somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মন্ত্রী মহোদয়গণের উদ্দেশ্যে আমার লেখা: সুষ্ঠু মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে প্রয়োজন জাতীয় গবেষণামূলক প্রাতিষ্ঠানসমূহের কাঠামোগত উন্নয়ন

৩১ শে মার্চ, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১. উপক্রমণিকা
কোনো জাতির গঠন ও উন্নয়ন স্বত:ফূর্ত বা স্বয়ক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয় না। বরং তা অর্জনে প্রয়োজন হয় যথাযথ নীতি ও মহাপরিকল্পনা। অর্থ্যাৎ একটি জাতির গঠন ও উন্নয়ন সাধন হয় কোনো জাতীয় নীতির আলোকে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে। আবার কোনো জাতি শূন্য থেকে কোনো নীতি প্রণয়ন করতে পারে না। নীতি প্রণয়নে প্রয়োজন হয় জাতীয় আদর্শের। বাংলাদেশেরও একটি জাতীয় আদর্শ রয়েছে। এই জাতীয় আদর্শ বিবৃত রয়েছে সংবিধানে। তবে সংবিধিবদ্ধ জাতীয় আদর্শের বাইরেও, আরও কিছু আদর্শ আছে, যা বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ পোষণ করে থাকে। এই আদর্শগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো− ইসলাম ও সমাজতন্ত্র। এসব আদর্শও সংবিধানের মূলনীতি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের সংবিধান বিভিন্ন আদর্শের সংমিশ্রণ বিশেষ। বর্তমানে প্রণীত সংবিধানটি একটি দলিল হিসাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছে বটে, তবে এই সাংবিধানিক জাতীয় আদর্শের আলোকে দেশের নীতি ও মহাপরিকল্পনাসমূহ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন হয় না। এর প্রধান কারণ হলো জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহে জাতীয় মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়ক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয় না। এসব জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম হলো−জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর), বাংলা একাডেমী, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই), শিল্পকলা একাডেমী, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) ইত্যাদি। এসব প্রতিষ্ঠানের কমবেশী ভৌত অবকাঠামো বিদ্যমান রয়েছে, কিন্তু এগুলোর কোমল অবকাঠামো নাজুক। কাজেই এসব জাতীয় প্রতিষ্ঠানে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়া যুক্ত হয় না। কারণ, জাতীয় মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের মূল পরামর্শসমূহ আসে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, যেমন-বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক অথবা দাতা সংস্থাসমূহ, যেমন-জাইকা থেকে। আর স্থানীয় পর্যায়ে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কোনো ফসল যুক্ত হয় না। সরকার স্থানীয় পর্যায়ে জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয় ও এনজিও ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রশাসনিক প্রতিনিধি এবং পত্রিকার নিবন্ধ লেখকদের সাথে পরামর্শ করে সাধারণত কোনো মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক প্রতিনিধির সাধারণত নীতি বিষয়ক কোনো জ্ঞান থাকে না। তাঁরা পত্রপত্রিকার তথ্য অথবা প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের নিকট থেকে তত্ত্ব ও তথ্য সংগ্রহ করে সরকারী মহাপরিকল্পনা সংলাপে অংশ নিয়ে থাকে। ফলশ্রুতিতে, দু’ধরণের নেতিবাচক ফলাফল দৃষ্ট হয়। প্রথমত: অন্যের কৃত গবেষণার ফলাফল প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিনিধির মাধ্যমে পরিকল্পনা সংলাপে যথাযথ পৌঁছায় না। ফলে সঠিক পরিকল্পনা গৃহীত হয় না। তাছাড়া মূল গবেষকগণের ফলাফল পরিকল্পনা প্রণয়নে যুক্ত হলেও, তাঁরা প্রয়োজনীয় সম্মানী ও সম্মাননা পান না। ফলে গবেষকগণ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। সেজন্য জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহে জাতীয় মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সহায়ক গবেষণা কার্যক্রমের কোমল অবকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন।

