশও মাতামহকে আনন্দদানে চেষ্টার কমতি করত না। দেখতে দেখতে অনেক সময় অতিবাহিত হল। ম্যান্ডেন ও কুরুশের পারস্যে ফেরত যাবার সময় ঘনিয়ে এল। তাদের সম্মানে অস্টিয়েজ ভোজসভার আয়োজন করলেন।

মিডিয়ার ভোজসভা মানেই বিরাট আয়োজন। সারি সারি আহার সামগ্রী অতিথিদের সামনে পরিবেশন করা হল। খাবারের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে অতিথিরা কয়েক দিন ধরে খেয়েও শেষ করতে পারবে না। স্বভাবসিদ্ধভাবেই কুরুশ এত আয়োজন নিয়ে প্রশ্ন তুলল, “মাতামহ, এত খাবার কে খাবে?”

“তুমি খাবে কুরুশ”।

কুরুশ মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে বলল, “এত খাবার আমাদের বাড়ির সবাই মিলে খেয়েও শেষ করতে পারবে না…”

অস্টিয়েজ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, “এত আয়োজন তো শুধু তোমার জন্যই কুরুশ। তোমাকে সব চেখে দেখতে হবে”।

“মাতামহ, আমি দুই দিন ধরে চেষ্টা করেও শেষ করতে পারব না। কিন্তু পাচক মহারাজের এই পরিশ্রম বৃথা যেতে দেয়া ঠিক হবে না। মাতামহ, আমি কি এই সব খাবার নিতে পারি?”

“অবশ্যই, সবই তোমার”।

কুরুশ ভোজন কক্ষের পাহারাদারকে কাছে আসতে ইশারা করল, “দয়া করে রসুই ঘর ও প্রাসাদের পরিচারকদের সবাইকে আসতে বলুন”। আমরা অবাক হয়ে কুরুশের কীর্তিকলাপ দেখছিলাম। সব পরিচারকেরা উপস্থিত হবার পর আহার সামগ্রীগুলো তাদের মাঝে বিতরণ করা শুরু করল, “এটা আপনার জন্য কারণ আপনি আমার মাতামহের দেখা-শোনা করেন”, আবার কারো হাতে দামি তেজস-পত্র তুলে দিল, “এগুলো আপনার, আপনি আমার মাকে কি পরিমাণ সম্মান করেন তা আমি দেখেছি”, কারো কারো ক্ষেত্রে তার নিজের অংশের সুস্বাদু খাদ্য তুলে দিয়ে বলল, “আমাকে বল্লম ছোড়া শেখানোর জন্য ধন্যবাদ”। অল্প কিছু আহার সামগ্রী ছাড়া বাকি সব কিছু সেবক ও পরিচারকদের মধ্যে বিলিয়ে দিল। অস্টিয়েজ বেশ আমোদের সাথে কুরুশের বিতরণ পর্ব উপভোগ করছিলেন, “কুরুশ, এত খাবার খেতে পারলে না? পারস্য কি দুর্ভিক্ষপীড়িত যে সবাই অল্প আহারে অভ্যস্ত?”

“না মাতামহ, আমরা ততটুকুই খাই যতটুকু দেহের জন্য প্রয়োজন। আমাদের অতিরিক্ত আহারে অভ্যাস নেই”।

“কুরুশ, তুমি তো সবাইকে কিছু না কিছু দিলে, কিন্তু আমার প্রধান পরিচারককে তো কিছু দিলে না। অথচ সেই আমার সবচেয়ে বেশি খেয়াল রাখে”।

কুরুশ নাক-মুখ কুঁচকে বলল, “তাকে আমার পছন্দ নয়, কারণ আমি যখন তোমার কাছে যেতে চাই সে আমাকে এই বলে বার বার বাধা দেয় যে তুমি ব্যস্ত”।

প্রধান পরিচারক আপাতদৃষ্টিতে বিরক্তিকরই বটে, তার কাজই বিরক্তির উদ্রেক করা এবং সেই দায়িত্ব সে দক্ষতার সাথে পালন করে। অস্টিয়েজের যাবতীয় কাজের তদারকি করা তার কর্তব্য, অস্টিয়েজ ব্যস্ত থাকলে তাকে যেন কেউ কোনরূপ উপদ্রব না করে সেটাও তার খেয়াল রাখতে হয়। ব্যাপারটি কুরুশ অপছন্দ করবে সেটাই স্বাভাবিক।

“কিন্তু কুরুশ, সে ছাড়া তো আমি অচল। তার সেবা আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া সে তো এক প্রকার শিল্পীও। এত দক্ষতার সাথে আর কাউকে পানপাত্র ভরতে দেখেছ? এক ফোঁটা পানীয়ও বাইরে পড়ে না”।

“সে তো আমিও পারি,” বলে কুরুশ প্রধান পরিচারকের অঙ্গভঙ্গি নকল করে সমান দক্ষতার সাথে অস্টিয়েজের পানপাত্র মদিরাপূর্ণ করল। অনুকরণে তার সফলতা দেখে সবাই হেসে উঠল। অস্টিয়েজ বললেন, “তুমি তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করনি৷ মদিরায় বিষ আছে কিনা সেটা পরখ করে দেখবে না?”

