আমাদের ফানুসদার আজ মন ভালো। কারণ, অষ্টম পে-স্কেল অবশেষে মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেয়েছে। ফানুসদা ক্যালকুলেটর আর কাগজ-কলম নিয়ে বসলেন। এটা ফানুসদার প্রতিদিনের অভ্যাস। হিসাব করে দেখেন, নতুন স্কেলে তিনি কত টাকা বেতন পাবেন। টাকার অঙ্কটা দেখে তাঁর চোখ জুড়িয়ে যায়। বাহ্, দারুণ তো! সরকারি চাকরি করে এত টাকা বেতন! তার মানে তিনি যে প্রতিদিন অফিসে কিছু সময়ের জন্য নিয়ম করে ঘুমান, সে জন্যও সরকার তাঁকে বাড়তি বেতন দেবে!
তাঁর ঠোঁটের হাসিটুকু কান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গেল। এমন সময় বৌদি ঢুকলেন ঘরে। মুখ ঝামটা মেরে বললেন, ‘অফিসে না গিয়ে বসে বসে হাসছ কেন? পাগল না ছাগল!’
ফানুসদা বললেন, ‘আরে পাগল না, পাগল না, ছাগল! খাসি!’
‘মানে?’
‘আজ খাসি জবাই হবে। পে-স্কেল দিয়েছে। এই দেখো।’
ফানুসদা হিসাবের কাগজটা বৌদির দিকে এগিয়ে দিলেন। বৌদি চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘এ তো দেখি অনেক টাকা! দিয়ে দিয়েছে নাকি?’
ফানুসদা অতিকষ্টে একটা ঢোঁক গিললেন, ‘আরে না না, এখনো দেয়নি, ঘোষণাই তো এল মাত্র!’
বৌদি বললেন, ‘তুমি ছাগল না কী যেন বললে?’
‘আরে ধুর, আমি ছাগল না। বলেছি ছাগল জবাই হবে।’
‘কোথায় ছাগল জবাই হবে?’
‘বাজারে। দাও, বাজারের ব্যাগ দাও। দুপুরে বিরিয়ানি হবে।’
‘তুমি অফিসে যাবে না?’
‘অফিসে তো প্রতিদিন যাই। বিরিয়ানি তো আর প্রতিদিন হবে না। আজ ইচ্ছেমতো বাজার করব। আজ বিরিয়ানি খাওয়ার দিন।’
ঢাউস সাইজের ব্যাগ নিয়ে ফানুসদা বাজারের দিকে রওনা দিলেন। এই ব্যাগে ভরে আস্ত একটা ছাগল নিয়ে আসা যাবে। বাসা থেকে বেরোতেই বাচ্চাকাচ্চার সঙ্গে দেখা। দু–একজন জানতে চাইল, ‘ফানুসদা আঙ্কেল, কোথায় যান?’
ফানুসদা আজ আর রাগ করবেন না। তাই মোলায়েম স্বরে বললেন, ‘বাজারে যাই, তোমাদের জন্য চকলেট আনব।’
এক দুষ্টু বাচ্চা জিজ্ঞেস করল, ‘চকলেট আনতে এত বড় ব্যাগ লাগে?’
‘শুধু চকলেট না, টকলেটও আনব।’ ফানুসদা ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলেন। গলির মাথায় এসে ভাবলেন, আজ আর হেঁটে যাওয়া ঠিক হবে না। সরকারি চাকরি করেন, মোটা অঙ্কের বেতন পাবেন। তাঁর একটা স্ট্যাটাস আছে না! সেটা ভেবেই কলার নেড়ে রিকশায় উঠে বসলেন। তাঁর মনে সংগীত দোলা দিতে লাগল, ‘যা পেয়েছি আমি তা চাই না, এত টাকা দিয়া আমি কী করিব...।’ না, ছন্দ মেলেনি। তবু তিনি গুনগুন করতে লাগলেন।
রিকশা থেকে নেমে ফানুসদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই মিয়া, ভাড়া কত তোমার?’
‘পঞ্চাশ টাকা।’
ফানুসদা আকাশ থেকে পড়লেন, ‘বিশ টাকার ভাড়া পঞ্চাশ টাকা?’
‘জি স্যার, পে-স্কেল দিছে না? আপনি তো সরকারি চাকরি করেন।’
ফানুসদার মনটা ভালো হয়ে গেল। তিনি আবারও কলার নাড়লেন।
বাজারে ঢুকে তিনি প্রথমে গেলেন মুদি দোকানে। রান্নাঘর খালি। তেল-মসলা নিলেন কিছু। দাম দেখে তাঁর চোখ কপালে উঠে গেল। এত টাকা! দোকানদার বললেন, ‘পেঁয়াজের দামই তো সত্তর টাকা, স্যার। সেই যে উঠেছে তেমনটা আর কমেনি। সমস্যা কী স্যার, পে-স্কেল দিয়েছে না?’ ফানুসদা আবার কলার নাড়লেন।
জুতার দোকানের সামনে দিয়ে যেতে ফানুসদা ভাবলেন, ব্যাটাকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া দরকার। দুর্দিনে কিস্তি সুবিধা দিয়ে কত উপকার করেছে লোকটা। তিনি দোকানে ঢুকলেন। দোকানদার হন্তদন্ত হয়ে বললেন, ‘টাকা দিতে এসেছেন, স্যার?’
‘কিসের টাকা?’ ফানুসদা আকাশ থেকে পড়লেন।
দোকানদার হিসাবের খাতা খুলে বললেন, ‘বারো শ টাকা বাকি আছে স্যার। বৌদি জুতা নিয়েছিলেন কিস্তিতে।’
ফানুসদা কাঁপা হাতে মানিব্যাগ বের করে বারো শ টাকা শোধ করে দিলেন। দোকানদার মুচকি হেসে বললেন, ‘এখন থেকে কিস্তি সুবিধা বাতিল। পে-স্কেল দিয়েছে না?’
ফানুসদা এবার কাঁপা হাতে কলার নাড়লেন। তাঁর কাছে আর শ খানেক টাকা অবশিষ্ট আছে। তাহলে খাসির মাংস? বিরিয়ানি? খাসির মাংস কি কিস্তিতে বিক্রি করে? তাঁর বুকটা ধক করে উঠল। কাঁপা কাঁপা পায়ে মাছ বাজারে ঢুকলেন। এক শ টাকা দিয়ে কিনলেন এক ভাগা মলা মাছ। আজ দুপুরে মলা মাছের বিরিয়ানি হবে। নতুন রেসিপি। পে-স্কেল দিয়েছে না?
// মাইনুল এইচ সিরাজী | // সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৫ // Prothom Alo // রস+আলো //
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৪৯