২. জাতীয় মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের মূল প্রতিবন্ধকতাসমূহ
জাতীয় উন্নয়ন নির্ভর করে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উপর। এইসব মহাপরিকল্পনা প্রণীত হয় জাতীয় বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহে। এই প্রতিষ্ঠানসমূহে যারা নিয়োজিত হন, তাঁরা দেশের শিক্ষাব্যবস্থাধীন শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় শিক্ষা লাভ করে এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে এসব প্রতিষ্ঠানে নানান অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা বিরাজিত রয়েছে। এই বিশৃঙ্খলার কারণ হলো- দেশব্যাপী মেকি বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার বিস্তৃতি।
মেকি বুদ্ধিবৃ্ত্তি চর্চা হলো বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার ভান বিশেষ, যেখানে প্রকৃত অর্থে বুদ্ধবৃ্ত্তি চর্চা অনুষ্ঠিত হয় না। বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার অনুপস্থিতি রয়েছে, যে কারণে সাধারণ্যে মেকি বুদ্ধিবৃত্তি চর্চাই বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা হিসাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো যে, মেকি বুদ্ধিজীবি চর্চার উপসর্গ কী? মেকি বুদ্ধিজীবি চর্চার উপসর্গ হলো- বুদ্ধিবৃ্ত্তি চর্চায় মৌলিকত্বের অনুপস্থিতি। বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার মৌলিকত্ব নিরূপণ একটি কঠিন কাজ। তবে জ্ঞানচর্চার জগতে এর একটি মানদণ্ড রয়েছে। বুদ্ধজীবি চর্চার মৌলিকত্ব প্রমাণিত হয় বুদ্ধিবৃত্তি চর্চায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের লেখাজোখা থেকে। এই লেখাজোখাকে পর্যায়ক্রমে নিবন্ধ, প্রবন্ধ ও সন্দর্ভ−এই তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। নিবন্ধ বা প্রবন্ধে লেখকগণ তাঁর নিজের চিন্তাধারা নিজের মতো নকল করে বা নিজের চিন্তাধারা থেকে লিখে প্রকাশ করে থাকেন। কিন্ত সন্দর্ভ রচনায় এই সুযোগ থাকে না। সন্দর্ভে একজন গবেষককে নিজের মৌলিক চিন্তা একটি তাত্ত্বিক কাঠামোতে শাস্ত্রীয় পরিভাষা ব্যবহার করে প্রকাশ করতে হয়। সন্দর্ভ লেখককে তাঁর চিন্তাধারাটি প্রকাশের সময় চলমান চিন্তাধারাগুলোর একটি পর্যালোচনা প্রকাশ করতে হয়। ফলে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার মৌলিকত্ব পরিস্ফূট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই সন্দর্ভ লিখিত হলে নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে গবেষণামূলক পত্রিকায় প্রকাশ করা যায়। গনেষণামূলক পত্রিকা আবার শর্তসাপেক্ষে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। মানসম্পন্ন গবেষণামূলক পত্রিকায় নতুন নতুন আবিষ্কারসমূহ প্রকাশিত হয়ে থাকে। মানসম্পন্ন গবেষণামূলক সন্দর্ভ লেখা না হলে, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ সম্পন্ন হয় না। মনোবিজ্ঞানী জ্যাঁ পিঁয়াজের মতে- একটি জনসমষ্টির খুবই নগণ্য পরিমাণ মানুষের উচ্চ পর্যায়ের বুদ্ধিবৃত্তিক গঠন সম্পন্ন হয়। কিন্তু বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার কোমল অবকাঠামো নাজুক অবস্থায় থাকায়, বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার মৌলিকত্ব প্রকাশ ও বিকাশের সুযোগ নেই। সেজন্য দেশজুড়ে মেকি বুদ্ধিবৃদ্ধি চর্চার বিস্তৃতি ঘটেছে। এখন এই মেকি বুদ্ধিবৃত্তিচর্চা সমাজের বিভিন্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রেণী এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিস্তৃত হয়েছে। এই মেকি বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার বাহকগণ হলো−বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ, সাংবাদিক সমাজ ও সুশীল সমাজ যাঁদেরকে একত্রে বুদ্ধিজীবি অভিধা আরোপ করা হয়। তাঁরা বুদ্ধিজীবি হিসাবে পরিচিত হলেও, তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার ধরণ থেকে তাঁদেরকে মেকি বুদ্ধিজীবি বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। কারণ তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার মধ্যে কোনো মৌলিকত্ব নেই।