“পরখ করার দরকার নেই, আমি জানি ওতে বিষ মেশানো আছে। জেনে শুনে বিষ পান করার কোন ইচ্ছা নেই আমার”।

অস্টিয়েজ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “না চেখে কিভাবে বুঝলে বিষ আছে?”

“মাতামহ, তোমার জন্মদিনে তুমি ও তোমার বন্ধুরা মদিরা পান করে নাচানাচি করছিলে। কারো গায়ে জামা-কাপড় ছিলনা। কে রাজা আর কেই বা প্রজা বোঝার কোন উপায় ছিলনা। তখনই বুঝেছি এ বিষের প্রতিক্রিয়া না হয়ে যায় না”।

“তোমার বাবা মদিরা পান করেন না?” একজন অতিথি জিজ্ঞেস করলেন।

“শুধু তেষ্টা মেটানোর জন্য করে যাতে বিষ তার বুদ্ধি লোপ করার সুযোগ না পায়”।

ভোজসভা প্রায় শেষের দিকে। বাকি অতিথিরা চলে গেলেও যারা অপেক্ষাকৃত নিকটতর তারা রয়ে গেছে। অস্টিয়েজ ম্যান্ডেনের কাছে আবদার করলেন সে যেন কিছুদিনের জন্য কুরুশকে তার কাছে রেখে যায়।

“কিন্তু বাবা, ওর প্রশিক্ষণের কি হবে? বাকি সহপাঠীদের থেকে পিছিয়ে পড়বে যে…”

“কুরুশের প্রশিক্ষণের ভার টায়ারসিয়াসের। তার চেয়ে ভাল প্রশিক্ষক পৃথিবীতে আর কোথায় পাবে?

আমিও হেসে ম্যান্ডেনকে আশ্বস্ত করলাম। ম্যান্ডেন জানে আমার তদারকিতে থাকলে কুরুশের কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই। তারপরও মায়ের মন সায় দিচ্ছিল না। পাছে কুরুশ মিড রাজপ্রাসাদের বিলাসিতায় আসক্ত হয় এই ভয়ে একা রেখে যেতে পারছিল না। সে কুরুশের মতামতের জন্য অপেক্ষা করছিল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অস্টিয়েজ কুরুশকে বলল, “তুমি যদি থাক তাহলে আমি কথা দিচ্ছি প্রধান পরিচারক কখনোই তোমার পথ রোধ করবে না। তুমি যা করতে চাইবে তা করতে পারবে। সওয়ারি করার জন্য মিডিয়ার সেরা ঘোড়াগুলো তোমাকে দেয়া হবে…”

ঘোড়ার কথা শুনে কুরুশ আগ্রহী হল। পারস্যে ঘোড়সওয়ারী করার সুযোগ হয়ে ওঠে না। পারসিকরা মিডদের মত ভাল ঘোড়সওয়ারও না। কুরুশ এই সুযোগ হেলায় হারাতে চাইল না। সে তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মা, অন্যান্য বিদ্যাতে আমি মোটামুটি পারদর্শিতা অর্জন করেছি, কিন্তু পারস্যে ঘোড়সওয়ারী করার সুযোগ নেই। আমি যদি এখানে এই বিদ্যা শিখে যাই তাহলে আমার সহপাঠীদের চেয়ে অনেক এগিয়ে যাব। আর মাতামহ তো বললেনই যে টায়ারসিয়াস আমাকে অস্ত্রবিদ্যা শেখাবে। ইতিমধ্যে আমি তার কাছে শিক্ষা গ্রহণ করা শুরুও করেছি। লক্ষী মা, মানা কোরো না”।

কুরুশের অন্যতম গুণ হল সে যা চায় তা আদায় করে নিতে পারে। ম্যান্ডেন ছেলের আরজি পূরণ না করে পারল না। পরদিন ম্যান্ডেন পারস্য অভিমুখে রওনা হল। আমি, সায়াজারেস ও হারপাগাস কুরুশের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিলাম। ধনুর্বিদ্যা দিয়ে আমি কুরুশের প্রশিক্ষণ শুরু করলাম। আমার প্রতিটি তালিম সে বুভুক্ষের মত গ্রহণ করত। আমার অনুরোধে অস্টিয়েজ বড় একটি বাগান ছোট-খাট বন্য প্রাণী দিয়ে পরিপূর্ণ করে রেখেছিলেন। কুরুশকে তীর-ধনুকের সাহায্যে সেগুলো শিকার করতে বলতাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল পারস্যে সে যে শিক্ষা লাভ করবে সেই আদলে প্রশিক্ষণ দেয়া। কিছুদিনের মধ্যেই সে ধনুর্বিদ্যায় বেশ সুদক্ষ হয়ে উঠল। অস্টিয়েজ নিয়মিত বন্য প্রাণী সরবরাহ অব্যাহত রাখলেও কুরুশের কুশলতা তাদের সংখ্যায় বাড়তে দিত না। অল্পদিনেই সে ঘোড়সওয়ারীতেও সমান পারদর্শীতা অর্জন করে। খুব তাড়াতাড়িই সমবয়সীদের ছাড়িয়ে সায়াজারেসকে টক্কর দেয়ার বিদ্যা সে পেটে পুরে ফেলে। বাগানে বন্য প্রাণীর সংখ্যা কমে আসছিল। ছোট প্রাণী শিকার করে কুরুশও একঘেয়েমিতে ভুগছিল। একদিন আমার কাছে অনুরোধ করে যাতে তাকে জঙ্গলে শিকারে নিয়ে যাওয়া হয়।

