somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাঙ্গলার ইতিহাস পুনর্লিখনের প্রয়োজনীয়তা

১২ ই এপ্রিল, ২০২১ রাত ১১:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




[জ্ঞাতব্য: এখানে বাঙ্গলা=বাংলাদেশ+পশ্চিমবঙ্গ+আসাম, ত্রিপুরা ও আরাকানের কিয়দংশ]

১. উপক্রমণিকা

বাংলাদেশের ইতিহাস পুনর্লিখনের প্রয়োজন। কারণ বাঙ্গলার বা বাংলাদেশের ইতিহাস নামে যে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিক্রমার বিবরণ রয়েছে তার অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তার মানে বাঙ্গলার বর্তমান ইতিহাসটি পূর্ণাঙ্গ নয়। আমরা খোঁজ নিলে জানতে পারব যে, এ যাবতকালে যেসব বাংলাদেশের ইতিহাস গ্রন্থ রচিত হয়েছে সেগুলোর অন্যতম হলো―

১) Ramesh Chandra Majumdar and Jadunath Sarkar (1943). The History of Bengal, Volume 2. Front Cover. . University of Dacca.

২) নীহাররঞ্জন রায় (১৯৪১) বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদি পর্ব। কলিকাতা। দে’জ পাবলিকেশন্স।

৩) মুহাম্মদ আব্দুর রহিম (১৯৬৩)। বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস। ঢাকা: বাংলা একাডেমী।

৪) Rahim, Muhammad Abdur (1974), History of the Musalmans of Bengal karachi: Pakistan Pub. House.

এসব ইতিহাস গ্রন্থ যখন রচিত হয়েছে, তখন অনেক তথ্য ও উপাত্তের স্বল্পতা ছিল। তাছাড়া মুদ্রাক্ষরীকরণ ও মুদ্রণ শিল্পের বিকাশ ঘটেনি। তাছাড়া বাংলার রাজনৈতিক পরিক্রমায় যেসব রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, পররাষ্ট্রনৈতিক ও সামরিক ঘটনাসমূহ ঘটেছে তা একটি নির্দিষ্ট উৎসে সংরক্ষিত অবস্থায় ছিল না এবং এখনও নেই। কারণ প্রতিবার রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে পূর্বের ঐতিহাসিক তথ্য ও উপাত্ত হারিয়ে গেছে।

২. বাঙ্গলার ইতিহাস পুনর্লিখনে প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্তের উৎস

বাংলার ইতিহাস রচনায় প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্তসমূহ নানা দেশে নানা স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এসব তথ্য ও উপাত্তের বেশকিছু বিভিন্ন দেশের গ্রন্থাগারসমূহে সংরক্ষিত রয়েছে। আবার তার অনেকগুলো প্রতিবেশী দেশ বার্মা ও চীনে নীত হয়ে, সেখানে কিছু কিছু সংরক্ষিত আছে। কিন্তু, উক্ত ঐতিহাসিক তথ্য ও উপাত্তের বাইরেও অনেক তথ্য ও উপাত্ত উপমহাদেশ, চীন ও বার্মার গ্রন্থাগারে অশ্রেণীকৃত পাণ্ডুলিপি হিসাবে ঘুমন্ত অবস্থায় রয়েছে। অতীতের স্বাক্ষর ইতিহাসের তথ্য ও উপাত্তের অনেকগুলো আবার ইংরেজদের কর্তৃক অপহৃত হয়ে এখন ব্রিটিশ যাদুঘরে সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রস্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ এসবের অনেকগুলো সংগ্রহ করেছেন। এবং তারা বাঙ্গলার ইতিহাসকে পুনর্নিমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কাজেই বর্তমানকালে উক্ত ইতিহাসসমূহ রচিত হওয়ার সময়কালের চেয়ে আরও অধিক তথ্য ও উপাত্ত বিদ্যমান রয়েছে। তার অনেককিছু এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে পাঠের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে।

৩. বাঙ্গলার ইতিহাস পুনর্লিখনে করণীয়

একটি জাতির একটি ইতিহাস নির্মাণ করা অত্যন্ত শ্রমসাধ্য বিষয়। একটি ইতিহাস নির্মাণে প্রয়োজন জাতীয় পরিকল্পনা হাজার হাজার গবেষকের অধ্যবসায়। কাজেই বাঙ্গলার ইতিহাস নির্মাণে প্রয়োজন বিদ্যমান সব রকমের উৎস থেকে তথ্য ও উপাত্তসমূহ সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, পররাষ্ট্রনৈতিক ও সামরিক ঘটনাসমূহের পরিক্রমা নির্মাণ করা।

পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদে উল্লেখিত তথ্য উপাত্তের মধ্যে ইউরোপ ও আমেরিকায় যেগুলো ইংরজিতে অনুদিত ও বিশ্লেষিত হয়েছে সেগুলো ইতহাস নির্মাণে সহজেই ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু যেগুলো প্রাচীন গ্রন্থ বা পাণ্ডুলিপি হিসাবে গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে, সেগুলো বাংলা বা ইংরেজিতে লিপিবদ্ধায়িত নয়। বরং তার প্রায় সবই সংস্কৃত, পালি, আরবি ও ফার্সি ভাষায় লিপিবদ্ধায়িত অবস্থায় রয়েছে। কাজেই তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণে প্রথম বাঁধা হলো- পাণ্ডুলিপিগুলো বাংলায় অনুবাদকরণ। কিন্তু বাংলাদেশে সংস্কৃত, পালি, আরবি ও ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করার মতো কোমল ও ভৌত অবকাঠামোর অস্তিত্ব নেই। সংস্কৃত, পালি, আরবি ও ফার্সি জানা তেমন কোনো গবেষক ও বিশেষজ্ঞও নেই।

৪. ইতিহাস পুনর্লিখনে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ ও বিশেষজ্ঞ তৈরি

উপরের অনুচ্ছেদের আলোচনা থেকে আমরা জেনেছি যে, বাংলার ইতিহাস পুনর্লিখনে প্রয়োজন অবকাঠামো নির্মাণ ও বিশেষজ্ঞ তৈরি। অবকাঠামো দুই প্রকার― ভৌত অবকাঠামো ও কোমল অবকাঠামো। ভৌত অবকাঠামো অর্থ খরচ করলে ঠিকাদার ও প্রকৌশলীরা সহজে ও দ্রুত নির্মাণ করে দেবে। কিন্তু কোমল অবকাঠামো তৈরি করতে হলে প্রবিধান, নীতিমালা ও প্রাশাসনিক কাঠামো তৈরি করতে হবে। আর এই ইতিহাস নির্মাণে যারা কাজ করবেন তাদের মানবিকী ও সমাজ বিজ্ঞানের জ্ঞান এবং সংস্কৃত, পালি, আরবি ও ফার্সি ভাষার যেকোনো একটিতে উচ্চদক্ষতা থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে সংস্কৃত, পালি, আরবি ও ফার্সি ভাষায় দক্ষ করে গড়ে তোলার মতো প্রয়োজনীয় শিক্ষাব্যবস্থা নেই। সেজন্য সত্যিসত্যিই ইতিহাস পুনর্নিমাণ করতে হলে, বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত, পালি, আরবি ও ফার্সি বিভাগের শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হবে। আর মানবিকী ও সমাজ বিজ্ঞানের জ্ঞান এবং সংস্কৃত, পালি, আরবি ও ফার্সি ভাষায় ― এই দুইয়ের সমন্বয় ঘটাতে হবে। এই দ্বয়ীর সমন্বয় করতে হলে অনুষদের বা ইনস্টিটিউটের অধীনে আন্ত:শাস্ত্রীয় বিদ্যা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

এ ধরণের বৃহৎ ও অধ্যবসায়ী কর্ম সম্পাদনার জন্য অসংখ্য গবেষকের প্রয়োজন হবে। সেজন্য সংস্কৃত, পালি, আরবি ও ফার্সি ভাষার প্রত্যেকটির জন্য একশত করে গবেষকের পদ সৃষ্টি করা যেতে পারে।

৫. উপসংহার

উপরে বর্ণিত কোমল ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ এবং সংস্কৃত, পালি, আরবি ও ফার্সি ভাষায় দক্ষতাসম্পন্ন মানবিকী ও সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষক ও বিশেষজ্ঞ সৃষ্টি করা হলে বাঙ্গলার ইতিহাস পুনর্লিখন সম্ভব হবে। তবে এই মহৎ ও বৃহৎ কর্মটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আন্তরিক ও নৈতিক উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। বাঙ্গলার ইতিহাস পুনর্লিখনে এই প্রক্রিয়ার উপজাত হিসাবে দেশে একটি জ্ঞানদীপ্ত শ্রেণি সৃষ্টি হবে আর নির্মাণ হবে আমাদের অজানা অতীত। তবে, একটি কথা খেয়াল রাখতে হবে যে, কল্পিত এই অবকাঠামোটি যেন বাংলা একাডেমি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (BIDS)-এর মতো অন্ধকার গুদামে পরিণত না হয়। যদি সেরকম কিছু হয়, তাহলে আর বাঙ্গলার ইতিহাস পুনর্লিখন হবে না। বরং আরেকটি অন্ধকার গুদাম তৈরি হবে

বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই লেখাটি সর্বপ্রথম ৩১ মে, ২০২০ তারিখে বিডিনিউজ২৪ডটকম-এর মতামত কলামে প্রকাশিত হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০২১ রাত ১১:১৭
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×