৩. বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গবেষণা কার্যক্রমের চালচিত্র
দেশে সরকারী, আধা-সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান মিলে মেকি বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার নানা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানসমূহের অন্যতম হলো− সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান। দেশে সরকারী ও বেসরকারী মিলে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ততোধিক জাতীয় গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রায় প্রতিটি মন্ত্রলায়ের অধীনে ইনস্টিটিউট ও একাডেমী নামে কয়েকটি করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণা পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আর জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ জাতীয় লক্ষ্য পূরণে সহায়ক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহে তেমন কোনো গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয় না। অর্থ্যাৎ বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা হয় না, বরং সেখানে যা হয় তা হলো মেকি বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা।

৩.১. বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে মেকি বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার চালচিত্র
মেকি বুদ্ধিবৃত্তিচর্চার আঁতুড় ঘর হলো− দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ, যেখানে মেকি বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার সূত্রপাত হয়। তারপর এই মেকি বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ থেকে অন্যান্য জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে পরিব্যপ্ত হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকি বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার কারণ হলো মূলত: দুর্বল কোমল গবেষণা অবকাঠামো। এখানে আমাদের জানা দরকার যে, কোমল অবকাঠামো হলো- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, গবেষণা, শিক্ষা কার্যক্রম ও প্রশাসনিক নিয়ম-কানুন ও বিধি। এই অবকাঠামো ভৌত অবকাঠামোর চেয়ে ভিন্নতর। ভৌত অবকাঠামো হলো-দৃশ্যমান নির্মাণ কাঠামো। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃশ্যমান নির্মাণ কাঠামো অর্থ্যাৎ ভৌত অবকাঠামো বিরজমান থাকলেও, সুষ্ঠু কোমল অবকাঠামোর অনুপস্থিতির জন্য শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম সংঘটিত হয় না। যেমন- শিক্ষা কার্যক্রমের নিয়ামক ও সূচক হলো- গবেষণামূলক পত্রিকা। গবেষণামূলক পত্রিকা আবার মান অনুযায়ী তিন প্রকার। বাংলাদেশের কিছু ব্যতিক্রম বাদে কোথাও মানসম্পন্ন গবেষণা পত্রিকা প্রকাশিত হয় না। গবেষণামূলক পত্রিকার অনুপস্থিতি আমাদের এই বার্তা দেয় যে, দেশের বিশ্ববিদ্যালবগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হলেও, জ্ঞান চর্চা সংঘটিত হয় না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে জ্ঞান চর্চার পরিবর্তে, মেকি শিক্ষা কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে জ্ঞান চর্চা বিহীন এই শিক্ষা কার্যক্রম যুক্ত হয়ে শিক্ষার্থীগণ জ্ঞানদীপ্তি লাভ করতে পারে না । অর্থ্যাৎ তরুণ সমাজের একটি অংশ উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও, মেকি বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার প্রক্রিয়াধীনে জ্ঞানদীপ্তি লাভ করতে পারে না। ফলে দেশের সম্ভবনাময় তরুণ সমাজ জ্ঞানদীপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। জ্ঞানে ও মেধায় বঞ্চিত এই তরুণ সমাজ জাতীয় সমাজে প্রবেশ করে অপরিপূর্ণ জ্ঞানদীপ্তি নিয়ে। ফলে জাতীয় উন্নয়নে তাদের ভূমিকা রাখার ক্ষমতা ও প্রবণতা কিছুই থাকে না।