“তোমার মাতামহ অনুমতি দেবেন না, কুরুশ। জঙ্গলে শিকারে ঝুঁকি আছে। তাছাড়া তোমার কিছু হলে ম্যান্ডেনকে আমি কি জবাব দিব?”

কুরুশ নাছোড়বান্দার মত বলল, “আর কতদিন খরগোশ শিকার করব? যুদ্ধে তো আর বিপক্ষের সৈন্যরা ঝোপের আড়ালে আমার জন্য অপেক্ষা করবে না। তুমিই আমাকে ‘ছোট সম্রাট’ ডেকে ডেকে কান পচিয়ে দিয়েছ। যদি আমি সম্রাটই হই তাহলে কি আমি যুদ্ধক্ষেত্রে দূর থেকে লড়াই করব? পারস্যে গেলে আমাকে জঙ্গলে শিকারে যেতেই হবে, এখানে শিখে না গেলে বাবার কাছে তোমার মর্যাদা থাকবে?”

ছোড়া জানে কোথায় আঘাত করলে কাজ হবে। অস্টিয়েজকে কুরুশের আবদারের কথা জানালাম। কুরুশকে কাছে রাখার জন্য অস্টিয়েজ তার যে কোন আবদার মানতে প্রস্তুত। কুরুশ তা নিজেও জানত, তার উপলক্ষে একমাত্র বাধা ছিলাম আমি। সেই বাধাও ধূর্ততার সাথে টপকে গেল। কুরুশ স্বয়ং অস্টিয়েজের কাছ থেকে অনুমতি নিতে পারত, কিন্তু সে বুঝতে পেরেছিল তাতে আমি অসন্তুষ্ট হব। যত দিন যাচ্ছিল সে ততই পরিপক্ক হচ্ছিল। আগের মত সবসময় মাতামহের লেজুড় হয়ে থাকত না। অস্টিয়েজ কোন কারণে ব্যস্ত থাকলে সে নিজেই তাকে বিরক্ত করা থেকে বিরত থাকত। ইতিমধ্যে প্রধান পরিচারকের সাথেও তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তার বালকসুলভ আচরণগুলোও দিন দিন লোপ পাচ্ছিল। কথা যতটা না বলত তার চেয়ে বেশি শুনত। পূর্বে তার চরিত্রের প্রধান আকর্ষণ ছিল বালকসুলভ চাপল্য, তার বর্তমান পরিপক্কতা সবার মনে তার প্রতি সম্মানের উদ্রেক করে চলেছিল।

ঠিক হল তার সাথে আমি আর সায়াজারেস যাব। তাকে শিকারের নিয়ম-কানুন আগেই শিখিয়েছিলাম, তবুও রওনা দেয়ার আগে সেগুলো ভাল করে স্মরণ করিয়ে দেয়াটা উত্তম মনে হল। চেহারায় শান্ত ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করলেও বুঝতে পারছিলাম ভেতরে ভেতরে সে উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। বেশির ভাগ পরিচারককে তার আশে-পাশে থাকার আদেশ দিলাম। তার বন্ধুরাও শিকারে অংশগ্রহণ করছিল। বন্ধুদের সামনে অতিরিক্ত নিরাপত্তার বহর নিয়ে কুরুশ গাই-গুই করছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে শাসন না করে পারলাম না। জঙ্গলে বিভিন্ন রকম শিকারী প্রাণী আছে, যেমন সিংহ, ভাল্লুক, চিতাবাঘ। সাধারণত দক্ষ শিকারী ছাড়া এসব প্রাণী শিকার করা মুর্খতা। তাছাড়া এসব প্রাণী শিকারে প্রধান অস্ত্র হল ধৈর্য্য, টোপ ফেলে শিকারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। অপরদিকে, হরিণ, বন্য ছাগল, শুকর ইত্যাদি শিকারের জন্য প্রয়োজন দ্রুতি ও কৌশল। যুদ্ধকৌশল শেখার জন্য সর্বোত্তম পন্থা। এসব প্রাণী শিকারে বিপদ তেমন নেই, পাহাড়ি এলাকা সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

