আমি ছোটবেলা থেকে একটু অন্য টাইপের ছিলাম।অন্য টাইপের বলতে গড়পড়তা ছেলেদের মত ছিলাম না আর কি।আমার মধ্যে মেয়েলী ভাব ছিল প্রবল। আমার জ্ঞান হবার পর থেকে সবসময় মেয়েদের সাথেই খেলতে পছন্দ করতাম।নাটক সিনেমার নায়িকাদের নকল করে তাদের মত কথা বলা, হাসি দেওয়া,হাসতে হাসতে মুখে হাত চেপে ধরা এগুলো ছিল আমার অভ্যাস।বাস্তবে ছেলে হয়েও আমার সব আচরণ ছিল মেয়েদের মত। রান্নাবাটি, পুতুল খেলা, কিতকিত, লাফ দড়ি, ইচিং বিচিং এসব ছিল আমার প্রিয় খেলার তালিকায় আর আমার সঙ্গীরাও ছিল সবাই মেয়ে। আরও একটা ব্যপার ছিল আমি সবসময় মেয়েদের মত কোমর দুলিয়ে ঢং করে হাঁটতাম,হাত ঘুরিয়ে কানের কাছে থাকা চুল বিশেষ কায়দায় কানের পিছনে আনতাম (সেই সময় এটা মেয়ে অন্যতম স্টাইল ছিল)। কথায় কথায় বিশেষ ভঙ্গিতে মুখ বাঁকানো ছিল আমার বড় একটা মুদ্রা দোষ।সেই সঙ্গে কন্ঠস্বরও ছিল মেয়েদের মত চিকন।
সংগত কারণে রাস্তা ঘাটে স্কুলে আমাকে ডাকা হতো হাফ লেডিস, হিজড়া ইত্যাদি বিশেষণে।অল্প বয়সের কারণে এসব নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাতাম না তবে অতিরিক্ত হয়ে গেলে মাঝে মধ্যে টিচারদের কাছে বা বয়োজ্যেষ্ঠ কারো কাছে নালিশ করতাম ব্যাস।কিন্তু দিন যত যেতে লাগলো আমার চারপাশটা ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করতে লাগলো। আমাদের পরিবারে অশান্তি শুরু হলো। আমার মেয়েলী আচরণের কারণে আব্বা আমাকে তীব্রভাবে অপছন্দ করতেন।প্রায় সময় আমাকে নানা কথা শোনাতেন বা শাস্তি দিতেন।কড়া হুশিয়ারী দিয়ে আচরণ ঠিক করতে বলতেন। মায়ের সাথেও দূর্ব্যবহার করতেন,উঠতে বসতে তাকে দোষারোপ করতেন । মা ছিলেন খুব চাপা স্বভাবের তিনি নিরবে কষ্ট পেতেন তবে কখনোই আমাকে কোন কিছু নিয়ে ফোর্স করতেন না। বলতেন "তুমি তো তোমার মত।তুমি নিজেকে তোমার মত গড়বে আর অবশ্যই লেখাপড়া চালিয়ে যাবে।সব সময় নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করবে।নিজের কাজ নিজে করবে।কোন অবস্থাতে কখনও হাল ছাড়বে না।।"
সিক্সে ওঠার পর সমস্যা আরও প্রকট হলো। যেহেতু তখন হাইস্কুলে পড়ছি।নতুন পরিবেশে এসে আমার নিজের স্বভাবের কারণে সহজেই উপরের ক্লাসের ছেলেদের চোখে পড়ে গেলাম।টিফিন আর ক্লাস শুরু হবার আগে তারা আমার ক্লাসের সামনে জটলা পাকাতো।আমার সহপাঠীরা মজা করে বলতো-বয়েজ স্কুলে লেডিস দেখে ওরা পাগল হয়ে গেছে। বুঝলি অপুর্ব ওরা তোরে খাইতে করতে চায়। "
এদিকে কেউ কেউ নানারকম ইশারাও করতো। আমি স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে এসব তেমন একটা পাত্তা না দিলেও খানিক লজ্জা লজ্জা ভাব করতাম।
এদিকে আমাকে নিয়ে আমার বাবা মায়ের সংসারে প্রবল অশান্তি শুরু হলো।পাড়াপ্রতিবেশি নানা আলোচনা করে টিটকারি মেরে জীবন আরও জটিল করে তুলল।
তারপর একদিন আব্বাকে বলতে শুনলাম আমাকে নাকি কোথায় রেখে আসবেন তিনি।সেখানে নাকি আমি খুব ভালো থাকবো। আমার মত নাকি সেখানে অনেকেই আছে। তারা সেখানে খেয়ে পরে ভালোই আছে।
সবশুনে আমার মনটা ভীষণ খারাপ হলো।কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছিল কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না।সেই দিনগুলোতে আমার মা শুধু আমাকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ বসে থাকতেন।তাঁর মনের অব্যক্ত ভাব আমি ঠিক বুঝতে পারতাম।আমার ভীষণ ভীষণ কষ্ট হতো কিন্তু আমরা অসহায় ছিলাম।
আব্বা হয়তো আমার ভালোই চায়।তাছাড়া আমার জন্য আমার আব্বার সামাজিক মর্যাদা হুমকির মুখে তাই তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন হয়তো। আমার মনে হয় মেনে নেওয়াই উচিত।আমি চুপচাপ থাকি।কষ্টের কথা কাউকে বলি না।বলে কোন লাভ নেই যে।