৩.২. জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে মেকি বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার বিস্তৃতি
দেশের প্রতিটি মন্ত্রলায়ের অধীনে ইনস্টিটিউট ও একাডেমী নামে কয়েকটি করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়ক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এসব জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ সৃষ্টি করা হয়েছে। জাতীয় এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশেরই ভৌত অবকাঠামো যথেষ্ট সবল। কিন্তু এই সব প্রতিষ্ঠানে জাতীয় লক্ষ্য পূরণে সহায়ক গবেষণা কার্যক্রমে সহায়ক কোমল অবকাঠামো দুর্বল। এ সব প্রতিষ্ঠানের কোমল অবকাঠামো সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলা হলে, দেশের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে ও বাস্তবায়নে সহায়ক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে। কিন্তু বর্তমানে জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের কোমল অবকাঠামো নাজুক অবস্থায় রয়েছে। যে কারণে এসব জাতীয় প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে জ্ঞানদীপ্ত গবেষক শ্রেণী যুক্ত হতে পারে না। আবার গবেষণার প্রবণতা সম্পন্ন জ্ঞানদীপ্ত গবেষকগণ এসব প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হলেও, প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ অথবা সম্মান ও সম্মাননার অভাবে তাঁরা গবেষণা কার্যক্রমে যুক্ত হয় না। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ক্ষমতা সাধারণত: সচিব বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণের উপর ন্যস্ত করা হয়। কিন্তু তাঁরা এসব গবেষণা প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র প্রশাসনিক কার্যক্রমই পরিচালনা করেন। এসব প্রতিষ্ঠানে মূলত: প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে গবেষণার জন্য বরাদ্দ থাকে প্রচুর। গবেষণা কার্যক্রমও পরিচালিত হয়। তবে এসব গবেষণা থেকে কোনো গবেষণামূলক সন্দর্ভ প্রকাশিত হয় বলে জানা যায় না। কিন্তু গবেষণা সন্দর্ভ প্রকাশিত না হলে, সেই গবেষণার কোনো মূল্যমান থাকে না। গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয় না বলে, এ সব প্রতিষ্ঠানে জাতীয় বীক্ষার অধিকারী পরিকল্পনা প্রণয়নকারী জ্ঞানদীপ্ত গবেষক শ্রেণী গড়ে উঠতে পারে না। যে কারণে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশের সাথে চুক্তি করতে হয়। তাছাড়া পরিকল্পনা প্রণয়নে অন্যদেশ বা আন্তর্জাতিক সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করতে হয়।

৪. মেকি বুদ্ধজীবিদের দখলে জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ
প্রতিটি জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে জাতীয় আদর্শকে সামনে রেখে, কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে জাতীয় আদর্শের লালন হয় না। ‘জয়বাংলা’, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ অথবা ‘নারায়ে তাকবীর’ ইত্যাদি স্লোগান দিয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মনযোগ আকর্ষণ করে, সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তিগণ এসব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হয়ে বসেন। প্রজাতন্ত্রের মন্ত্রণালয়ভুক্ত সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সাংবাদিক ইত্যাদি পেশার ব্যক্তিবর্গ এসব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসাবে অধিষ্ঠিত হয়ে থাকেন। যারা এখানে অধিষ্ঠিত হন, তাঁরা মূলত: প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। কারণ, তাঁদের ‘জয়বাংলা’, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ অথবা ‘নারায়ে তাকবীর’ ইত্যাদি স্লোগান জাতীয় মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে কোনো কাজে লাগে না। ফলে গবেষণা, প্রশিক্ষণ, বিদেশ ভ্রমণ ও প্রকল্পের নামে নির্ধারিত বরাদ্দ শুধুশুধু অপব্যয় হয়। কিন্তু জাতীয় মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সহায়ক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয় না। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের সমস্ত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বিদেশী পরিকল্পনার উপর নির্ভর করতে হয়।