সবাই যখন শিকারের সন্ধানে মগ্ন সেই মুহূর্তে আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা বল্গা হরিণ দেখে কুরুশ সেটার পেছনে তার ঘোড়া ছোটায়। আমার সাথে কয়েকজন পরিচারক তার পিছু নেয়। হরিণটি পাহাড়ের ঢাল ধরে পালানো শুরু করলে কুরুশও সেই পথ ধরে। হঠাৎ করেই হরিণটির সামনে প্রকাণ্ড খাদ প্রকট হয়। সে লাফিয়ে খাদ পার করে চলে যায়। কিন্তু কুরুশের তা দেখার সুযোগ ছিল না। যখন সে তা লক্ষ্য করে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আতঙ্কে আমার হাত-পা হিম হয়ে গেল। আমি তখনো অনেক দূরে, কুরুশকে বাঁচানোর কোন উপায় নেই। কুরুশের ঘোড়া খাদ দেখে হাটু গেড়ে থেমে যাওয়ার চেষ্টা করে। ঘোড়ার আকস্মিক থেমে যাওয়ার ধাক্কায় কুরুশের ছিটকে পড়ার কথা ছিল৷ কিন্তু সে ঘোড়ার কেশর ধরে থেকে পরিস্থিতি সামলে নেয়। তারপর ঘোড়াকে দম নেয়ার সুযোগ দিয়ে আবার হরিণের পিছে ধাওয়া করে। কিছুদূর যেয়ে বল্লম দিয়ে শিকারকে ভূপতিত করে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

কুরুশের কাছে পৌছার পর তিরস্কারের ভাষা সংযত করার প্রয়োজন মনে করলাম না। কুরুশও মাথা নিচু করে চুপচাপ সেগুলো হজম করল। এদিকে কাছাকাছি আরেক দল একটা বন্য শুকরকে ধাওয়া শুরু করেছে। তাদের হর্ষধ্বনি শুনে আমাকে উপেক্ষা করে কুরুশ সেদিকে ছুটে গেল। আমরা ছিলাম সেই দলের উলটো প্রান্তে। কুরুশ সেদিকে ছুটে যেতেই সে সরাসরি শুকরের সামনে পড়ল। শুকর কখনো একা শিকার করা উচিৎ না। শিকারী পশু না হলেও বন্য শুকর বিপদজনক প্রাণী, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে একরোখা হয়ে যায়। প্রথমে দলবলসহ শুকরকে ঘিরে ফেলতে হয়। পালাবার রাস্তা বন্ধ হয়ে শুকর দ্বিধায় পড়ে যায়, একত্রে আক্রমণ করার সুযোগ সেটাই। একরোখা শুকরের দ্বিধা কেটে যাবার পর তা যে কোন একদিকে ছোটে, সামনে যাকে পায় তাকে ছিড়ে-খুড়ে বের হয়ে যায়। এসব তথ্য জানা সত্ত্বেও কুরুশ একা শুকরের সাথে মোকাবিলা করতে সেটার সামনে চলে যায়। শুকরের হতচকিত ভাব কাটার আগেই সেটার কপালে বল্লম সেধিয়ে দেয়। দুই পা হাটার আগেই শুকরটি মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেল।

সায়াজারেস ধাওয়া করা দলের সন্মুখে ছিল। ভাগ্নের কার্যকলাপ চোখের সামনে দেখে রেগে গেল। হাজার হোক মামা তো, আমার মত করে গরল উগরে দিতে পারল না। তার উপর ভাগ্নের সাহসে সে যারপরনাই মুগ্ধ। মৃদু ভর্ৎসনা করে ছেড়ে দিল। এবার কুরুশ তার কাছে আবদার করল তার শিকারগুলো সে নিজের হাতে অস্টিয়েজকে দেখাবে। সায়াজারেস রাজি হচ্ছিল না, “এগুলো শিকার করতে যেয়ে তুমি প্রায় মারা যাচ্ছিলে। তোমার কি মনে হয় তোমার মাতামহ এগুলো দেখে খুব খুশি হবেন? তোমার এই বেপরোয়া আচরণের জন্য বাবা আমাদেরকেই শাস্তি দেন কিনা কে জানে…”

“আমি সব দোষ নিজের ঘাড়ে নিব, মামা। কিন্তু মাতামহকে এগুলো না দেখাতে পারলে আমি তৃপ্তি পাব না। তুমিই বল, আমি নিজে শিকার করেছি শুনলে মাতামহ গর্ববোধ করবে কি না?”