কিন্তু আমার মা আমাকে কোথাও পাঠাতে রাজী হলেন না।আমাদের দুই ভাই বোনকে পাখির ডানা দিয়ে আগলে রেখে নানা অত্যাচার সহ্য করতে লাগলেন দাঁতে দাঁত চেপে। কয়েক বছর লড়াই চালিয়েও শেষ রক্ষা হলো না। আমাদের পরিবারটা ভেঙে গেল। আমার নানার বিশাল বাড়িতে প্রাথমিক অবস্থায় আমাদের ঠাই হলেও মামাদের প্ররোচনায় আমরা দুই ভাই বোন সেখান থেকে বিতাড়িত হলাম অচিরেই। পৃথিবীতে সম্পত্তির হিসাবটাই বড় হিসাব।
এরপর বাধ্য হয়েই আবার আমরা আমাদের আব্বার বাসায় এসে উঠলাম।পরে অবশ্য জেনেছিলাম আমার দাদীজানের ইচ্ছাতে বাবা আমাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়েছেন।
এবার শুরু হলো আমার অন্য রকম জীবন। বাসার কাজের সহকারীদের বিদায় করে দেওয়া হলো ক'দিনের মধ্যে। পরিবারের সব কাজ তখন আমাকে একাই করতে হতো। রান্না কাপড়চোপড় পরিষ্কার,ঘর গোছানোর কাজ,আটা ও মশলার মিল দেখাশেনা করা ইত্যাদি। তার মধ্যে আমি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চেষ্টা করলাম কিন্তু আমার স্কুল প্রায় বন্ধ হয়ে গেল অজস্র কাজের চাপে। সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ।সাথে আছে আমার আব্বার নানা অত্যাচার। কতদিন যে রান্নায় লবন কম বা স্বাদ ঠিকঠাক না হবার জন্য গরম খুন্তির ছ্যাকা খেয়েছি তা বলতে পারবো না। শুধু চাইতাম এই দূর্বিষহ জীবন থেকে পালাতে কিন্তু ছোটবোনটার কথা ভেবে কোথাও পালাতে পারতাম না।কারণ ও ছিল আমার থেকেও অনেক ছোট।
এদিকে আমার মায়ের সাথেও আমাদের কোন যোগাযোগ ছিল না।সেখানে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল কাছের আত্নীয় স্বজনেরা। পরে জেনেছিলাম আমার মাও এক বৃত্তাবদ্ধ পরিস্থিতিতে আটকে পড়েছিল। সেই বন্দী জীবনে তার কোন স্বাধীনতা ছিল না। তাঁর জীবনও ছিল দূর্বিষহ।
যাহোক আমি সপ্তাহে দুই দিন করে স্কুলে যাওয়া আসা করতাম। তার মধ্যে দুষ্ট ছেলেদের জ্বালাতন তো আছেই। কেউ কেউ নানা ছুতায় গায়ে হাত দেবার সুযোগ খুঁজতো আমি প্রতিবাদ করি নালিশ করি তবে তেমন সুফল হতো না। এরপর একদিন, সেদিন স্কুলে গেছি। অন্য দিনের চেয়ে একটু আগেই গেছি কারণ আকাশে দারুণ মেঘ। আমার ছাতা ভেঙে গিয়েছিল। আমি বৃষ্টিতে ভিজতে চাইছিলাম না। একসময় ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। স্কুলে অল্প কিছু ছেলে এসেছে। সেজন্য সম্ভবত স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল। আমার এক সহপাঠী আমাকে নোট দেবার নাম করে তার বাড়িতে নিয়ে গেল।
আসলে ওটা ছিল একটা ফাঁদ। সেই ফাকা বাড়িতে আমাদের স্কুলের বড় ক্লাসের কয়েকজনকে দেখে আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম। আমি চলে আসতে চাইলাম। আমার ফিরতে হবে বাসায় অনেক কাজ।আমি রান্না না করলে দুপুরে কারো খাওয়া হবে না। নানা অযুহাত দেখালাম।
না সেদিন আমি যথাসময়ে ফিরতে পারি নি। চরমভাবে অপমানিত হয়ে নিজের উপর নিজেরই ঘৃণা লাগছিল।মানুষ এত নোংরা কি করে হয়?
এমন পরিস্থিতিতে আমি ঠিক করলাম। এই দূর্বিষহ জীবন আর আমি বয়ে বেড়াবো না। আমি আত্মহত্যা করবো।রাস্তায় ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যার অন্ধকারে আমি আমাদের পাড়ায় ফিরে এলাম।নিজ উদ্দেশ্য চারিতার্থ করবার জন্য চঞ্চলদের নতুন বিল্ডিং এর পাঁচ তলাতে উঠলাম। উদ্দেশ্য লাফ দিয়ে নিচে পড়ে আত্মহত্যা করবো।
লাফ দেওয়ার জন্য যখন সব প্রস্তুতি শেষ করেছি ঠিক তখনই পেছন থেকে কে যেন ডেকে উঠলো
-ভাইয়া!
সঙ্গে সঙ্গে আমার পৃথিবীটা দুলে উঠলো তাইতো এটা কি করছি আমি। আমি ছাড়া আমার বোনটার যে আর কেউ নেই। না আমি হারবো না। আমি বাঁচবো,আমাকে বাঁচতে হবে। এবার থেকে আমি নিজের মত করে বাঁচবো। নিজেকে বদলাবো যথা সম্ভব।আমি পারবো। আমাকে যে পারতেই হবে।তারপর অনেক বছর পেরিয়ে...... আমি পেরেছি।
বেঁচে সত্যি দারুণ ব্যপার। জীবন অতি সুন্দর। আর তাই নিজেকে অনেক সাধনায় একটু একটু করে বদলে নিয়ে এখনও বেঁচে আছি। ভালো আছি।
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০২৩ বিকাল ৪:৪০