৫. জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহে গবেষণা কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনতে করণীয়
জাতীয় উন্নয়নে প্রয়োজন সুষ্ঠু জাতীয় মহাপরিকল্পনা। এই জাতীয় মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে বুদ্ধি আাসার কথা জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে। সেজন্য জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে গবেষণা কার্যক্রমে সহায়ক প্রতিষ্ঠানে হিসাবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ সব প্রতিষ্ঠানে গবেষণা কার্যক্রমের ধারা ফিরিয়ে আনতে এগুলোর কোমল অবকাঠামোর সংস্কার করা আবশ্যক। স্মর্তব্য যে, কোমল অবকাঠামো হলো- গবেষণা সহায়ক নীতিমালা। এসব নীতিমালায় যা বিবৃত থাকবে, তা হলো− ক)গবেষক নিয়োগের নীতিমালা, খ)গবেষণ কর্ম পরিচালনার নীতিমালা, গ) গবেষণা প্রকাশনার নীতিমালা এবং ঘ) গবেষকদের পারিতোষিক, সম্মানী ও সম্মাননা। কোমল অবকাঠামোর উক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে, এসব প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু কোমল অবকাঠামো গড়ে তোলা হলে, প্রশাসনিক কাজের চেয়েও গবেষণা কার্যক্রমের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে। জাতীয় মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সহায়ক একটি কোমল অবকাঠামো সর্বোপরি জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহে গবেষণা কার্যক্রমকে ত্বরাণিত করবে। ফলশ্রুতিতে সেখানে প্রশাসনিক পদগুলোর গুরুত্ব কমে আসবে। তখন প্রশাসনিক কার্যক্রমে যুক্ত মেকি বুদ্ধিজীবিদের দৌরাত্বও কমে আসবে।
উন্নত দেশের অনুকরণে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কোমল অবকাঠামো সাজালে, কোমল অবকাঠামোর আদল বদলে যাবে। তখন এই কোমল কাঠামোতে জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানে শতশত স্থায়ী গবেষণার পদ থাকবে। কিন্তু একজন ব্যক্তির স্থায়ীভাবে গবেষকের পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ থাকবে না। কারণ গবেষক পদে নিয়োগ প্রাপ্তির পর, একজন ব্যক্তি তাঁর গবেষণা কার্যক্রম সক্ষমতা ও আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নবীন স্নাতক, সরকারী-আধাসরকারী কর্মকর্তা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য গবেষণা প্রকল্প জমাদান সাপেক্ষে ১/২ বছরের জন্য প্রেষণে নিয়োগ রেওয়াজ চালু্ হবে। গবেষণা কর্ম যথাযথভাবে সম্পাদন শেষে গবেষণামূলক পত্রিকায় গবেষণা সন্দর্ভ প্রকাশনা সাপেক্ষে ও নতুন গবেষণা প্রকল্প প্রস্তাব জমাদান সাপেক্ষে একই গবেষক পদে পুনর্বহালের সুযোগ থাকবে। গবেষণা কার্যক্রমে অবহেলা দৃষ্ট হলে, কর্মকর্তা বা শিক্ষকগণের তাঁদের নিজস্ব দপ্তরে প্রশাসনিক পদে ফেরত যাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে।

৬. উপসংহার: বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে জ্ঞানচর্চার ধারায় সম্ভাব্য ইতিবাচক পরিবর্তনসমূহ
বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় মেকি জ্ঞান চর্চা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ শেষে স্নাতকগণ জ্ঞানদীপ্ত হয়ে গড়ে উঠতে পারে না। ফলশ্রুতিতে জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের নাজুক কোমল অবকাঠামোতে হীনজ্ঞান স্নাতকগণ জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে বিরাজমান মেকি বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার সাথে যুক্ত হয়। অর্থ্যাৎ তারা জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রমে অবদান রাখার পরিবর্তে, এ সব প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রমকে ব্যহত করে। এই প্রক্রিয়া বর্তমানে চলমান রয়েছে। যে কারণে জাতীয় গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ জাতীয় মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না। কিন্তু প্রস্তাবিত কোমল অবকাঠামোর উন্নয়ন সাধন করা হলে, জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে গবেষণা ও বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা বৃদ্ধি পাবে। ফলশ্রুতিতে দেশে প্রকৃত বুদ্ধিজীবি ও গবেষকদের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। এই চাহিদা পূরণে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে গবেষণা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে। সে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে গবেষণা কার্যক্রমে যুক্ত না হয়ে অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ থাকবে না। ফলশ্রুতিতে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে জ্ঞান চর্চা ও গবেষণা কার্যক্রমে গতি ফিরবে। দেশ ও জাতি জ্ঞানদীপ্তির পথে এগিয়ে যাবে। মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে বিদেশী ও বিজাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর বুদ্ধিবৃত্তিক নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে এবং দেশ ও জাতি বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করবে।

সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৫০
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×