সায়াজারেস অস্বীকার করতে পারল না। পরিস্থিতি যাই হোক, পৌত্র নিজের শিকার তাকে উপহার দিবে এতেই অস্টিয়েজ যথেষ্ট আনন্দিত হবেন। একবাটানাতে পৌছে কুরুশ তার শিকার করা হরিণ ও শুকরের মাংস অস্টিয়েজের সামনে পেশ করল, তার বল্লমটা একটু তফাতে দৃষ্টিগোচর দূরত্বে রাখল। অস্টিয়েজ যা বোঝার বুঝে নিলেন। মনে মনে খুশি হলেও মুখে তা প্রকাশ করলেন না, “এই উপহারের মূল্য তোমার প্রাণের সমান নয়। যে শিকারে আমার পৌত্র নিজেই শিকার হয়ে যেতে পারত তা আমি গ্রহণ করতে পারব না, কুরুশ। আমি দুঃখিত”।

“তুমি যদি না নাও তাহলে কি আমি এগুলো আমার বন্ধুদেরকে দিতে পারি?”

“অবশ্যই। কিন্তু তুমি কষ্ট করে এগুলো শিকার করেছ, তুমি নিজেই তো তা ভোগের দাবিদার। অন্যদের দিয়ে দেয়ার কি প্রয়োজন?”

কুরুশ মৃদু হাসল, “আমার বন্ধুরা নানা সময়ে আমাকে সাহায্য করেছে, সঙ্গ দিয়েছে। আমরা পারসিকরা কারো ঋণ বকেয়া রাখি না”, বলে সে তার বন্ধুদের মধ্যে সমস্ত মাংস বন্টন করে দিল।

মিশরকে শায়েস্তা করে নেবুচাঁদনেজারের সৈন্যবাহিনী ফিরে এসেছে। হিব্রুরা যাই বলুক না কেন নেবুচাঁদনেজারের নেতৃত্বে ব্যাবিলন পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যগুলোর তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এরপর তিনি নগরের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য উত্তর দিকে কুলদেবতা বেল-মারডুক, হাদাদ ও কুলদেবী ইনানার উৎসর্গে প্রকাণ্ড একটি তোরণ নির্মাণ করেন। পুরনো পৃথিবীর পুথি অনুযায়ী দেবতা আনু যখন তৃতীয় প্রজন্মের দেব-দেবীদের মধ্যে পৃথিবীর শাসন ভাগ করে দিচ্ছিলেন তখন বেল-মারডুকের ভাগে পড়ে মিশর, সেখানে তিনি আমোন-রা নামে পরিচিত। আর ইনানার ভাগে পড়ে তৎকালীন আক্কাদ তথা ব্যাবিলন ও পুবে ভারত। পারিবারিক কলহ ও ক্ষমতালিপ্সা বেল-মারডুককে পুবে ও উত্তরে টেনে আনে। পরে তিনি ইনানাকে ব্যাবিলন থেকে উৎখাত করে সেখানকার কুল-দেবতার আসন গ্রহণ করেন। এদিকে উচ্ছেদের পর ইনানা পুবে ভারতের দিকে তার শাসন চালু করেন।

দেশে থিতু হবার পর হঠাৎ করেই নেবুচাঁদনেজারের মধ্যে মানসিক বৈকল্য দেখা দেয়। হিব্রুদের দাবি জেরুজালেমের সম্পদ ব্যাবিলনের কুল-দেবতা বেল-মারডুককে উৎসর্গ করার জন্য তা ইহ্ওয়াহর পক্ষ থেকে এক প্রকার শাস্তি। নেবুচাঁদনেজারের পুত্র আমেল-মারডুক সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। কুরুশের বয়স তখন সতেরো বছর। সেই সময় ব্যাবিলনের এক রাজকুমারের বিয়ে ঠিক হয়। কুমার তার অবিবাহিত জীবনের ইতি উদযাপনের জন্য বন্ধু-বান্ধবের সাথে শিকারে বের হন। নিরাপত্তার জন্য তারা এক পল্টন অশ্বারোহী বাহিনী ও এক পল্টন পদাতিক বাহিনী সাথে নেন। ব্যাবিলন-মিডিয়া সীমান্ত শিকারে পরিপূর্ণ। মাঝে মাঝেই খণ্ডযুদ্ধ লেগে থাকত বলে সাধারণত কেউ সেখানে শিকারে যেত না। কুমার সিদ্ধান্ত নিলেন তারা সেদিকেই যাবেন।

ব্যাবিলন সীমান্তে শিকারীদের শিবির তোলা হল। রাতে কুমারের একজন সহচর পরামর্শ দিলেন যে শিকারের মজা তো যে কোন সময়ই পাওয়া যাবে। পুরো ব্যাপারটি আরো উপভোগ্য হবে যদি তারা সীমান্ত পেরিয়ে মিডিয়ার ফাঁড়ি ও তৎসংলগ্ন গ্রাম আক্রমণ করে, নিঃসন্দেহে সেটি একটি রোমাঞ্চজনক অভিযান হবে। পরামর্শ রাজকুমারের মনে ধরল। সিদ্ধান্ত হল রাত আরেকটু বাড়লেই মিডিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করা হবে। প্রায় মাঝরাতের দিকে তারা ফাঁড়ি আক্রমণ করে। সীমান্ত থেকে একবাটানা দূরে নয়। মিড সাম্রাজ্য উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত, পশ্চিম সীমান্ত থেকে প্রায় প্রতিটি এলাকাই নিকটবর্তী। মুহূর্তের মধ্যে খবর প্রাসাদে পৌছাল। আমি, অস্টিয়েজ, সায়াজারেস ও হারপাগাস গোটাকতক অশ্বারোহী নিয়ে রওনা হবার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। এমন সময় বর্ম-শিরণাস্ত্র পরিহিত অবস্থায় কুরুশ হাজির হল। ছোট সম্রাট প্রথমবার যুদ্ধের সাজ গ্রহণ করেছে৷ সময়ের অভাব থাকায় তাকে সাথে নেব কি নেব না এত কিছু চিন্তা না করে নিয়েই নিলাম। তাকে বারবার সতর্ক করে দেয়া হল যাতে সে কোন অবস্থাতেই তার মাতামহের সঙ্গ না ছাড়ে। কিন্তু কুরুশ তো কুরুশই।

সীমান্তে পৌছাবার পর দেখা গেল ছোট একটি দল গ্রামে লুটপাট চালাচ্ছে আর দুই পল্টন সৈন্য কিছু দূরে দাঁড়িয়ে তাদের প্রহরা দিচ্ছে। কুরুশ ব্যাবিলনের সৈন্যদের দিকে ইশারা করে অস্টিয়েজকে জিজ্ঞেস করল, “ওরা কি আমাদের শত্রু, মাতামহ?”

“হ্যাঁ”।

এরপর দাঁতে দাঁত চেপে কুরুশ বলল, “ আমাদের মাটিতে প্রবেশ করে লুট-পাট করার শাস্তি ওরা পাবে। আমরা এখনও আক্রমণ করছি না কেন?”

“আমরা আক্রমণ করলে ওদের রক্ষীরা আমাদের আক্রমণ করবে। আমরা সংখ্যায় অল্প, হঠকারী কিছু করা যাবে না”।

“মাতামহ, আমরা যেভাবে ভাবছি ওরাও সেই ভাবেই চিন্তা করছে। কিন্তু ক্ষতি আমাদের কোন পক্ষেরই হচ্ছে না, গ্রামবাসীর হচ্ছে। আমরা যদি ছোট দল নিয়ে লুটেরাদের আক্রমণ করি তাহলে কৌশলগতভাবে আমরা কিছু সুবিধা পাব- প্রথমত, ওরা আক্রমণ আশা করছে না, সুতরাং প্রতিঘাত করতে সময় নিবে, দ্বিতীয়ত, লুটেরাদের আক্রমণ করলে ওদের সৈন্যরা বসে থাকবে না, ওরাও আক্রমণ করবে, তখন আমরা সৈন্যদের উপর চড়াও হতে পারব”।

অস্টিয়েজ কুরুশের পরামর্শ আমলে নিলেন। আমাকে আদশ দিলেন সায়াজারেসকে সাথে নিয়ে লুটেরাদের আক্রমণ করতে। আমরা লুটেরাদের উপর হঠাৎ করে চড়াও হলে তারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। কুরুশের পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদেরকে সহজেই পরাস্ত করা সম্ভব হয়। এমতবস্থায় তাদের সেনারা সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে থাকলে কিছু সৈন্য নিয়ে কুরুশ তাদের পথ আটকে দেয়। এদিকে সায়াজারেস আমার হাতে লুটেরা দলকে ছেড়ে কুরুশকে সহায়তা করতে এগিয়ে যায়। ব্যাবিলনের সৈন্যদের তুলনায় আমরা সংখ্যালঘিষ্ঠ ছিলাম। ব্যাবিলনের সৈন্যরা কুরুশ ও সায়াজারেসকে প্রায় ঘিরে ফেলেছিল। পুত্র ও পৌত্রের বিপদ দেখে অস্টিয়েজ নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারলেন না। বাকি সৈন্য নিয়ে তাদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গেলেন। স্বয়ং রাজাকে যুদ্ধে নামতে দেখে ব্যাবিলনের সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তারা সীমান্তের দিকে পালাতে থাকলে আমরা সৈন্যদের সংঘবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে যাই। আমাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল সীমান্ত রক্ষা করা, ব্যাবিলনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা নয়। কিন্তু কুরুশ সেভাবে ভাবছিল না, সে পলায়নরত সৈন্যদের পিছু ধাওয়া করতে লাগল। দূর থেকে তাকে ছুটন্ত নক্ষত্রের মত লাগছিল। হাতের কাছে যাকে পাচ্ছিল স্রেফ কচুকাটা করছিল। ব্যাবিলনের সৈন্যরাও নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। হয়ত রাতের অন্ধকারে ভানুর প্রকট তাদের চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছিল। ইচ্ছে করলেই তারা কুরুশের বিরুদ্ধে ঘুরে দাড়াতে পারত। কেন তারা তা করল না সেটা এখনো আমার কাছে রহস্যই রয়ে গেছে।

তার পরাক্রমে অস্টিয়েজ যে একেবারেই খুশি হননি তা কুরুশ ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিল। একবাটানাতে ফেরার সময় সে তার মাতামহ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছিল। অস্টিয়েজ বেজার হলেও সৈন্যরা তার বীরত্বে মুগ্ধ। পরের দিন তার বীরত্বগাথা সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। ধীরে ধীরে কুরুশ-আখ্যান পারস্য পর্যন্ত পৌছায়। কিছুদিন পর ক্যাম্বিসেসের পত্র আমার হাতে আসে। চিঠির সারমর্ম ছিল- “ছেলে যদি এতই লায়েক হয় যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা শুরু করেছে, তাকে বল যেন সে পারস্যে ফিরে সেখানকার রীতি অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণ করে পিতৃভূমির সেবায় মন দেয়”। অস্টিয়েজও পত্র পেয়েছেন, তবে সেখানে ভাষা ছিল অনুরোধের।

বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। কুরুশকে ছাড়তে মন চাইছিল না, কিন্তু তার পিতা-মাতার অধিকার অগ্রাহ্য করা অনুচিত হবে ভেবে অস্টিয়েজ মন শক্ত করলেন। তার বিদায়কালে পুরো একবাটানা বিষাদের মেঘে ঢেকে গেল। পুরো নগরী তাকে এক নজর দেখে বিদায় জানাতে রাজপ্রাসাদের সামনে জমায়েত হল। কুরুশ তার ব্যবহৃত সামগ্রীগুলো তার বন্ধুদের মধ্যে বিতরণ করে দিল। সবাইকে কাঁদিয়ে ছোট সম্রাট একবাটানা ত্যাগ করল।

খণ্ডযুদ্ধের ঘটনার পর নতুন করে মিডিয়া-ব্যাবিলন সীমান্ত নিয়ে ভাববার প্রয়োজন বোধ করলাম। পশ্চিমে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সীমান্ত। প্রচুর উদ্যোগের প্রয়োজন। ইচ্ছা থাকলেও পারস্যে যাওয়া-আসা করা সম্ভব হয়ে উঠছিল না। তবে নিয়মিত কুরুশের সাথে পত্র বিনিময় হত। উপযাজক হয়ে হারপাগাস পত্র বিনিময়ের দায়িত্বটা নিল। অস্টিয়েজ নিয়মিত পৌত্রের জন্য তাজা ঘোড়া সরবরাহ করতেন। হারপাগাস সেই দায়িত্বটা পালন করত। কুরুশের পত্রগুলো থেকে বুঝতাম হারপাগাসের সাথে কুরুশের বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। কুরুশ ঘোড়সওয়ারী পছন্দ করে, হারপাগাস মিডিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ ঘোড়সওয়ার- জহুরী উপযুক্ত মানিক বেছে নিবে এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। এদিকে সম্ভবত ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়েছে। আমেল-মারডুকের শ্যালক ও পারিষদ নারগাল-শারিজা সম্রাটকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন। নতুন সম্রাট নেবোপোলাজারের বংশোদ্ভূত না, সুতরাং প্রজারা তাকে মেনে নিতে পারছে না। পুরো রাজ্যে অরাজকতা বিরাজ করছে। বিদ্রোহীরা মিডিয়া সীমান্তে ভিড় জমাচ্ছে। দিন ও রাতের পার্থক্য ভুলে উত্তর-দক্ষিণ করতে করতে কখন বছর পার হয়ে যাচ্ছিল তা টেরই পাচ্ছিলাম না। আনশান তো দূরের কথা, একবাটানার সরাইখানায় বন্ধুদের সাথে মদিরা পান করব তার সময় হয়ে উঠছিল না। ম্যান্ডেন পত্র মারফত বারবার পারস্যে যাবার জন্য অনুরোধ করছিল। কিন্তু কর্তব্য রেখে কিভাবে যাই! আশা ছিল ক্যাম্বিসেস পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে আমার হয়ে ওকালতি করবে। বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু- হারপাগাস বা ক্যাম্বিসেস আমাকে হতাশ করেনি। বছরখানেক পর পত্র এল যে পারস্যের রাজা হিসেবে কুরুশের রাজ্যাভিষেক হবে।

শিষ্যের রাজ্যাভিষেকে গুরুর অনুপস্থিতি কাম্য নয়। তাছাড়া ক্যাম্বিসেস বৃদ্ধ হয়েছেন, প্রচন্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রোগাক্রান্ত দুর্বল দেহের দরুণ তার পক্ষে এত দূরত্ব যাত্রা করা সম্ভব নয়। হারপাগাস তো নিয়মিত পারস্যে যাওয়া-আসা করেই, সায়াজারেসও ভাগ্নের রাজ্যাভিষেকে না যেয়ে পারবে না। সীমান্ত পরিস্থিতি শান্ত না হলেও দুই একদিনের জন্য ছুটি নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

সময় গতিশীল, দেখতে দেখতে কিভাবে তেরটা বছর পার হয়ে গেল কেউ টের পেল না। আমি সবসময়ই ভেবে এসেছি আমার জন্য সময় অচর, সবসময় নিজের ধান্দাতেই ব্যস্ত থেকেছি। সৃষ্টির আদি থেকে সূর্য ওঠা-ডোবা প্রকৃতির নিয়তি, কিন্তু কুরুশের রাজ্যাভিষেক যেন পুবে নতুন সূর্যের সূচনা করল। পারস্যের রাজকুমার আজ রাজা। ক্যাম্বিসেস নিজের হাতে পুত্রকে রাজমুকুট পরালো। পিতা তার পুত্রের কাধে রাজ্যের ভার অর্পণ করে মুক্ত হল। সন্দেহ নেই পুত্র তার দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করবে। বারজন গোত্রপাল নতুন রাজার প্রতি নতি স্বীকার করলেন, মিত্র রাজারা নতুন করে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেন। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রাজা প্রত্যেককে প্রচুর উপঢৌকন প্রদান করলেন।

ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পারস্যে বেশিদিন অবস্থান করা সম্ভব হলনা। আবার কর্মক্ষেত্রে ফিরে গেলাম। মাসখানেক পর রাজধানী থেকে খবর পেলাম অভিজাতেরা বিদ্রোহের পরিকল্পনা করছে। মহাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গৃহযুদ্ধের পরিকল্পনা খাল কেটে কুমির আনার মত। ব্যাবিলনের পরিস্থিতি তখনও অস্থির, এদিকে লিডিয়া থাবা বসানোর চেষ্টা করছে। পুরো মহাদেশ কেমন যেন উত্তপ্ত, থমথমে, যেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য একবাটানাতে ফিরে এলাম। অস্টিয়েজ, সায়াজারেস, হারপাগাস ও অন্যান্য সেনাপতিদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হল পারস্য থেকে সৈন্য ডেকে পাঠানো হোক। পরামর্শটা হারপাগাসেরই ছিল। বিদ্রোহ ঘটার সুষ্ঠু প্রমাণ না থাকলেও প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে সিদ্ধান্তটা খারাপ না। কারণ বিদ্রোহে মিডিয়ার সৈন্যদের যোগ দেয়ার সম্ভাবনা থাকলে পারস্যের সৈন্যবাহিনী দ্বারা তা প্রতিরোধ করা যাবে। আমার নিজের সৈন্যরা সীমান্ত প্রহরায় ব্যস্ত, বিদ্রোহকালে সীমান্তের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করাও জরুরি বটে। কুরুশকে পত্রযোগে পরিস্থিতি সম্পর্কে অভিহিত করা হল। ফিরতি পত্রে জবাব এল সে যথেষ্ট সেনাবাহিনী নিয়ে রওনা হয়েছে। এদিকে হারপাগাস তার নিজস্ব বাহিনী প্রস্তুত রাখল। দিনখানেক পর দূত মারফত খবর পেলাম কুরুশ তার সেনাবাহিনী নিয়ে মিডিয়ার ভূমিতে পা রেখেছে। অন্যদিকে বিদ্রোহী সৈন্যদলও যে কোন সময় রাজধানী আক্রমণ করতে প্রস্তুত৷ অশুভ এক সকালে রাজধানীর বাইরে ময়দানে তিন বাহিনী মুখোমুখি হল।

উপযাজক হয়ে হারপাগাস বিদ্রোহী শিবিরে প্রতিনিধি হয়ে গেল। সেখানে আলোচনার পর তার সেনাবাহিনীসহ কুরুশকে নিয়ে সে রাজপ্রাসাদে ফিরে আসল। শান্তকন্ঠে অস্টিয়েজকে বলল, “মহারাজ, আপনাকে মিডিয়ার সিংহাসনের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে। এই মুহূর্ত থেকে মিডিয়া-পারস্য সাম্রাজ্যের শাসন দণ্ড তুলে দেয়া হচ্ছে আপনার প্রিয় পৌত্র সম্রাট কুরুশের হাতে। এই সিদ্ধান্ত সমগ্র সেনাবাহিনী ও প্রজাকুলের”।

অবাক হয়ে অস্টিয়েজ হারপাগাস ও কুরুশের মুখের দিকে চেয়ে থাকলেন, “কুরুশ...তুমি...কেন…”

কুরুশ মৃদু হেসে বলল, “মাতামহ, আমি আগেই বলেছিলাম, আমরা পারসিকরা কারো ঋণ বকেয়া রাখি না…”
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ২:৩৩
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×